জিনাত হাসিবা স্বর্ণা: নীলফামারি চিলাহাটির গোমনাতী গ্রাম। বনবিভাগের অন্যায়ভাবে দখল করে নেওয়া জমি ফিরে পেতে শক্ত সংগ্রামে নেমেছে বহুদিন ধরে শোষিত মানুষের দল। এখন বনবিভাগের ঠুকে দেওয়া মিথ্যা মামলা সামাল দিতে হিমশিম, তবু হাল ছাড়েনি। অনেক কথা শুনলাম, জানলাম কত গুছিয়ে আর শক্ত হাতে হাল ধরে তারা আইনসম্মতভাবেই তাদের অধিকার আদায়ের পথে হাঁটছেন। মুগ্ধ হয়ে শুনলাম। সবশেষে একটা বিষয়ের উত্তর খুঁজছিলো মনটা। বললাম, আমার একটা বিষয় জানার আছে আপনাদের কাছে।
-“আপনাদের এই সংগ্রামে কোনো নারী নাই কেন?”
-“নারীদের আমরা আন্দোলনে পছন্দ করি না।”
-“বেশ। আন্দোলনে নারীদের পছন্দ না; কেউ কি ব্যাখ্যা করতে চান বিষয়টা?”
-“আমাদের এই আন্দোলনে কোর্ট-কাচারির বিষয় আছে। আমরা মামলা খেয়ে বসে আছি। বাড়িতে ফিরতে পর্যন্ত পারি না। ওদের তো সম্মানের একটা বিষয় আছে। এই কোর্ট-কাচারির চক্করে ওরাও তো পড়তে পারতো এই আন্দোলনে থাকলে। তাছাড়া নারীরা এইসবে এলে পরিবারের দেখাশোনা করবে কে?”
পাশ থেকে মাঠ পর্যায়ের এক সহকর্মী একটু তাল মেলানোর চেষ্টা করলো,
-“কথাটা কিন্তু ঠিকই বলেছে।”
তিনি আরেকটু ব্যাখ্যা করার চেষ্টায় যেতেই আমি হালকা স্বরে বললাম,
-“আমি উত্তর পেয়ে গেছি ভাই, ঠিক-বেঠিকের জাস্টিফিকেশন চাই না।”
ফিরে এলাম আলোচনায়।
-“আজকে এইটা আলাপের বিষয় না। কিন্তু দুইটা কথা বলার আছে, পরে ভেবে দেখবেন সময় করে।
আপনারা তো মুক্তিযুদ্ধের কথা সবাই কম-বেশি জানেন?”
-“হ্যাঁ, হ্যাঁ জানি তো”।
-“একটু গল্প করি দুই মিনিট। আমার এক সহকর্মী আছে। নাম তন্বী নওশীন। ওর মা মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে। নাম শিরিন বানু মিতিল। কিছুদিন আগে মারা গেছেন। আজকাল মাঝে মাঝে পত্রিকায় নাম আসে, দেখবেন। ধরেন উনি যদি যুদ্ধে না গিয়ে ঘরে থাকতেন, তাহলে কী হইতে পারতো? নারীদের সাথে কী হইসে? যুদ্ধের সময় নারীরা এই আজকে আপনারা যা বলতেসেন এইরকম কারণেই হয়তো ঘরে ছিলেন। ছেলেরা যুদ্ধে গেছেন। কী হইসে বলেন? যারা যুদ্ধে গেছে, তারা যুদ্ধ করে সম্মানের মৃত্যুবরণ করছে। যুদ্ধে গেলে নারীদের নিরাপত্তার সমস্যা আর অনেক রকম অসম্মান হবে বলেই হয়তো তাদের বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ঘরে থাকতে হয়েছিল। ছিলো নিরাপদে? ধর্ষণ হইসে, যেইটাকে আপনারা সবচেয়ে অসম্মান বলেন। অত্যাচারের শেষ সীমা পর্যন্ত সহ্য করতে হইসে, হয় নাই?”
-“হ্যাঁ ঠিক বলছেন”।
পাশ থেকে আরেকজন বললো,
-“কিন্তু যুদ্ধের সময়ের কথা আলাদা”।
আমি কিছু বলার আগেই তার পাশ থেকে ওদের মধ্যেই একজন বললেন,
-“না, ঠিকই বলছে। আলাদা কিছু না”।
আমি শুধু হাসিমুখে বললাম, আপনারা আপনাদের জায়গা থেকেই ভেবে দেইখেন – আন্দোলনে নারীরা সাথে থাকলে অসম্মান হবে, নাকি আলাদা করে রাখায় অসম্মানের মুখে পড়ে যেতে পারেন তারা।”
পরিবার দেখাশোনার দায়িত্বের কথায় আর গেলাম না। এখনো অনেক উন্নয়ন কর্মীও মনে করেন, পরিবারের দায় এবং যত্ন মূলত নারীর দায়িত্ব, পুরুষ ‘সাহায্য’ করতে পারে। এতেই ‘সমাজের মঙ্গল’, এইটা জাস্ট ডিসট্রিবিউশন অব ওয়ার্ক।
বিষয়টাকে জাস্টিফাই করা যুক্তিগুলিতে আসি। সন্তান থাকলে রিস্ক মিনিমাইজ করার জন্য না হয় আন্দোলনে একজন থাকলেন। এখন মামলার কারণে বাড়ির বাইরে বাইরে পুরুষটি, যে কিনা কোর্ট-কাচারির অসম্মান আর ঝামেলা থেকে দূরে রাখার জন্য পরিবারের নারীটিকে আন্দোলনে সহযোদ্ধা হিসেবে নেন নাই। ঘরে থাকা এই নারীকে প্রভাবশালীদের কেউ এসে ধর্ষণ করে যাবেন না, তার গ্যারান্টি কী? যে সমাজ কোর্টে যাতায়াত নারীর জন্য অসম্মানের মনে করে, সে সমাজ ধর্ষণ হবার পর নারীকে কী সম্মানটা দিবে?
এতোগুলি মানুষ, এতোগুলি পরিবার। রিস্ক মিনিমাইজ করাই যদি উদ্দেশ্য হয়, তাহলে কেন সব ঘরেরই পুরুষরা থাকবেন এসব প্রচেষ্টায়? কেন এক পরিবারের পুরুষ তো অন্য পরিবারের নারী নয়? পরিবারের হিসেবে তাতেও তো রিস্ক মিনিমাইজ হলো।
কিন্তু হবে না। হবে না কারণটা পরিষ্কার। সেই প্রথম উত্তরটা- আন্দোলনকারী নারীদের পছন্দ না। যুদ্ধংদেহী নারী দূর থেকে খারাপ না দেখতে, কিন্তু নিজের সঙ্গীটাকে একটার বেশী দুইটা রা করতে দেখলে নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা পরিণত হয় দমিয়ে রাখার অজুহাত মাত্রে।
এই প্রশ্নগুলিই বলি বা ক্ষোভগুলিই বলি, গ্রামের ঐ খেটে খাওয়া মানুষগুলির উদ্দেশ্যে নয়। আমাদের উদ্দেশ্য, যারা বাইরে সচেতন মানুষের প্রলেপ নিয়ে ঘুরি। অথচ একটু এদিক-ওদিক হলেই বেরিয়ে পড়ে গোঁড়াটা। সিস্টেমের ভেতরে থেকে সিস্টেম চেঞ্জের কথা বললে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড আসতে বাধ্য, তাই আমরা সবাই কম বেশি ডাবল স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করি, কিন্তু ডাবল স্ট্যান্ডার্ড আর হিপোক্রেসির মধ্যে তফাৎ আছে।
গোমনাতী গ্রাম, ভূমি অধিকারের আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধে নারী-পুরুষ- সব একাকার হয়ে আসছে আমার ভাবনায়।
মুক্তিযুদ্ধ আর দেশের ব্যাপারে তীব্র একটা ভালো লাগা, কষ্ট, টান ছোটবেলা থেকেই ছিলো। কারণ আমাদের বাসায় বই পড়া, গান শোনা, টিভি দেখা এসব আমাদের জীবনের অংশ ছিলো, ঠিক বিনোদন না। আলোর মিছিল আর জীবন থেকে নেওয়া প্রতি বছর দেখাতো, আর প্রতি বছর আগের চেয়েও বেশি আগ্রহ নিয়ে দেখতাম। প্রত্যেকটা সংলাপের ভেতরের অর্থগুলিকে ইন্টারপ্রেট করার চেষ্টা করতাম আর অদ্ভুত আনন্দ পেতাম আবিষ্কার করে। এখন বিষয়গুলির ধারা পাল্টেছে আমার কাছে। এখন ভাবনাগুলি অন্য অনেক দিকে যায়।
সেদিন শিরিন বানু মিতিলের ছোট্ট একটা ইন্টারভিউ পড়ার পর থেকেই যেমন ভাবছি- কী হতো যদি শিরিন বানু মিতিলের মতো আরো অনেক নারী যুদ্ধে যেতেন? মুক্তিযুদ্ধের এক একটা সিনেমার দৃশ্য চোখে ভাসছে। কী হতো যদি প্রেমিকাকে অপেক্ষায় না রেখে প্রেমিক-প্রেমিকা দুজনে একসাথে যুদ্ধে যেতেন? কী হতো যদি পরিবারকে আগলে রাখা আর নিরাপদে ঘরে বসে থাকার দায়ভার যদি সেদিন স্ত্রী আর মায়ের উপর না বর্তাতো?
আজকের এই ‘৩০ লক্ষ শহীদ’ আর ‘২ লক্ষ মা-বোনের ত্যাগ’ এর বদলে আমরা অন্য কোনো ইতিহাস পেতাম? যেখানে বীর শহীদ বলতেই পুরুষ আর মা-বোনের ত্যাগ বলতেই যৌন অত্যাচার সহ্য করা নারী বোঝাতো না? পেতাম অন্য কোনো ইতিহাস!
১৫ ডিসেম্বর ২০১৬