তাহমিনা দিলসাদ: Mirror Mirror on the wall, who’s the fairest of them all?
জনমভর শুনে এসেছি, আমি কালো। আমিও জানতাম এটাই বুঝি আমার খুঁত। কিছুদিন পর বের হলো, আমি শুধু কালোই নই, আমি বেজায় মোটাও। আমার কাছে এটা খুব বেশি বড় সমস্যা ছিল না। আমি খেতে বরাবরই ভালবাসি। আমার মায়ের কাছেও মোটা কোন সমস্যা মনে হতো না, কারণ তিনি খাওয়াতে ভীষণ ভালবাসেন।
তবে আমার গায়ের রঙ নিয়ে তিনি বরাবরই চিন্তিত। আমার অন্য বোনদের মতো গায়ের রঙ না। তার উপর আমি আবার একটু গেছো ব্যাটাছেলে টাইপের (ছোট বেলায় আমার জন্য বহুল ব্যাবহৃত বিশেষণ) ।
আমার মেধা আমার রঙের উপর কখনোই জিততে পারেনি। ভীষণ রকমের ভালো ছাত্রী হবার পর ও আমি কালো এটা আমার পরিচয় ছিল। কেউ আমার সম্পর্কে বলতে গেলে বলতো-
ম্যানেজার সাহেবের মোটা মতো কালো মেয়েটা আছে না, সে নাকি…

আমার নিজের কানে শোনা। আমি তখন মনে হয় ভালো করে টের পাই, আমি কালো, আমি কালো।
আমার দাদীর বরাবরই মন খারাপ হতো আমার গায়ের রঙের জন্য। আমাকে কোন ব্যাটা বিয়ে করবে! বিয়েতে কী পরিমাণ যৌতুক লাগবে, ভেবে প্রায়ই দাদী আমাকে গায়ে এটা-সেটা মাখতে বলতেন। কোন রকমে যদি একটু সাদা হওয়া যায়। আহ! একটু সাদা!
আমাকে প্রথম যখন ফেয়ারনেস ক্রিম কিনে দেয়া হলো, আমি ভীষণ অপমানিত হয়েছিলাম। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। এরপর আমি মেলা চেষ্টা করেছি, একটু সাদা হবার। কত নামি দামী ক্রিম আমি নিজে কিনে এনেছি, বলাই বাহুল্য।
আমি সাদা হতে চাই, সাদা.. স্রষ্টার সাথে আমার যুদ্ধের শেষ নাই….আমি নিজে যেন এক গোলক ধাঁধায় পরে গেছিলাম, আমার কানে আমার দাদীর সেই কথা সব সময় বাজতো,
পড়াশোনা দিয়ে কী হয় বইন! গায়ের রঙটাই আসল!
তারপর পার হয়েছে অনেক সময়, আমি চোখ খুলে পৃথিবী চিনতে শিখেছি, আমি আমার ছোট্ট গণ্ডি পেরিয়ে ঢুকে পরেছি নতুন দিনের আলোয়, একবিংশ শতাব্দী! আমার দাদীর জমানা পার হয়ে আমার জমানায়। অতি আধুনিক, সংস্কৃতি ঘেরা আমার চারপাশ। দাদীরে দেখানো হয় নাই … কালো মেয়ের নতুন গতিময় জীবন।
ডাক্তার মেয়েটির জন্যে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে পরিচিত এক আন্টি…মেয়ে একটু পরেই আসবে, মেয়ের মা চলে এসেছেন একটু আগেই রেস্টুরেন্ট এ। ছেলে মেয়ের মাকে দেখামাত্রই জানিয়ে দিলেন, তিনি পাত্রী দেখতে চান না। কেন? কী হয়েছে?
মেয়ের মায়ের দিকে তাকাচ্ছো না কেন? কী ভীষণ কালো! মেয়ে নির্ঘাত এমনই হবে। আরে নাহ! মেয়ে পরীর মতো সুন্দর, ঘটক আন্টির চটজলদি উত্তর।
তাতে কী! এই কালো মায়ের রক্ত তো আছে, পরবর্তিতে বাচ্চা-কাচ্চা কালো হতে পারে!
আমি শুধু ঘাড় ঘুরিয়ে সুপাত্রটার মুখ দেখে নিলাম! কালো মেয়ের বিয়ে না হবার অনেক ঘটনা আমার জানা আছে, কালো মায়ের মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া সেদিনই প্রথম দেখলাম।
ঘটক আন্টি আর মেয়ের মা চলে যেতেই আরাম করে পিজা খেতে খেতে সু-পাত্র ফোন করে তার বাসায় আপডেট দিচ্ছেন- বড় বাঁচা বেঁচেছি! কালো বংশ গছায়ে দিচ্ছিল বুঝলা ভাবী…….।
কে যে কার কাছ থেকে বাঁচলো!
চাকুরীর জন্যে ইন্টারভিউতে ভালো নাম্বার পাওয়া মেয়েটিকে না নিয়ে অন্য মেয়েটিকে নিতে চাইছেন কেন? ইম্প্রেসান এর ব্যাপার। সুন্দর একটা মেয়ে অফিসে কাজ করলে অফিসের ইমেজ বদলে যায়!
গ্রামে-গঞ্জে কালো মেয়ের বঞ্চনার গল্প আমার অনেক অনেক জানা। শহুরে এই তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের এই কদর্য রুপ !! কিছুই বদলায়নি! কিচ্ছুটি না!
খামোখাই চিল্লাপাল্লা করা, আধুনিক সমাজ! নারীবান্ধব সমাজ! একবিংশ শতাব্দীর সমাজ! একটা মেয়ের মেধা, যোগ্যতা, গুন কোনকিছুতেই তার পরিচয় হয় না।
ঐ যে কালো মতো ডাক্তারটা আছে না….
ঐ যে কালো পুলিশ মেয়েটা……
ঐ যে কালো মেয়ে “বস” টা আছে না,…
যেকোনো নারীর কাজের বর্ণনা দেবার আগে তারে ঠিক এমন করেই বিশেষায়িত করে সমাজ। ডাক্তার,পুলিশ, ইঞ্জিনিয়ার, যাই হোক না কেন…”কালো মতো মেয়েটা”…সেই নব্বইয়ের দশকে আমি যেমনটি শুনেছিলাম!
সেদিন বাসার এক পিচ্চি জিগ্যেস করছে- ঠিক করে বল, আমি কি সাদা? আমি কেন আমার মায়ের মতো সাদা নই? আমি কেমন করে সাদা হবো? এতো অবাক হলাম। বাচ্চা মেয়েটা! ওরে কে বুঝিয়েছে, তুমি কালো!! এ সমাজ কালো মেয়েদের জন্য নয়!
সময় বদলেছে, ভাবনা বদলায়নি। একটুও না! কে ওরে বলেছে-
পড়াশোনা দিয়ে কী হয়! গায়ের রঙটাই আসল!
Mirror Mirror on the wall,
who’s the fairest of them all?