নারী- বাঁচুন আনন্দ আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে

রাবেয়া জাহান আভা: একটা কন্যাশিশু থেকে কিশোরী, তরুণী, যুবতী, নারী-এই পর্যায়গুলো পার হতে একজন নারীকে অনেক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কখনো তা অতি আনন্দের, কষ্টের অথবা তিক্ততার। তবে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একজন মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়া মানুষটি তার জীবনে তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবে না-তা কি করে হয়। তা না হলে তো আর সেটা পুরুষশাসিত হলো না।

একজন কিশোর তার শৈশবকাল থেকে যে স্বাধীনতা পেয়ে আসে, কিশোরীর বেলায় তার সিকি অংশও আমরা দিই না। কারণ আমাদের মগজের মধ্যে আছে সে মেয়ে। সব স্বাধীনতা তার সাজে না । ছেলে গর্হিত অপরাধ করলেও তাকে ক্ষমা করা হবে কারণ তারপরেও শুধু ছেলে বলেই সমাজে তার মাথা উচু করে চলতে কোনো বাধা নেই।

রাবেয়া জাহান আভা

তবু মেয়েরা যে নিখাদ ভালোবাসাটুকু পায় তা কেবলমাত্র বাবা-মা’র কাছেই পায়-অন্তত আমার তাই মনে হয়। জীবনে এরপরের পর্বে কি ঘটবে তা তার জানা নেই। আনন্দ নিয়ে বাচার স্বাধীনতাটুকু মেয়েরা কোনদিনই পুরোপুরি পায়না। বাবা মায়ের নিয়মকানুনের মধ্যে যখন ছেলেমেয়ে একসাথে বড় হয় তখন তা যেন মেয়ের জন্যই বেশি প্রযোজ্য। একজন ছেলে তার মেয়েবন্ধুর সাথে কথা বললে, মিশলে বা তাকে ভালোবেসে চিঠি দিলে তাতে কোন আপত্তি নেই কিন্তু একটা মেয়ে তা করলে পরিবার, সমাজ থেকে শুনতে হয় নানা কটুকথা। কিন্তু মানুষ হিসেবে আনন্দ নিয়ে বাচার অধিকার সবার আছে, ছেলেমেয়ে উভয়েরই।

ছেলে এবং মেয়ের বিনোদিত হবার মাধ্যমগুলো সবসময়ই আলাদা-সামাজিকভাবেই। আনন্দ পাবার মাধ্যমগুলো আমরাই ঠিক করে দেই। একটা মেয়েকে ছোটবেলায় যখন পুতুল, বই, টিভি দেখা আর সংসারের কাজের মধ্যে আনন্দ খুজে নেয়ার নির্দেশনা আমরা দিয়ে থাকি তখন একটা ছেলে বাইরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা, ঘুরতে যাওয়া কিংবা বাইরের জগত নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সেটাতে আমরা গর্ববোধ করি। সন্ধ্যার পর একটা ছেলে বাইরে থাকলেও মেয়ের বাইরে থাকতে মানা। এখনকার দিনে আধুনিক প্রযুক্তির ছোয়ায় অনেকটা এগিয়ে গেলেও বাইরে মেয়েরা আজো নিরাপদ নয়, অন্তত আমাদের দেশে।

একজন চাকরিজীবী মেয়ের সারাদিন বাইরে থাকার বা নিজেকে একটু রিফ্রেশড করবার জায়গা থাকলেও একজন গৃহিণী কিন্তু আটকা সারাদিন সংসারের চার দেয়ালের মধ্যে। তবু চাকরিজীবিদেরও পোহাতে হয় নানা ঝক্কি। একজন গৃহিণী যখন খুব যত্নে রান্না করে, ভাবে সে প্রশংসা পাবে, সদস্যরা তার সেই প্রাপ্তিটুকু ‍দিতেও নারাজ কারণ তাতে যদি সে অহংকারী হয়ে ওঠে। তাকে তো ডোমিনেট করা যাবে না। আর এটা করতে একজন পুরুষকে সহযোগিতা করি আমরা নারীরাই। মা বাইরের কাজ করে ছেলে মানুষ করেছেন তাতে আমার মা মহৎ।

ছবিটি রাজেশ্বরী প্রিয়রঞ্জিনীর আঁকা

কিন্তু বউ বাইরে যাবে, সেক্ষেত্রে সে কেন ছেলেদের মতো আচরণ করবে? বাচ্চা জন্ম দাও, মানুষ করো প্রতিটা দিন কষ্ট করে কারণ তুমি মা তোমাকে কষ্ট করতে হবে। কিন্তু এই বাচ্চাকে নিয়ে আনন্দের অধিকারটুকু শশুরবাড়ির কারণ সে তাদের রক্ত, তাদের বংশের প্রদীপ, এখানেই আনন্দ পায় তারা আসলের চেয়ে সুদের। আর সেই সন্তান জন্মের সময় বা তার পরের দায়িত্বটুকু মেয়ের মায়ের বাড়ির কারণ তারা তা করতে বাধ্য নিজের মেয়ের মঙ্গলের জন্য। তবে এর মধ্যে কোন কোন মেয়ে একটু ভাগ্যবানই বটে তারা শ্বশুরবাড়ির খেদমত পান। তাদের সংখ্যা আমার জানা মতে নিতান্তই নগণ্য।  

একজন মেয়ে অফিস কিংবা ঘরে সারাদিনের ক্লান্তি শেষে যখন ‍টিভিতে একটু সিরিয়াল দেখে তখন সে কয়েক ঘন্টায় শিখে যায় রাজ্যের কুটনামী। আর তাতেই রো রো পড়ে যায় পুরুষসমাজে। তবে আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতায় এই কুটনামীর মজা কিন্তু অনেক পুরুষই ইতিমধ্যে পেয়ে গেছেন। আমি নিজেই দেখেছি অনেককে যারা এর তীব্র বিরোধিতা করলেও এক সময় তারা নিজেরাই এর প্রতি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।

আধুনিক প্রযুক্তি সবার। এখানেও যখন একজন পুরুষ সারাদিন ফেসবুক ব্যবহার করছেন তখন সেটা অফিসিয়াল বা পড়াশোনার কাজে কিন্তু নারী ফেসবুকে মানে চাকরিজীবি হলে অফিসের কাজ বাদ দিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন আর গৃহিণী মানে ঘরের কাজ, বাচ্চার যত্ন বাদ দিয়ে পরকীয়া বা আড্ডা দিচ্ছেন। আসলে নারীর একা তার ‍নিজস্ব আনন্দ পাবার আলাদা করে কোন জায়গা নেই। অপ্রাপ্তবয়স্ক কিংবা একজন তরুণীর এই স্বাধীনতা সংকুচিত করা হয় মূলত নিরাপত্তার প্রশ্নেই।

একজন বিবাহিত নারী মানেই যেখানেই যাও তার স্বামীকে বাদ দিয়ে নয়। অথচ একজন স্বামী কিন্তু সারাদিন ও রাতের অনেকটা সময়ই কাটান বাইরে। দুদিন আগে যখন দেশীয় একটা পত্রিকা জানালো যে, তারানা হালিম দেশের সব পর্ণোসাইটে প্রবেশকারীর নামের তালিকা প্রকাশ করবেন, অমনি লেগে গেল হুড়হাঙ্গামা। আমি ফেসবুকে যতো পুরুষ ভাইদের আহাজারি দেখেছি বিভিন্নভাবে, দু’একজন ছাড়া এ নিয়ে নারীদের তেমন কোন মন্তব্যও দেখিনি।

কারণ ‍কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত অনেক পুরুষ এই পর্নো সাইটের দর্শক। কাজেই তাদের নাম প্রকাশ হয়ে গেলে তো সর্বনাশেরই কথা। অথচ এর কুফল হিসেবে আমাদের কিশোর, তরুণরা যে কী পরিমাণ ভয়াবহ ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে, তাতে একবারের জন্য হলেও নিজের সন্তানের কথা ভেবে নাম প্রকাশ না হলেও পর্নোসাইট বন্ধে তাদের সুপারিশ করা উচিত ছিলো।

তাদেরকে এর চেয়েও বেশি সোচ্চার হতে দেখেছি যখন দেশে ভারতীয় চ্যানেল বন্ধের কথা এসেছিলো। কারণ সন্তানের কুপথে যাওয়ার চেয়ে বউজাতির কুটনামি শেখাটা তাদের জন্য অনেক বেশি অশান্তির। গতকাল অবশ্য তারানা হালিম কথাটি বলেননি বলে তার ফেসবুক পেজে স্ট্যাটাস দিয়েছেন।

অথচ থাইল্যান্ডে আসার পর আমি যে কোন বয়সের যতজন নারীকে দেখেছি প্রত্যেকেই বাঁচেন নিজের মতো আনন্দ আর আত্মতৃপ্তি নিয়ে, যা ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য খুব জরুরি। নিজে ভালো না থাকলে কাউকে ভালো রাখা সম্ভবও নয়। আমাদের দেশে নারীরা এই আনন্দটুকু পায় না বলে অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

অথচ আমাদের সমাজ, সংসারে একজন নারীর আনন্দের সবটুকু শুষে নিয়ে তাকে আসবাবপত্রের মতোই বানিয়ে ফেলে। আমার ছোট্ট একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। দেশে থাকতে আমার কাজের একজন সাহায্যকারী থাকলেও এখানে এসে আমি মোটামুটি প্রথম কয়েকমাস দুই বাচ্চা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলাম। ঘরের কাজ একা হাতে করা আর বাচ্চাদের পেছনে সময় দিয়ে আমার নিজের জন্য কোন সময় ছিলো না। বাচ্চারা দু’জনই ছোট। বর পড়তে এলেও যথেষ্ট সাহায্য করেছে। বিদেশে আসলে সবাইকেই এ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সবাই ব্যস্ত। কারো সময় নেই কারো দিকে তাকাবার। বাচ্চাদের সাথে হাসি আনন্দে সময় কাটলেও আমি আসলে একসময় বিষন্নবোধ করতে শুরু করি।

আমার মনে হতে থাকে স্বামী, সন্তান আর সংসারের বাইরে আমি কেউ না। আমার অস্তিত্ব শূণ্য। সংসারের প্রতিদিনের ক্লান্তি আমাকে ঘিরে ধরে। আমি সত্যিই অসহায়বোধ করতে শুরু করি। জীবনের প্রতিটি ধাপই মনে হয় এমন একঘেয়ে আর ক্লান্তিকর।

বর বিষয়টি বুঝতে পেরে একদিন এখানে ফিলিপিনো এক মহিলার একটা এক্সারসাইজ ক্লাসের লিঙ্ক দেয়। ক্লাসটি এক ঘন্টার জন্য এবং সপ্তাহে তিনদিনের। এটা মূলত সবার জন্য তবে যারা এখানকার স্টাফ বা স্টুডেন্ট তারাই বেশি অংশ নেন। প্রথম দিন ক্লাসে গিয়ে দেখি, ক্লাসটি এক্সারসাইজের হলেও তা আসলে মিউজিকের সাথে। আমার বাংলার ভাইবোনের কথায় নাচের ক্লাস। তো যে আমি স্কুল, কলেজে গান একটুআধটু করলেও নাচের ’ন’ টাও জানিনা আবার এখানকার স্টুডেন্ট না তার জন্য এই সাহস করা তো সমালোচনারই বটে। আবার তেমন মেদও নেই শরীরে। কাজেই আমার জন্য ওখানে যাওয়া তো বাহুল্য ছাড়া কিছু নয়। তবু আমি যাই।

যাদুমাখা হাসিতে এই মহিলা প্রথমদিনেই সবাইকে মাতিয়ে দেয়। উনার কথা, এখানে কেউ এক্সপার্ট নন বরং আমাকে মিরর ভেবে জাস্ট কপি করুন। আমরা সবাই তাই করতে থাকি। আমি প্রতিসপ্তাহেই যেতাম। মেরিলিনের ওই উৎসাহমাখা হাসিতে যেন আমি সত্যি অর্থেই আত্মবিশ্বাস ফিরে পাই, নতুন করে বাচার, আনন্দ নিয়ে। আমার মনে হয় জীবনে যত কাজ করেছি (শুধু পাঠ্যবই পড়া ছাড়া, কারণ ওখানে কোন আনন্দ পাইনি) খুব একাগ্রতার সাথে করার চেষ্টা করেছি, সততা নিয়ে। কাজেই এখানেও আমি ক’দিনেই মেরিলিনের খুব প্রিয় হয়ে উঠি, বন্ধুও। আমি নিজের ভেতর অনেকদিনের হারানো এক আত্মবিশ্বাস খুজে পেয়েছি, সাথে ইচ্ছাশক্তিটাও।

অনেকদিন আমি আর ওখানে যাই না কারণ আমার সন্তানদের এখন ওই সময়টুকুও চাই। বিকেল বেলা ওদের খেলার বন্ধুর পাশাপাশি মাকেও তাদের দরকার। আমি এখন খুঁজে নিয়েছি নতুন আনন্দ, লেখার আনন্দ-যা আমি দশ বছর আগে ফেলে এসেছিলাম। তাই প্রতিটি নারীকে আমি বলতে চাই জীবন বড় অদ্ভুত, ফিরে আসে নতুনভাবে।

আত্মবিশ্বাস বা ইচ্ছাশক্তি হারানো নয়, বরং যে যেই অবস্থানেই থাকুন না কেন, তার মধ্যে আনন্দ খুঁজে নিন। বাঁচার আনন্দ, জীবনের প্রতিটি ক্ষণকে উপলব্ধির আনন্দ। হোক না সেটা রান্না, সেলাইয়ের কাজ, প্রার্থনা, বই পড়া, টিভি দেখা বা ফেসবুকিং করা। শুধু তাতে যেন অন্যায়টুকু না থাকে, যাতে প্রশ্নবিদ্ধ হন নিজেই, বিবেকের কাছে।

শেয়ার করুন: