শান্তা মারিয়া: ফেইসবুকে ছবিটির বেশ ইতিবাচক প্রচারই দেখেছি। গানগুলো শুনেও বেশ ভালো লেগেছিল। কিন্তু ছবিটি দেখে মেজাজটা তেতো হয়ে গেল। বলছি হাল আমলের ‘প্রাক্তন’ ছবিটির কথা। সেই একই পুরুষতন্ত্রের ‘ভালো নারী’ বনাম ‘ক্যারিয়ার নারী’র ধারণামার্কা ছবি। যারা দেখেছেন তারা তো জানেনই। যারা দ্যাখেননি তাদের জন্য গল্পটি সম্পর্কে একটু ধারণা দেই।
ট্রেনের কামরায় সুদীপার (ঋতুপর্ণা) সহযাত্রী হয় মালিনী ও তার শিশুকন্যা পুতুল। আলাপের একপর্যায়ে সুদীপা জানতে পারে মালিনী হলো তারই প্রাক্তন স্বামী উজান মুখার্জির(প্রসেনজিৎ) স্ত্রী। এরপর টুকরো টুকরো ফ্ল্যাশ ব্যাক ও বর্তমান সময়ের মধ্য দিয়ে এগোয় সিনেমা। কলকাতার ট্যুর গাইড উজানের সঙ্গে আর্কিটেক্ট সুদীপার ডিভোর্সের মূল কারণ হলো, সুদীপার ক্যারিয়ার নিয়ে ব্য¯Íতা এবং উজানের অবহেলা। উজান সুদীপাকে সময় দিতে পারেনি।
যদিও ছবিতে দেখা যায় উজান এখন তার স্ত্রীকে বেশ কেয়ার করে, তার জন্মদিনে সারপ্রাইজ দিতে হঠাৎ করে ট্রেনে চলে আসে। মালিনী তার স্বামী, শ্বশুরবাড়ি, জা,ননদ, শাশুড় সবাইকে বেশ ম্যানেজ করে রেখেছে। মালিনী টিপ্যিকাল গৃহবধূৃ। সে কনসিভ করার পরই চাকরি ছেড়েছে। শ্বশুরবাড়ির সবাইকে তোষামোদ করে চলে। নিজে অনবরত কথা বলে এবং টিভি সিরিয়ালের ভক্ত। সে আবার সুদীপাকে উপদেশ দেয়, কম্প্রোমাইজ করে চলতে। তাতে নাকি জয়ই হয়। সুদীপাও ডায়লগ দেয় যে, মালিনীর কাছ থেকে সে অনেক কিছু শিখেছে। মালিনী তার স্বামীর চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। সেটাও নাকি তাদের সুখী দাম্পত্যের একটা কারণ।
মোদ্দা কথা, ‘প্রাক্তন’ এই ধারণাই দেয় যে, মালিনী প্রেগনেন্সির সময় চাকরি ছেড়েছে বলে তার বাচ্চা বেঁচে আছে। সুদীপা চাকরি করেছে তাই তার অ্যাবরশন হয়েছে। মালিনী শ্বশুরবাড়ির সবাইকে ম্যানেজ করতে পেরেছে কিন্তু সুদীপা মানিয়ে নিতে পারেনি। ট্রেনে উঠেও মালিনী তার শ্বশুরবাড়ির সবাইকে মোবাইলে ফিরিস্তি দেয় মেয়েকে কী কী খাওয়াবে, কম্বল আছে কীনা ইত্যাদি।
অন্যদিকে সুদীপা বাবার বাড়ি যাওয়ার আগে শাশুড়ি ও স্বামী কারও অনুমতি নেবার কথা ভাবেনি। মালিনী হানিমুনে যাবার জন্য কয়েক বছর অপেক্ষার পর তারপর স্বামীর রোজগারের টাকায় কাশ্মীর বেড়াতে গেছে। অন্যদিকে সুদীপা নিজের রোজগারের টাকায় কাশ্মীরে বেড়ানোর ব্যবস্থা করেছে, যা তার স্বামীকে অপমান করার সামিল। সুদীপা আর উজান ছিল কাছাকাছি বয়সের। তাই তাদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সংঘাত হয়েছে। আর মালিনী বয়সে অনেক ছোট, তাই তার সাথে অ্যাডজাস্টমেন্ট ভালো হয়েছে (তার মানে তার উপর ডোমিনেট করা সহজতর)।
উজান জানায়, সে এখন বাজার করে। এটা মালিনীর কৃতিত্ব, যে তাকে দিয়ে বাজার করাতে পারছে। যেন পুরুষের হাতে বাজারের ব্যাগ ধরিয়ে দিতে পারাটাই নারীর জীবনের চরম কৃতিত্ব।
সুদীপার প্রমোশনের খবরে উজানের প্রতিক্রিয়া যে, হয়তো বসের সঙ্গে তার দৈহিক সম্পর্ক রয়েছে। এটি ছিল ছবির সবচেয়ে ক্লিশে ডায়লগ।
সুদীপা নিজস্ব ফ্ল্যাট কিনতে চেয়েছে। কিন্তু মালিনী শ্বশুর বাড়িতেই মহাখুশি।
শেষ পর্যায়ে দেখা যায়, সুদীপা নিজের ট্র্যাভেল ব্যাগ নিজে বহন করতে যায়, কিন্তু উজান এগিয়ে এসে তাকে সাহায্য করে। তার মানে পুরুষের সাহায্য শেষ অবধি নারীকে নিতেই হয়। শেষ দৃশ্যে দেখা যায় সুদীপাকে নিতে স্টেশনে তার নতুন স্বামী এসেছে। তার সঙ্গে চলে যাবার সময়ও ফিরে ফিরে উজানের দিকে তাকাতে থাকে সুদীপা। এর অর্থ মেল শোভেনিস্ট এবং সেদিক থেকে খাঁটি পুরুষ উজানকেই তার বেশি পছন্দ ছিল।

মুভিটি দেখার পর মনে হলো এর চাইতে বোধহয় ‘মুন্নি বদনাম হুয়ে’ মার্কা নাচগানের ছবিও ভালো। ওসবে অন্তত খোলাখুলি পুরুষের ‘মর্দাঙ্গি’র পরিচয় থাকে। শরীর-স্বাস্থ্য ভালো এমন সব পুরুষের চেহারা সুরত সেখানে দেখা যায়। আর ‘প্রাক্তন’ এ যা পেলাম তা হলো সুগারকোটেড পুরুষতন্ত্রের সবক। তুমি মেয়ে হয়ে চাকরি বাকরি করতে পারো কিন্তু ক্যারিয়ার গড়বে? অফিসের হেড হবে? অফিসের কাজে তোমার বাড়ি ফিরতে দেরি হবে? তাহলে তো মেয়ে সংসার তোমার দ্বারা হবে না। যদিও হয় তাহলেও ‘মাচো ম্যান’ তুমি পাবে না। তোমার জুটবে ‘ঢেড়স মার্কা’ নিরামিষ পুরুষ।
আর তুমি যদি ‘প্রকৃত নারী’ হতে পারতে, ধৈর্য্য ধরতে পারতে, স্বামীর স্বল্প উপার্জনেই সুখী হতে পারতে, কম্প্রোমাইজ( নিজের ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন অর্থে নিতে হবে) করতে পারতে তাহলে তুমিও এখন সুখী মার্কা চেহারা করে স্বামীর সঙ্গে আহ্লাদ করতে পারতে। হায়, ক্যারিয়ারের মোহে তুমি কি হারাইয়াছ তুমি জানো না।
অবশ্য এক হিসেবে ‘প্রাক্তন’ সঠিক বার্তাটিই দিয়েছে! টিপ্যিকাল পুরুষের আসলেই ‘পুতুপুতু মার্কা’ নির্বোধ পোষমানা মালিনীকেই দরকার, ট্যালেনটেড সুদীপাদের তারা পছন্দ করে উঠতে পারে না। বিয়ে করলেও হজম করতে পারে না।
নন্দিতা রায় এবং শিবপ্রসাদ মুখার্জি জুটির প্রথম ছবি ‘বেলা শেষে’ তে তারা কিছু প্রাথমিক চমক দিয়ে শেষ পর্যন্ত পুরুষতান্ত্রিক সনাতন ‘নারী-পুরুষের সম্পর্ক’ এর গÐীর মধ্যেই আবদ্ধ ছিলেন। দ্বিতীয় ছবিতে তারা আরও ক্লিশে কিছু চিন্তাভাবনা নিয়ে এলেন। সুগারকোটেড এই পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনাগুলো আর কতদিন অনেক মানুষের মনোজগতে রাজত্ব করবে কে জানে!