KUP: অনলাইনে যৌনবিকৃতদের আরেক স্বর্গরাজ্য!

জান্নাতুন নাঈম প্রীতি: KUP: Kingdom of Uncensored People. হ্যাঁ, আমি যখন সমস্ত ক্রিনশট, তথ্য-উপাত্ত হাতে পেয়ে গা গুলানো অনুভূতি নিয়ে লিখতে বসলাম, তখন ক্রমেই আবিষ্কার করলাম, ফেসবুকে এটা হচ্ছে সেইরকম ‘না-মানুষ’দের একটি গ্রুপ, যারা সেন্সরশিপ মানবে না এবং সেন্সরশিপ না মানবার আড়ালে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে ‘নিছক মজা পাওয়া’র ছলে একটি যৌনবিকৃত, ধর্ষক ও যৌনলিপ্সু বিকৃত কিছু অমানুষে ভরা অন্ধকার জগৎ তৈরি করবে।

আরও সুন্দর করে বলতে গেলে- এরা একটি অপরাধী চক্র যারা শুধুমাত্র সাইবার ক্রাইমই করছে না, অনলাইনে যৌনবিকৃত ‘না-মানুষ, না-পশু’দের একটি অভায়ারন্য প্রতিষ্ঠা করছে! মূল কাজ হচ্ছে- ‘ফান করছি’ এজেন্ডা ধরে রেখে যৌনবিকৃত একটি কমিউনিটি গড়ে তোলা, ধর্ষক হিসেবে মানসিকতাটাকে নিখুঁতভাবে প্রস্তুত করা।

এরা তারাই, যারা ‘দেশ’ থেকে শুরু করে ‘প্রেমিক বা প্রেমিকা’, ‘মুখ’ থেকে শুরু ‘হাত ও পা’, কোনোকিছুকেই নিজেদের যৌন বিকৃতি থেকে রেহাই দেয়না। মেয়েদের ব্রা, বুক, যোনি নিয়ে বিকৃত মন্তব্য করে পাশবিক উল্লাস উপভোগ করে। আপনি এই গ্রুপে ঢুকেই প্রথম থেকে যা দেখতে পাবেন তার একটি ধারণা দেই।

আপনি দেখতে পাবেন- আপনার বোনের বয়সী, প্রেমিকার মতন দেখতে কোনো মেয়ের বুকের ছবি অথবা নগ্ন ছবি তুলে দেয়া হয়েছে, ক্যাপশানে লেখা- এরকম আরও বুকের ছবি দিতে পারো ফ্রেন্ডস? সেখানে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে ওই ছবি নিয়ে মন্তব্য, ফটো কমেন্ট আর লাইকের ছড়াছড়ি! মজা লাগছে তবুও? ঠিক আছে, নিজের প্রেমিকা, মা, ছোট বোনটিকে ওই ছবির মেয়েটির জায়গায় বসান।

এখনো মজা লাগছে কি?

আরও একটু খুলে বলি, কেমন?

১। বৃষ্টিতে ভেজা কোনো মেয়ের ছবি দেয়া হবে, ক্যাপশনে লেখা হবে- তুমি শুধু এইভাবে আমার সামনে এসো, আমি তোমার জন্য শীতের মধ্যেও প্রতিদিন গোসল করবো। অথবা, মেয়েদের কোন যৌনাঙ্গটি হাতড়ে বেশি আনন্দ পাওয়া যায়, ছেলেদের যৌনাঙ্গটি কীভাবে সবচেয়ে বিকৃত উপায়ে ব্যবহার করা যায়, সর্বোপরি মেয়েদের কীভাবে ধর্ষণ করা যায়। সবচেয়ে অবাক বিষয় হচ্ছে সেসব পোস্টে গাদা, গাদা মেয়ের লাইক দেখে লজ্জায় আমার মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হলো।

২। এক ছেলের পোস্ট দেখলাম, সেখানে সে কী কী ড্রাগ নেবে তার সদর্প বর্ণনা করছে। এক মেয়ে জানতে চাইছে- কী কী যৌন গালি শুনে উত্তেজিত হওয়া যায়? অন্য মেয়ে তার ভাষায় ‘মহাপুরুষদের দেখতে চাই’ শিরোনামে পোস্ট দিয়ে আমার ভাষায় যারা ‘ধর্ষক’, তাদের স্বাগত জানিয়েছে।

৩। ধর্ষক যে মেয়ে হয়েও হওয়া যায়, অন্তত এদেশে; একটি মেয়েকে যৌনবস্তুতে পরিণত করে, একটি মেয়ের অঙ্গ নিয়ে অশ্লীল রসিকতা করে শত শত মেয়ে কমেন্ট করে নিজেদের বিকৃতি জানান দিতে পারে। একটি ছেলেও যে ছেলে ও মেয়েদের শরীরের অঙ্গগুলি নিয়ে নোংরা মন্তব্য করে সবাইকে সাইবার অপরাধে উৎসাহিত করে, অনেক অমানুষের সমর্থন পাওয়া যায়- তা আমি না দেখলে কখনো জানতাম না। জানলেও বিশ্বাস করতাম না।

যৌনবিকৃতদের স্বর্গরাজ্যে আপনাকে স্বাগতম! এরা কারা জানেন?

আমি বলছি- এই বছর সেপ্টেম্বর মাসের ২০ তারিখে মার্জিয়া প্রভার লেখা ‘DSU: অনলাইনে যৌন বিকৃতদের আখড়া’ শীর্ষক রিপোর্ট প্রকাশ পাবার পর যাদের সাইবার ক্রিমিনাল হিসেবে ধরে নিয়ে গিয়েছিল আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সেই তারাই! নতুন রূপে ও নামে ফিরে এসেছে!

মজার ব্যাপার হচ্ছে- শুধু ফিরেই আসেনি, আগের গ্রুপ(যেটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বর্তমানে) নিয়ে হাঁ-হুতাশ খুব সামান্যই করেছে। বরং যথাযথ সাজা না পেয়ে, আইন গলে পার পেয়ে- নিজেদের মধ্যে গেট টুগেদার অর্থাৎ পুনর্মিলন আয়োজন করে সেই ছবিও সদর্পে ওই গ্রুপে প্রকাশ করেছে! যারা নিজেদের মানসিক যৌনবিকৃতিকে ছড়িয়ে দেয় জঘন্য মেয়ে ও ছেলে উভয়ের শরীরের নানা অঙ্গ, যৌনাঙ্গ নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য এবং নিজের যৌনজীবনের কথা অশ্লীলভাবে উপস্থাপন করে বিকৃত আনন্দ পায়।

গ্রুপের মেম্বার কয়জন জানেন? তেরো হাজারেরও বেশি! আগের গ্রুপে কত মেম্বার ছিল মনে আছে? ১লাখ ২২ হাজার! আমি যদি এই মেম্বারদের ১৩ হাজারকে আগের গ্রুপের ১ লাখ বাইশ হাজার থেকে মাইনাস করে হিসেব করি, তাহলে এখনো ১ লক্ষ ৯ হাজার যৌন বিকৃত মাথার কথা গোপন করা হয়ে যাবে।    

উল্লেখ্য, রসিকতা বলে প্রচার করা এসব বিকৃতি শুধুমাত্র অধিকাংশক্ষেত্রে নারী শরীর বা পুরুষের পুরুষাঙ্গ নিয়েই সীমাবদ্ধ নয়। সেটির দৌড় ড্রাগ নেয়াকে আধুনিকতা হিসেবে প্রমাণ করা সংক্রান্ত পোস্টেও। যেমন- এক স্কুল বা কলেজ ড্রেস পরা মেয়েকে তার পাশে বসা ছেলেটি সিগারেট ধরিয়ে দিচ্ছে আর ক্যাপশান হিসেবে ‘যে ছেলে এমন করে সিগারেট ধরিয়ে দেয়, তাকেই তো বিয়ে করা যায়’- লিখে ছবি পোস্ট করেছে এক মেয়ে। তাকে বাহবা দিচ্ছে আরও বহু ছেলেমেয়ে।

দেখলাম এক ছেলে একটি ছবি নিয়ে ট্রল করেছে। যেখানে দেখানে দেখা যাচ্ছে যে, একটি মেয়ে দুঃখিত মুখে জানতে চাইছে- শুধু দেশকে ভালবাসো? আমাকে ভালবাসো না? ছেলেটি বলছে- দেশকে ভালবাসলে ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিঃমিঃ জায়গা পাবো, আর তোমাকে ভালবাসলে মাত্র ২ ইঞ্চি জায়গা পাবো।

দেশকে ভালবাসা আর যৌনবিকৃতিকে এরা একই পাল্লায় মাপছে। দেশকে ভালবাসা বলতে বোঝাচ্ছে যৌনবিকৃতি চরিতার্থ করার জন্য একটি বিরাট ক্ষেত্র, যেটি কোনো মেয়ে মেটাতে পারছে না! ড্রাগকে দেখাচ্ছে আধুনিকতা হিসেবে।

উঁহু, সবকিছু নিয়ে রসিকতা হয় না। একটা মেয়ে ও ছেলে একে অপরের সম্মতিতে কী করছে, নিজেদের মাঝে কেমন যৌনতার চর্চা করছে তা তাদের ব্যক্তিগত। কিন্তু এই ব্যক্তিগততাকে অনলাইনে নিছক মজা হিসেবে ছড়িয়ে দিয়ে কি আদতে যৌনবিকৃতিকে উৎসাহ দেয়া হচ্ছেনা? দেশকে যৌনবস্তুর সাথে তুলনা করে যৌনবিকৃতি অনুপ্রেরণা দেওয়া হচ্ছেনা?

ওই গ্রুপে আমার লিস্টেরও অনেক সাধু নারী ও পুরুষ আছেন। নারী স্বাধীনতা, মানবাধিকার নিয়ে নীতি কপচানো ছেলেমেয়ে আছেন। তারা মজা নিচ্ছেন, চুপ করে আছেন, সাইবার ক্রাইমের অংশ হয়েও নির্লিপ্ত হয়ে আছেন।

পনার পাশের নারীটি, নারী হতে চলা তরুণী বা কিশোরীটি আপনার কাছে নিরাপদ তো? যেদিন নিজের মা’কে, বোনকে, প্রেমিকাকে, স্ত্রীকে নিয়ে এই বিকৃতরা ঠিক এই ‘KUP: Kingdom of Uncensored People’ নামের গ্রুপটিতে হাসতে হাসতে ধর্ষণ করবে মুখের ভাষায়, মনের কল্পনায়, সাহস পেয়ে হাত বাড়াবে বাস্তবের সত্যিকার শরীরটির দিকে, তখন এই নির্লিপ্ততা আপনার থাকবে তো? মনে রাখবেন- এই সাইবার ক্রাইম, মূল্যবোধের অবক্ষয়জনিত অপরাধ আপনাকেও ছাড়বে না।

অপরাধ অপরাধই। হাজার হাজার অমানুষ মিলে একটি অপরাধ করলেই সেটি শুদ্ধ হয়ে যায়না। অপরাধ যে বা যারা প্রশ্রয় দেয়, তারাও সমান অপরাধী। কারণ, অপরাধ মেনে নেওয়ার প্রবনতাও অপরাধেরই নামান্তর।

আপনার ছেলে বা মেয়ে সন্তানকে এই অপরাধ প্রবণতা থেকে দূরে রাখতে প্রতিবাদ করা জরুরী আপনারও। কোনটি ‘বিনোদন’ আর কোনটি ‘বিকৃতাচার’ সেই পার্থক্য বুঝাতে হলেও প্রতিবাদ করুন। ঘরের নারীটিকে নিরাপদ রাখতে, পুরুষটিকে যৌনতা বিকৃতাচারজনিত সংক্রমণ থেকে দূরে রাখতে, ছেলেমেয়ে উভয়কে এই অপরাধ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিন। আইনজীবী ভাইবোনেরা হয়তোবা বলতে পারবেন কতোটা ভয়াবহ এই সাইবার ক্রাইমের নামী অপরাধটি।

অপরাধ করেও যারা গতবার পার পেয়ে গিয়েছিল, আবার শুরু করেছিল সেই পুরাতন নোংরামি- তাদের বিরুদ্ধে এবার সত্যিকার কঠোর সাজার ব্যবস্থা নেওয়া হোক। একটি দৃষ্টান্ত তৈরি হোক। সমাজের জঞ্জাল আমরা যেভাবে সাফ করি, অনলাইনের জঞ্জালও ঠিক সেভাবেই সাফ করা হোক।

মনে রাখুন, অনলাইনের এই চরিত্রগুলিই আপনার চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটি ধর্ষক ও যৌনবিকৃত মাথা নিয়ে। কালকের ধর্ষিতা বা ধর্ষিতটি যে আপনি বা আপনার স্বজন নয় সেটি নিয়ে কি গ্যারান্টি দিতে পারেন?

এবারও সোচ্চার হবেন না?

আমরা কি এরপরও প্রতিবাদ করবো না?

শেয়ার করুন: