একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশ

শাশ্বতী বিপ্লব: সাঁওতালের ঘরে কেন আগুন দেয় পুলিশ? বাল্য বিবাহ আইনের সংস্করণ করে মেয়ে শিশুদের আরো সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেয়া হয় কেন? নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনে কেন বদলে যায় চিরচেনা নৌকা প্রতীক? কাদের সন্তুষ্ট করার জন্য এতো আয়োজন?

একটি শক্তিশালী বিরোধী দল দরকার আজ বাংলাদেশের, ভীষণ দরকার। এলেবেলে বা মতলব বাজ বা শখের বিপ্লবী মার্কা নয়। একটি শক্ত মেরুদণ্ডসহ দেশপ্রমিক বিরোধী দল আর একজন সুদক্ষ বিরোধী দলীয় নেতা, যাকে মানুষ বিশ্বাস করবে, আস্থা রাখবে। নইলে আওয়ামী লীগে ভর করে যে ঘূণপোকারা ফুলে ফেঁপে উঠছে সুকৌশলে, তারাই গিলে খাবে পুরোটা মানচিত্র। সেই সর্বনাশ থেকে দেশটাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।

আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। আসছে বিজয় দিবসও। কিন্তু মনটাকে ঠিক বিজয় উদযাপনের জন্য তৈরি করতে পারি না। কীসের যেনো খুঁতখুঁতানি, অশান্তি বিঁধে থাকে মনে।

বদলে যাচ্ছে আমার দেশ। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ৭ শতাংশ, সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী চার বছরে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে আরো কয়েকটা ধাপ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি বিশ্বের কাছে বিস্ময়, বিশ্ব রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে বাংলাদেশের নেতৃত্ব। ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে নগরের চেহারা, বদলে যাচ্ছে গ্রামও। দেশটাকে নিয়ে গর্ব করার মতো এমন  অনেক কিছুই ঘটে চলেছে নীরবে ও প্রকাশ্যে। উন্নতিটা খোলা চোখেই বোঝা যায়, অর্থনীতিবিদ বা গবেষক হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

কিন্তু এই পোড়া চোখে আরও অনেক কিছুই যে দেখা যায়। দেশটার অসাম্প্রদায়িক চেহারাটা বদলে যাচ্ছিলো ৭৫ এর পর থেকেই। এখন আওয়ামী লীগেও এর আত্মীকরণ চলছে। বদলে যাচ্ছে ভাষা, অবয়ব আর সংস্কৃতি। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির যে বিষবাষ্প ছড়িয়েছিলো চল্লিশের দশক জুড়ে, এতো পোড়া, এতো ঘা, এতো মৃত্যুর পরও সেই ধর্মের লেবাসটাকে অস্বীকার করতে পারছে না আজকের বাংলাদেশের রাজনীতি।

দুঃখজনক হলেও সত্যি, জামাতের প্রতি কঠোর মনোভাব সত্ত্বেও আওয়ামী লীগেরই জামাতীকরণ ঘটছে খুব সুকৌশলে। ধর্মকে, বলা ভালো, ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করতে শুরু করেছে আওয়ামী লীগ, আছে হেফাজতিদের সমীহ করে চলার মনোভাবও। নাস্তিকতার ধোয়া তুলে একের পর এক হত্যার প্রতি, হিন্দুদের উপর সহিংসতার প্রতি নীরব ও সরব সমর্থন রয়েছে অনেক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীর।

সংখ্যালঘুদের, ভিন্ন মতালম্বীদের সুরক্ষা দিতেও খুব একটা কঠোর হতে দেখা যায় না। নিজেদের সাচ্চা মুসলমান প্রমাণে মরিয়া আওয়ামী লীগের একটি অংশ। অনেকেই মনে করে দেশটা কেবল মুসলমানের। নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনী প্রচারণায় নৌকা প্রতীকের ইসলামীকরণ তারই নগ্ন প্রকাশ। নারায়ণগঞ্জের অন্য ধর্মাবলম্বীরা এই প্রতীক থেকে কতটুকু আস্থা পেলো কে জানে?

জামাতের রাজনীতিতে সুবিধা করতে না পারা নেতা কর্মীরা আর মনে মনে পাকিস্তান পুষে রাখা রাজাকারদের সন্তান ও অনুসারীরা যার যার এজেন্ডা নিয়ে পঙ্গপালের মতো ঢুকে পড়ছে আওয়ামী লীগে। জয় বাংলার নীচে ঢুকে পড়ছে নারায়ে তাকবীর, মুজিব কোটের নীচে কাবলী পায়জামা, লাল সবুজের নীচে চাঁন তারা।

পরিবর্তনের দু’টি ভিন্নমুখী স্রোত তীব্রবেগে ছুটে চলেছে বিপরীত দিকে। অর্থনৈতিক অগ্রগতি বনাম সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয়। একদিকে আলোর ঝলকানী, অন্যদিকে অন্ধকারের হাতছানি। শুধুমাত্র একটি আলোর দিকে মনোযোগী হলে অন্ধকার ঘুচবে কেন? সবটা মিলেই তো বাংলাদেশের পরিচয়, সবটা মিলেই উন্নতি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের আলোটা জ্বালিয়ে রাখা যেমন জরুরি, পাশাপাশি মনের অন্ধকার দুর করার উদ্যোগ নেয়াটাও জরুরি।

জানেন তো, আলোর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে অন্ধকারটাকে ভালো দেখা যায় না। আর দেখা যায় না সেই সুযোগে ওঁৎ পেতে থাকা বিপদকেও। অন্ধকারটাকে দূর করা না গেলে এককভাবে এই আলোরও কোনো মানে থাকবে না।

বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনক্শা কতটা সফল তা আজকের বাংলাদেশের মানুষের পোশাক, চিন্তা, হিংস্রতা, সাম্প্রদায়িকতার প্রকট প্রকাশ দেখলে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়।

বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে, বিচার হয়েছে বুদ্ধিজীবী হত্যারও। প্রধান প্রধান যুদ্ধাপরাধীদেরও শাস্তির ব্যবস্থা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল সক্রিয় আছে, একের পর এক বিচার চলছে। কিন্তু এর মাঝে ওই রাজাকার, আলবদর, আল শামসদের উত্তরসূরিরাও ঝাড়ে বংশে বেড়েছে অনেক। অসংখ্য মানুষ আত্মস্থ করে নিয়েছে ভুল মৌলবাদী আদর্শ, বিশ্বাস। গুলিয়ে ফেলছে অসাম্প্রদায়িক বাংলার চেতনার সাথে।

শাশ্বতী বিপ্লব

এই মানুষগুলোকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার যুদ্ধটা এবার লড়তে হবে বাংলাদেশকে। এবং এই যুদ্ধটা কঠিনতম নিঃসন্দেহে। একাত্তরের চেনা শত্রুকে বধ করা গেছে, কিন্তু এখন শত্রু-মিত্রর আলাদা কোন মুখ নেই, তারা এক ও অচেনা।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শক্ত হাতে হাল ধরে আছেন এখনো। কিন্তু শেষ রক্ষা হবে তো? উনাকেই তো মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র চলছে সারাক্ষণ। এই যে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে আওয়ামী সমর্থকের চেহারা, তার কতটুকু খোঁজ রাখা সম্ভব উনার পক্ষে? একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বার্থে, সংস্কৃতির স্বার্থে, উন্নয়নের ধারাকে ধরে রাখার স্বার্থে, সর্বোপরি আওয়ামী লীগকে জামাতীকরণ থেকে বাঁচানোর স্বার্থে একটি শক্ত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দরকার। যারা বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করবে, সরকারের ভুলকে চ্যালেঞ্জ করতে যাদের জনসমর্থনের অভাব হবে না। যদিও তেমন বিরোধী দল এবং বিরোধী নেতা আপাতত অলীক স্বপ্ন বলেই মনে হয়

শেয়ার করুন: