আপনাদের ভালোবাসার স্রোতে আমায় ডাকবেন না

ফারজানা আকসা জহুরা: ম্যাসেজ টা যখন প্রথম পেয়েছিলাম খুশি হয়েছিলাম , ভেবেছিলাম আমিও আমার প্রোফাইল ছবিটি পরিবর্তন করবো। পরে আর ইচ্ছে হলো না।

আমি আপনাদের মতন দেশের প্রতি ভালোবাসা দেখাতে পারবো না । আমার কাছে ভালোবাসা ধারণ এবং লালন-পালনের জিনিস, দেখানোর না। আপনারা বিশ্ব রেকর্ড করতে চান? এমনেই তো আমাদের বিশ্ব রেকর্ড আছে, দুর্নীতির দেশ … যানজটে ঢাকা …. অপরিকল্পিত নগর ঢাকা …. আরও কত কী!

আমরা আর কী দেশের নাম উজ্জল করবো? বলেন তো? কিছুদিন আগে আব্দুল করিম নামে এক গরিব লোক বিশ্বে সমাদৃত হয়েছেন। তিনি তো ফেসবুক ব্যবহার করতেন না, তাও ফেসবুক তাকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছে। একদল গরীব মেয়ে খেলায় নাম করেছিল, তারা তো খেলা দিয়ে দেশের নাম উজ্জল করেছিল। দেশ প্রেম প্রমাণের জন্য কি তাদের ফেসবুকে প্রোফাইল ফটো পরিবর্তন করতে হয়েছে?

আর যারা যুদ্ধ করেছে? যাদের জন্য এই স্বাধীনতা? তারা? তারা নিশ্চয় যুদ্ধের ময়দানে বসে সেল্ফি তুলে রেখে যাননি? তাই না? তাই তো কিছু খ্যাতনামা মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া বাকিদের কোনো নাম নাই …. নাই কোনো দাম ! আর সাধারণ যুদ্ধ ক্ষতিগ্রস্তদের? তাদের তো কোনো মূল্যায়নই নাই। এই দেশে এখনো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যবসা হয়, মুক্তি যোদ্ধা সার্টিফিকেট বিক্রি হয়! বিক্রি হয় উচ্চমূল্যে চাকরি! আমি এমন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কী করে গর্ব করি, বলেন তো? তাই আপনাদের এই ফেসবুকিয় ভালোবাসার স্রোতে আমাকে পাবেন না।

আমকে খুঁজবেন ঐ যে অসহায় মানুষগুলির মধ্যে, যারা রাস্তায় থাকে … ঐ পাগলির পাশে, যার সন্তান রাস্তায় হয়। পাবেন ঐ অসহায় লোকগুলির পাশে, যারা বিনা চিকিৎসায় স্বাধীন দেশে ধুঁকে ধুঁকে মরে। আমি থাকবো সাঁওতালদের সাথে … পাহাড়িদের সাথে, থাকবো সংখ্যালঘু আর রিফিউজি রোহিঙ্গাদের সাথে। কাঁদবো তনু-মিতু-পূজাদের জন্য l আমি ভালোবাসবো রাজন-সাদ্দাম-জিয়াদ আর নাম না জানা ঐ শিশুদের, যাদের আপনারা কখনো ম্যানহোলে ঢুকিয়ে মারেন … কখনো পায়ুপথে বাতাস দিয়ে মারেন। আমি চাইবো ঐ সদ্যোজাত সন্তানদের মা হতে, যাদের আপনারা উপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে নির্মমভাবে হত্যা করেন, অথবা রাস্তার পাশে ফেলে দিয়ে যান, যাদের নিয়ে কুকুর কামড়াকামড়ি করে।

প্লিজ বলবেন না ওরা অমানুষ, বলেন আমরা এখনও সভ্যতা শিখিনি! আমরা এখনো অসভ্য সমাজে বসবাস করি। যেই দেশে তনুদের বিবস্ত্র করা হয় … ধর্ষণ করা হয়…. করা হয় হত্যা। যেই দেশে হত্যা ধর্ষণের কোনো বিচার হয় না, যেই দেশে মৃত নারীর চরিত্র হরণ হয়, যেই দেশের সমাজ ব্যবস্থা পাঁচ বছরের পূজাকে ধর্ষণ করার বৈধতা দেয়, দেয় ধর্ষকদের পাপ মোচনের সুযোগ হিসেবে বাল্যবিবাহ, সেই দেশ নিয়ে আমি কেমন করে গর্ব করি? অহংকার করি?

এমন দেশের নাগরিক আমরা যেখানে সবার জন্য কোনো নাগরিক সুযোগ সুবিধা নেই, নেই উন্নত চিকিৎসার সেবা ! শিক্ষা থাকে জরাজীর্ণ অবস্থায়! খাদ্যের নামে আমরা বিষ খাই! আবার তুলি তারই সেল্ফি? ঐ ভালোবাসার স্রোতে আমি নাই।

ধর্মের নামে যেখানে এখন বর্বরতা হয়। যেখানে ঈমান নাই, ইসলাম আছে , পবিত্রতা নাই নামাজ আছে, সংযম নাই রোজা আছে , যাকাত নাই ঘুষ আছে, সেবা নাই হজ আছে , আর ফেসবুকে আমিন আর আমিন আছে। ঐ ভালোবাসার স্রোতে আমি নাই ।

আমি ঐ দেশ আর ঐ ধর্ম দু্টই থেকে দূরে থাকতে চাই। আমি আমার অবহেলিত অসহায় দুর্নীতি রোগগ্রস্ত বাংলাদেশকে খুব ভালোবাসি। কিন্তু আপনাদের ফেসবুকের প্রোফাইল ফটো পরিবর্তনের বাংলাদেশকে নয়।

করেন ভাই করেন আপনারা প্রোফাইল ফটো পরিবর্তন করেন। দয়া করে আমাকে আপনাদের মিছিলে টানবেন না। এতে যদি আমাকে কারোর রাজাকার মনে হয় , তাতেও আমার কোনো আপত্তি নাই। যেই দেশে রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা আছে, ঐ দেশে আমি রাজাকার হলে দোষ কী?

শেয়ার করুন: