শুভ হোক ভালোবাসাবাসি

সুরাইয়া আবেদীন: আপু তুমি কি বিজি? ফ্রেঞ্চ এক্রিলিক করে দিতে পারবা? আমারটা তোমার মতো সুন্দর হয় না… আর পার্লারে যাবার সময় নাই… ও রাগ করবে দেরি হলে।

একটু বিরক্তই হলাম। প্রতিবেশী তনিমা খালামনির মেয়ে রিমঝিম, নাইনে উঠলো…অথচ ভাব দেখলে মনে হবে ইউনিতে পড়ে।

আমি- ফ্রেঞ্চ এক্রিলিক করে কী হবে? তোমার হাত তো এমনিতেই কতো সুন্দর।

রিমঝিম- না না, ও পছন্দ করে না। আমাকে বলে অমুকের মতো করে থাকতে…

আমি- এই অমুকটা আবার কে?

রিমঝিম- খিলখিল হাসি… তুমি চিনবা না আপু!!

আমি- আহা বলই না কে??

রিমঝিম- সে পর্ন স্টার… খুবই সুন্দর!! ও বলছে আমার সবকিছুই ওর মতো! কাজেই আমাকে ওর মতো থাকতে হবে, চুল থেকে নখ পর্যন্ত…, তুমিই বলো অমন কি সম্ভব?? তাও চেষ্টা করি, নইলে আমি ওকে হারাবো!

সুরাইয়া আবেদীন

ফ্রেঞ্চ এক্রিলিক করে দিলাম, রিমঝিম চলে গেল, তবে যে ধাক্কাটা আমি খেলাম সেদিন তা সামলাতে বেগ পেতে হয়েছে!

প্রেম কী এখন? এতো ভয়াবহ পরিবর্তন প্রেমে কবে, কখন আসলো? এটা কি আসলেই প্রেম? প্রেমিকাকে পর্নের নায়িকার মতো থাকতে হবে? নইলে রিলেশন থাকবে না??

গত ফেব্রুয়ারিতে এক ছেলের ফেসবুক স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট দেখেছিলাম। প্রেমিকা তাকে কয়টা লাভ বাইট দিয়েছে এবং তা নিয়ে সে কত গর্বিত জানিয়েছে ফেসবুকে!

‘হৃদয়ে’ প্রেমিকা আঁচড় কাটতে পারলো কীনা তা নিয়ে সে চিন্তিত হয় নাই, পিঠ আর গালের কামড়ে সে আনন্দিত!

আহা কী প্রেম!

মেয়েরাও কি কম যায়?

মাঝে মাঝেই নানা রেস্টুরেন্টে যা দেখি, কিছু কিছু মেয়ের আচরণে, কথায়, চলাফেরায় দায়িত্বশীলতা, ব্যক্তিত্ব খুবই অনুপস্থিত।

একবার দেখেছিলাম আনন্দের এক পর্যায়ে বিএফ এর কোলে উঠে গেছে একজন! হাসাহাসি, চিৎকার, সেলফি তোলা!! প্রেমিকের থাই, বুকে হাত রেখে কথা বলে অনেক মেয়েই! স্পর্শ এতো সস্তা হবে কেন?

বিয়ে করে দুই বাচ্চার মা হয়ে গেলেও তো পাবলিক প্লেসে স্বামীর পাশে লাজুকতা, নম্রতা, ভদ্রতা নিয়ে থাকা উচিৎ!

পাব্লিক প্লেস যে বেড রুম না এই কমন সেন্সই নাই অনেক কাপলের মধ্যে!

এই চিত্র আমাদের কাছে কি অস্বাভাবিক লাগে?  লাগে না। আমরা যারা খুব backdated কিংবা so called ‘আধুনিকনা তারা আনইজি ফিল করি এসবের উপস্থিতিতে, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ মেনে নেয়।

ছেলেমেয়ের এই ধরনের চলাফেরায় তাদের আপত্তি হয় না,  কিন্তু আপত্তি আসে যদি সেক্স এডুকেশনের কথা বলি! যদি পর্নের নেতিবাচক ভূমিকা নিয়ে কথা বলি!

প্রেমিকাকে পর্নের নায়িকার সাথে তুলনা করার মানসিকতা একজন প্রেমিকের যদি হয়- এটা যে কী পরিমাণ অসুস্থতা তা কি যে অসুস্থ সে বুঝবে? বুঝবে না। তার কাছে এটাই স্বাভাবিক লাগছে!

কারণ পর্নে এতোই আসক্ত যে প্রেমের সংজ্ঞা, প্রেমিকার স্থান সে  ভুলে গেছে! প্রেম হয়ে গেছে শরীর সর্বস্ব! এসব প্রেম কি পরিনতি পায়? পায় না।  

সম্পর্কে প্রাকৃতিকভাবেই আদর জন্মায়, ভালোবাসা, মায়া, টান থেকে…  এখানে প্রেমিকার হাতের নখ মুখ্য থাকে না,  রান্না করতে যেয়ে হলুদ লেগে নখ হলদে হয়ে গেলেও তা ভাল লাগে…  সেই হাত ধরে হাঁটতেই স্বর্গসুখ অনুভব করে…

আর পর্নো দেখতে দেখতে যা  আসে তা আরোপিত,   

হৃদয়, ভালোবাসা, মায়া অনুপস্থিত এখানে, শুধু  শরীরের প্রতি এবনরমাল আসক্তিই এখানে প্রাধান্য পায়। আর যা কিছু অস্বাভাবিক, তা কখনই ইতিবাচক কোন ফল দিতে পারে না…

প্রেমের প্রতি মূল্যবোধের, দৃষ্টিভঙ্গির এই ভয়াবহ অবক্ষয়ের পরিণতি কী- তা কি কেউ ভাবি?

ভাবি না।  

এখন ছেলেমেয়ের প্রেমের  যা চিত্র তাতে ওরা অনেক বেশি ফ্রি। এই ফ্রিনেস অনেক কিছুর প্রভাবক হতে পারে। ভুল করে ফেলতে পারে। আর্লি প্রেগনেন্সির শিকার হতে পারে কোনো মেয়ে! হচ্ছেও। অন্তত হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর রিপোর্ট তাই বলে।

আবেগের বশে কে কী করবে তা কে জানে? নিজেকে প্রটেক্ট করার জন্যই সেক্স এডুকেশন জরুরি। একবার ওষুধ কিনতে গেছি। বাচ্চা এক ছেলে এসে emergency contraceptive pill কিনে নিল!  বাবার বয়সী দোকানদার দিয়ে দিল! এখানে কাকে দোষী বলবেন? ছেলেকে? নাকি মধ্য বয়সী দোকানদারকে?

emergency contraceptive pill এর অন্যান্য সাইড ইফেক্ট কী? যে খাচ্ছে সে কি জানে? এর ফলে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি যে বাড়ে এই জ্ঞান তো তার নাই! সে তো দিব্যি নিজের সর্বনাশ করেই যাচ্ছে!

তাই বলি অভিভাবকদের গোঁড়ামি খুব ভয়াবহ একটা ব্যাপার। আমাদের ছেলেমেয়েদের মূল্যবোধের যে এতো ভয়াবহ অবক্ষয়, তার জন্য পরিবার কি কম দায়ী? বিজ্ঞাপনগুলো খেয়াল করেন। টথপেস্ট বলেন আর সাবান বলেন সবকিছুতেই প্রেম আর সেই প্রেমের ইঙ্গিত শরীর সর্বস্ব!

নাটক এর শিরোনাম হচ্ছে, ‘কাছে আসার গল্প!’

বাচ্চারা কই যাবে?   

আতিকুল হক চৌধুরী, সেলিম আল দীনরা এখন নাই। ‘পারলে না রুমকি’, ‘বাবার কলম কোথায়’ এর মতো নাটক হয় না এখন। কাজেই এই বাস্তবতা মেনে নিতে হবে।  

যারা সেক্স এডুকেশনের বিরোধিতা করেন, তাদের না বলাকে আমি সম্মান জানাই।

বিরোধিতাকারীদের বলবো- তাহলে নিজেরা নিজেদের পরিবারে সচেতনতা বৃদ্ধি করেন। মেয়ে সন্তানকে নিয়ে মা বসেন, ছেলেকে নিয়ে বাবা। ছেলেমেয়ের মেলামেশা আটকানো সম্ভব না। চেষ্টা করলে হিতে বিপরীত হয়। কাজেই ইতিবাচকভাবেই পরিবারের সিনিয়রদের উচিৎ বাচ্চাদের আলাপে আগ্রহী করে তোলা

আর পর্নের নেতিবাচকতার ব্যাপারেও পরিবারকে সচেতন হতে হবে। দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে পড়েছিলাম, ইউকে তে  অনলাইন পর্নের দর্শকের উপর সার্ভে করে দেখা গেছে, ১১ বছর বয়সী ভিউয়ার আছে! খুব এলারমিং কিছু অবস্থা তুলে ধরেছিল ঐ প্রতিবেদনে।

পর্নের মেয়েদের বুক ন্যাচারাল না,  surgically enhanced breasts থাকে ওদের, পিউবিক হেয়ার থাকেই না- ছেলেরা ঠিক এমন লুকই নিজেদের পার্টনারের থেকে প্রত্যাশা করে। আবার মেয়েরা বলেছে, তারা  পর্ণের নায়িকাদের মতো থাকার ব্যাপারে একটা প্রেশার ফিল করে নিজেদের উপর, ব্যবহারেও তেমন একটা ঢংআনার চেষ্টা করে!

আমাদের যদি সার্ভে করা যেত চিত্র খুব একটা এদিক-ওদিক হতো বলে মনে হয় না। অল্প বয়সী মেয়েদের আচরণ খেয়াল করেছেন? ওদের কি বাচ্চা মনে হয়? মনে হয় না। কাজেই পরিবারের সকলে পর্নের নেতিবাচকতা নিয়ে সচেতন হওয়া এখন সময়ের দাবি।

শেষ করছি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প সমাপ্তির শেষ লাইন দিয়ে–

ভগ্নী চলিয়া গেলে অপূর্ব অন্ধকারে সাবধানে খাটের অভিমুখে গেল। খাটে প্রবেশ করিতে উদ্যত হইতেছে এমন সময়ে হঠাৎ বলয়নিক্বণশব্দে একটি সুকোমল বাহুপাশ তাহাকে সুকঠিন বন্ধনে বাঁধিয়া ফেলিল এবং একটি পুষ্পপুটতুল্য ওষ্ঠাধর দস্যুর মতো আসিয়া পড়িয়া অবিরল অশ্রুজলসিক্ত আবেগপূর্ণ চুম্বনে তাহাকে বিস্ময়প্রকাশের অবসর দিল না। অপূর্ব প্রথমে চমকিয়া উঠিল, তাহার পর বুঝিতে পারিল, অনেক দিনের একটি হাস্যবাধায়-অসম্পন্ন চেষ্টা আজ অশ্রুজলধারায় সমাপ্ত হইল।

এক চুমুর জন্য যে সাধনা অপূর্বকৃষ্ণকে করতে হয়েছিল, তেমনি সাধনা করুক প্রতিটি প্রেমিক তার প্রেমিকার একটি ‘চুমুর’ জন্য। প্রেম হোক হৃদয় সর্বস্ব। প্রেমকে বিয়েতে রূপ দেব, ৫০ বছরের বিয়েবার্ষিকী পালন করবো- এ অঙ্গীকার থাকুক প্রেমেপ্রেমের প্রতিটা স্পর্শ হোক ভালোবাসায়, মায়ায়, সম্মানে আর দায়িত্ববোধে।  

শুভ হোক ভালোবাসাবাসি।

শেয়ার করুন: