‘প্রাক্তন’ ভালো লাগা-মন্দ লাগার মিশেল

জাহান রিমা: তুমি যাকে ভালোবাসো, স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো। তার জীবনে ঝড়..তোমার কথার শব্দ দূষণ, তোমার গলার স্বর। আমার দরজায় খিল দিয়েছি, আমার দারুণ জ্বর……।

‘প্রাক্তন’ ছবির মন মাতাল করা গান বেজে যায় আমার ঘরময়। সবগুলো গানই নেশা ধরানো। সেই সূত্রে ছবিটাও দেখলাম। নেশাসক্ত হবো!

দেখেই দুইদিন ধরে নিশ্চুপ। ছবিতে দেখলাম সেই নেশাক্রান্ত মাতাল মনের অধিকারী কেউ যদি ছবির নায়িকা হয়। সংসারের বউ হয়। মেয়েমানুষ নামক নেইম প্লেটে ঢাকা দেয়া একটা স্বাধীনচেতা নারী হয়, তবে কী হয়? বউটি যদি হুট করে বলে বসে- চলো পালাই! শুধু তুমি আমি-আমরা দুজন। তখন এই সমাজ কী করে তার টুঁটি চেপে ধরে। কীভাবে বলে, এভাবে বলতে নেই। ওভাবে থাকতে নেই..নেই নেই নেই আসলে নারীর আলাদা ব্যক্তিসত্ত্বাই থাকতে নেই।

তবু আমি এই ছবির গল্প বলার ঢং এ মুগ্ধ। ট্রেন চলছে। তার ভেতরে চলছে জীবনের গল্প। শেষ বয়সে দাঁড়ানো এক দম্পতির এক চিমটি খুনসুটি। তুমি তো বহুত আচ্ছা হিন্দি বলতা হ্যায়! অপরদিকে খুব সুক্ষ্মভাবে, স্বল্প সময়ের জন্য দেখানো হয় তাদের পুত্রবধূর শাশুড়িকে আঘাত দেবার অভিনব কৌশল।

এদিকে ট্রেন ভ্রমণেই আরেক নব দম্পতির হানিমুন। জীবনকে সহজ করে দেখবার কৌশল। ওদের মনোজগতের সরল সমীকরণ। ট্রুথ অর ডেয়ার নবদম্পতির দুষ্ট খেলা! মধ্যপথে ট্রেনের করিডরে বসে আনন্দময় ক্ষণে বয়স ভুলে সবাই শিশু হয়ে যাওয়া। হৈ হৈ রৈ রৈ গানের কলি খেলা। খেলার ভেতরে অন্য খেলা। নয়ন সরসী কেন ভরেছে জলে…..কত কী রয়েছে লেখা কাজলে কাজলে। প্রিয় কোনো গানে মনে করিয়ে দেয়া কারো কারো বিশেষ সময়ে বেজে ছিলো এই গান। তারা আজ আর একসাথে নেই, তবু কিছু থেকে যায় এই না থাকা জুড়ে।

তার মধ্যেই একঝাঁক তরুণের তারুণ্যজ্জোল ভুবন। মা-মাটির প্রতি দুর্বিনীত টান। তাদের মাতৃভূমি কলকাতা থেকে ভিন্নদেশে গেলে ফিরে আসার তাড়না। সেই শহরের কোন মেয়ের জন্য মনে জাগা প্রেম। সেই প্রেম হয়ে যায় ঠোঁটে উঠা তুমুল গান; শহর জুড়ে যেন প্রেমের মরসুম…….আলোতে মাখামাখি আমারই গ্রিন রুম।

আপাত মনে হবে গল্পে পাঠ করা রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতোই সিনেমাটা অনন্য। মুগ্ধকর। অথচ এর অন্তরালে আছে শুভঙ্করের ফাঁকি! মুগ্ধতার আয়ু যে বড় অল্প। আমার তা কেটে গেছে সিনেমার প্রাক্তন বউ সুদীপার একটি কথায়। গল্পের মূল প্রতিপাদ্য যা। হু হু করা ট্রেনের বাতাসের সাথে মিলেমিশে একাকার তার প্রাক্তনের জন্য হু হু করা মন। ভ্রমর কইও গিয়া, শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে অঙ্গ যায় জ্বলিয়া রে ভ্রমর..কইও গিয়া। এই বুক হু হু করা গান উজানকেও নাড়া দেয়। সুদীপাকে সুখস্মৃতির অনলে ফেলে।

দশ বছর আগের ভুল, ইগো, ছেলেমানুষী, সব মনে করিয়ে দেয়। তাতো দোষের নয়। দোষ তখনই হয়, যখন উজান আর সুদীপা দুয়ের ইগো প্রবলেম মূল হলেও, শুধু সুদীপার ইগোকেই বিসর্জন দিতে বলা হয়। উজানের নয়। দুইজনের মাঝে উজানের ভুলকে অজান্তেই হয়েছে বলে স্বীকার করা হয়। যেন সুদীপার ভুলগুলো সজ্ঞানে হয়েছে। কিন্তু তা তো নয়!

আরেকটি  ইঙ্গিত প্রাক্তন ছবিতে বিদ্যমান। বাচ্চা নিলেই সব মিটে যাবে। সন্তান মূল্যবান সেতু। কিন্তু পাড় তো ঠিক থাকা চায়ই। নিজেদের দূরত্ব না ঘুচিয়েই সেতুর আগমন! আর যাদের সেতু নেই? কিংবা যাদের বাচ্চা হবে না? তাদের জন্য কী তবে সংসার হবে না? হলেও সুখ থাকবে না? তা কী করে হয়!

ট্রেনের ছোট্ট কামরাতে উজান, সুদীপা দুজনেই আজ মুখোমুখি।

উজান তো বেশ আছে। স্বেচ্ছায় যাকে ছেড়ে গেছে সুদীপা তার জন্য কেন অনুতাপ সুদীপার? যে তোমাকে মূল্যায়ন করতে জানে না, তোমার জন্য একান্ত কিছু সময় যার প্রায়োরিটি লিস্টে নেই। তোমার আয় তার থেকে বেশি বলে যার হীনমন্যতা হয়। ভুল করে থেকে যাওয়া জামার মানিট্যাগ দেখে যে তোমাকে ঝাঁঝরা করতে সব থেকে নিকৃষ্ট হাতিয়ার নিতে পারে। বলতে পারে- অফিসে কী কর? বসকে এন্টারটেইন? দিনশেষে তার জন্যই মন দোটানা? সিরিয়াসলি? অপমান লাগে না?

জানি মন খুব বেসামাল বিষয়। তাই সুখের মুহুর্তগুলো স্মৃতির করিডরে হাঁটে। কিন্তু যে সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল, মরে গিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে, ছেড়ে গিয়ে সুখের সমুদ্রে নাও না ভাসালেও, অপমান নামক তরীতে থাকোনি, তার জন্য কেন রিগ্রেট সুদীপা? সম্পর্কের লাশ বহন করাই যথোপযুক্ত ছিল, এটা কোন যুক্তিতে সঠিক? মেয়েদের এক-আধটু ছাড় দিতেই হয়; সেই ঊনিশ শতকের চুক্তি? হাহ! একুশ শতকে এ যে বড় বেমানান।

উজানের দ্বিতীয় বউ মালিনী। উজানের থেকে বয়সে ছোট। সেটাকে দেখানো হয়েছে উপযুক্ত। এখানে কী বোঝানো হয়নি বেশী বয়সী ছেলেরা কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে করলেই সুখী হবে। তাই কী? এ কেমন নিয়ম? একুশ শতকে এই ধারণা মানা যায়? যায় না।

তবে কী নিয়ম করে সিরিয়াল নাটক দেখতে বসা মালিনী নামের মেয়েটাই ‘মোহর’? সংসার নামের গলার হারে? যে সুদীপা ‘মোহর’ দিয়ে গড়া নয়; বরং মোহরকে মালায় গাঁথার যে সূতা সেটির মতোই সূক্ষ্ম রুচিবোধ সম্পন্ন। স্ট্রং। সংসারে স্বামীর মতোই কাঁটায় কাঁটায় প্রয়োজনীয়। ইকুয়েল। সে খারাপ? তার ব্যক্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার যুক্তি খারাপ? স্যরি। আই ক্যান্ট বিসাইড উইথ ইউ।

প্রথমত আমাকে জানতে হবে- হু আই এম!

সাধারণ একটা ট্রেন যাত্রার অসাধারণ চিত্রায়ন দেখেছি এই ছবিতে। তবে যে জীবন যাপনের ছক মানুষের মানসপটে পরিচালক প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন, এই ছবির মূল মেসেজে তা কিন্তু অসাধারণ নয়। বরং পরিচালক এখনও এই প্রচলন চালু রাখার প্রচেষ্টা করেছেন- মানিয়ে নাও, মানিয়ে নেওয়াই জীবন। এই মানিয়ে নেবার শিক্ষা শুধু নারীর জন্যই প্রযোজ্য। পুরুষের জন্য নয়। তাই না!

কিছু ভুল দুজনেরই ছিলো। কিন্তু শুধরানোর কৌশলটা শুধু একজনকে শেখানো কেন? উজান গল্পের নায়ক। দ্বিতীয় বিয়ে করে খুব সুখে আছে। কিন্তু সুদীপা দ্বিতীয় বিয়ে করে সানন্দে থাকার আভাস খুব সামান্য করে দিয়ে, অসুখী সে। আদ্যপান্ত অসুখী। এই ক্যারিশমার কারণ কী? সে মেয়ে বলে? মেয়েদের দ্বিতীয় বিয়ে হওয়া ভয়াবহ রকমের বাজে ব্যাপার, সে অচ্ছুত, কোথাও তার সুখ নেই। অবলা। এই ধারণা প্রোথিত করা কেন?

দিনশেষে দেখানো হয় সুদীপাই কেবল হেরে গেছে। না তো! তার আফসোস হয়। আত্মপ্রত্যয়ী সুদীপার আফসোসের ব্যাপারটা তার নিজস্ব প্রকৃতির সাথে কন্ট্রাড্রিক্ট করে। যায় না।

আর উজান?

উজানের কন্যা সন্তান উদিতা তাকে পাল্টে দিলো। বাবা হবার মতো দায়িত্ববান করলো। উজান তাই বলছিলো- পৃথিবীতে সন্তানের চেয়ে সুন্দর কিছু হয় না। কিন্তু সেই সন্তানের মাকেও যে সে সৌন্দর্যের সঙ্গে রাখতে হয়। এই সন্তানও একদিন মা হবে। বাবা হবে। এই সরল অংক কে বোঝাবে উজানদেরকে?

তবে মালিনীর এই মেসেজ ভালো ছিলো, প্রাক্তন বিষয়ে।

জাহান রিমা

‘আমি কোনদিন জিজ্ঞেস করিনি পুরনো কথা। কার মনে কী ঘা আছে কে জানে? তুমি যাকে ভালোবাসো তার সবটা নিয়েই বাসো। ভালো মন্দ সবটা।’ তাইতো। কেননা আমরা কেউ অতীতে বাঁচি না। বর্তমানে বাঁচি।

কিন্তু মালিনীর সুদীপার উদ্দেশ্যে বলা শেষ কথাটিতে আমার আপত্তি আছে। ‘আমার কাছে এডজাস্টমেন্ট মানে হেরে যাওয়া নয়।’ এটাতেই আমার আপত্তি। তার কাছে না হলেও অন্য কারো কাছে অবশ্যই হেরে যাওয়া। হতেই পারে, যদি এই হারে পক্ষপাত থাকে।

‘এডজাস্টমেন্ট, কমপ্রোমাইজ মানে এক রকম জিতে যাওয়া।’ এই যাওয়াটা দুজনের জন্যই সমান। এটা কেন শুধু সুদীপাকেই বুঝতে হবে, মানতে হবে? উজানকে নয়? এছাড়া সুদীপার প্রমোশন। উজানকে সে খবর দেয়া। উজানের খোঁচা। তার মানে কী রাতেও বাড়ি না ফেরা? অত:পর সুদীপার দীর্ঘদিনের জমে থাকা ইনটেনশান থেকে উজানকে আঘাত দিয়ে বলা- উজান জেলাস। এবং আবারো বিবাদ।

ঠিক সেই সময়ে উজানের হাতে ছিলো সেইসব পত্রিকার কাটিং, যাতে সুদীপার কৃতিত্ব গাঁথা। উজান তা সংরক্ষণ করছিলো। দেয়ালে টাঙানো ভালোবাসা। যা সুদীপার চোখ এড়িয়ে যায়।

পরে যখন চোখে পড়ে তখন অপরাধবোধ জড়িয়ে ধরে। কিন্তু কী আর করা! কথা আর বুলেট এই দুই জিনিস তো বের হলে আর ফেরানো যায় না! উজান এখানে জিতে গেছে সুদীপার প্রতিনিয়ত প্রকাশ করা নিত্য ভালোবাসার কাছে। জিতে গেছে উজানের অনুচ্চারিত ভালোবাসা।

এরপর সন্ধ্যা নামে ছাদে। একসাথে বসা দুজন।

নিজেদের খুঁজে পেতে ব্যালেন্স দুজনকেই করতে হবে। উজানের এই অনুভব দারুণ। এই বলে সুদীপাকে আদর করা। একান্ত কিছু সময় কাটানোর প্রতিজ্ঞা করা, দারুণ। উজান সেই সময়ে সুদীপাকে কপালে চুমু দেয়। সব পুরুষ তা দিতে পারে না। নিষ্পাপ সৌন্দর্যে ভরপুর এই আদর। ভালো লেগেছে আমার!

অত:পর দুহাত এক হতে যেয়েও ছেড়ে যাওয়া। একান্ত কিছু সময়ের জন্য সুদীপার কাছে যাওয়া হয় না উজানের। সুদীপার কাছে ফোন। যাওয়া হচ্ছে না উজানের। উজান শশ্মানে। হায়!  সুদীর্ঘ সময়ের প্রতীক্ষার পর দুইজনের দুইটা দিনের জন্য এক হতে যাওয়া। দূরে কোথাও হারিয়ে যাওয়া, নিজেদেরকে খোঁজার জন্য, হলো না আর।

সুদীপার কাছে তখনই মনে হলো, নাহ আর না। আমাদের সম্পর্কটাই শ্মশানে। উজানের কাছে সুদীপার প্রায়োরিটি নেই। সেই বধ্যমূল ধারণা। বিয়ে করেছে। সুদীপা তো আছেই, তার আবার প্রায়োরিটি কী! থাকবেই। যেন এই থাকা ভিন্ন সুদীপার ভিন্ন কোন পথ নেই। বিকল্প নেই। তাই কী? সারাজীবন স্বাধীন জীবনযাপন করা সুদীপা কি একলা চলতে পারবে না? সমুদ্রের ধারে বয়ে যাওয়া ঝড় বয়ে যায় দুটি জীবনে। ইটস অল ওভার…..সুদীপার সামনে সমুদ্র। ডুবে যাচ্ছে শেষ নৌকাটা।

আমি সিনেমাটা দেখে ঘোরে ছিলাম। ঘোর কাটিয়ে কলম নিলাম। ঘোর কাটিয়েই বলছি। সিনেমাটা সবাই দেখুক। দেখা প্রয়োজন। প্রয়োজন এটা জানার জন্য; স্পর্শকাতর কিছু সময়ে সব ভুলে স্পর্শ করে দিতে হয়। বাকি পৃথিবী ভুলতে হয়। একটা চিরকুটে দুটা কথা লিখে রাখা যায়। মানুষ খুব ছোট বিষয়েই ভালেবাসা টের পায়। ছোট ছোট এইসব ভালো লাগার গুরুত্ব দিতে হয়। বুঝতে হয় তাতে কারো তুমুল আবেগ জাগে। এই আবেগের মৃত্যু হতে দিতে হয় না। এমন করেই নি:শব্দের নৈরাশ্য ভাঙতে হয়। সময়ের প্রয়োজনে ফোন দূরে রাখতে হয়। সব দূরে রেখে কাছে টানতে হয়, একান্ত কিছু সময়ের জন্য। এসব করতে হয়। নয়তো সুদীপাদের নৌকাডুবি হবে। উজানরা ভাটাতেই হারাবে…..।

জাহান রিমা, ভ্যালেন্সিয়া কলেজ, যুক্তরাষ্ট্র।

শেয়ার করুন: