‘নিষিদ্ধ’ বিষয়ে সন্তানের কৌতূহল আপনিই মেটান

সুরাইয়া আবেদীন: সিয়ামদের বাসা সুনসান সবসময়। ধর্মভীরু সিয়ামের বাবা-মা একমাত্র ছেলে সিয়ামকে নিয়েই থাকেন। কোনদিন যে বাসা থেকে গলার স্বর পর্যন্ত শোনা যায় না, সেই বাসায় একদিন শুনি রাগারাগি! ভাঙচুর! পরদিন বুয়া মারফত জানলাম, সিয়ামের মোবাইলে ‘খারাপ’ (!!) জিনিস পাওয়া গেছে, এই নিয়ে বাবা-মায়ের রাগ!!

কী সেই ‘খারাপ’ (!!) জিনিস, বুঝতে বাকি রইলো না। নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ে গেল। সিয়ামের বয়সে স্কুলে পড়াকালীন প্রত্যেক ডিসেম্বরে ছুটিতে নানাবাড়িতে বেড়াতে যাবার রেওয়াজ ছিল আমাদের বাসায়। সেবার গিয়ে দেখি কলেজে পড়া মামাতো বোনের পাঠ্য বইয়ের আড়ালে আরও কিছু বই এমনভাবে রাখা, যা খুব খেয়াল না করলে নজরে পরে না। আমি তখন পর্যন্ত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে আব্বুর এনে দেয়া বইয়ের বাইরে অন্য সাহিত্যের সাথে পরিচিত নই।

আড়াল থেকে বইগুলো বের করলাম। শিরোনাম কী ছিল মনে নেই, মাসুদ রানা নামটি দেখলাম। কেমন বই বুঝছিও না, মাঝখানের কিছু পাতা দেখলাম, এক জায়গায় এক লাইনে চোখ আটকে গেল ‘…স্পর্শে সোহানার শরীরে শিহরণ জাগলো’ হুবহু মনে নেই, তবে এমন কিছু ছিল, যা ওই বয়সে আমার কাছে একদম নতুন কিছু!

শারীরিক সম্পর্ক সম্পর্কে ধারণা দূরে থাক, নারী-পুরুষের কিছুই আমি বুঝি না। ‘শিহরণ’ সম্পর্কে তো জানি, বরফ ধরলে শিহরণ জাগে, কিন্তু সেই সেন্স তো এখানে খাটছে না। একজন ছেলে কোনো মেয়েকে স্পর্শ করলে শিহরণ কেন জাগবে? একটা মেয়ে, এখানে সোহানা, সে কেন অন্যরকম হয়ে যাবে?

এসব প্রশ্নে যখন আমি হতবিহবল, তখন আমার সেই কাজিন ঘরে ঢুকলো! আমার হাতে সেই বই দেখে চিলের মত ছোঁ মেরে নিয়ে গেল, আর বললো, ‘ফুপি তোর হাতে এই বই দেখলে তুই আর আমি কেউ আর কাল সূর্যোদয় দেখতে পারবো না। ফুপিকে খবরদার কিছু বলিস না’।

ঢাকায় ফিরলাম। যেই সময়ের কথা বলছি, তখন বাংলাদেশে নেট এভেইলেবল না, কাজেই আমার কাছে ‘গুগল’ তখন আমার আম্মু আর স্কুলের বিজ্ঞ(!!) বন্ধুরা। প্রথমে আম্মুকে জিজ্ঞেস করলাম একদিন, ‘আম্মু, শিহরণ কী?’ মানে ছেলে মেয়েকে স্পর্শ করলে শিহরণ কেন হবে?’ আমার হাসি পাচ্ছে লিখতে। কী বোকার মতো প্রশ্নই না আম্মুকে করেছিলাম।

আম্মু কিছু একটা বলেছিল, ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানির’ মতো করে… কী বলেছিল আমার আজ মনে নেই। তবে নারী-পুরুষের মধ্যে বাহ্যিক দৃষ্টিতে যা ধরা পড়ে, তার বাইরেও কিছু একটা ব্যাপার আছে, তা আমার মনে প্রথমবারের মতো স্থান পেল। এরপর স্কুলে বিজ্ঞ বন্ধুদের কাছে জানতে চাইলাম।

ওহ আল্লাহ! একেকজন বিজ্ঞ যা বললো, তাতে আমি একদিনেই ‘শিশু সত্ত্বা’ হারিয়ে ফেললাম! ছেলে মেয়ের মধ্যে নাকি এতোকিছু হয়! আর আমি জানিই না! শিহরণ কী, কত প্রকার, এসবে দুই-একজন তো রীতিমত পিএইচডি করা। ওদের থেকে একটা ব্যাপার বুঝলাম, নারী পুরুষের এই ‘শারীরিক’ ব্যাপারটা খুবই থ্রিলের একটা বিষয়! শুধু ছেলে আর মেয়ে এক হলেই হলো! এরপর নাকি ন্যাচারালিই সব কিছু হয়! কী ভয়াবহ ব্যাপার!

দুই-একজন চুমুর স্বাদ অর্থাৎ শিহরিত ইতিমধ্যেই হয়েছে। তাদের ঠোঁটের কোনার হাসিতে, চোখের চাহনিতে কেমন রহস্য, ঘোর। এসব দেখে আমরা শিশুর দল দীর্ঘশ্বাস ফেলছি! আমরা কত বোকা, আমাদের কী হবে- এসব ভাবতে ভাবতে বাসায় ফিরলাম!

আম্মুকে বললাম, কই, তুমি যা বলেছো, বন্ধুরা তো তা তেমন বললো না, ওরা তো আরও কতো কিছু বলল…আম্মু কিচ্ছু না বলে চুপ করে শুনলো… সেদিনই বিকালে ছাদে নিয়ে আমার জীবনের সবচে বড় কৌতূহল নিবৃত্ত করলো আম্মু। নারী পুরুষের আদিম সম্পর্ক সম্পর্কে আমার বয়স, কৌতূহল অনুযায়ী বেশিরভাগ প্রশ্নের জবাব দিলেন। আম্মুর থেকে এবার আমি ধারণা পেলাম পুরাই অন্যরকম একটা কিছুর।

জানলাম, নারী-পুরুষের এ সম্পর্ক খুবই পবিত্র। বিয়ের পরে শুধুমাত্র স্বামীর সাথেই একটা মেয়ে এই অভিজ্ঞতা পেয়ে থাকে। অনেকেই বিয়ের আগেই এসবে জড়িয়ে যায়, তখন বিপদ হয়। ছেলেটা বিয়ে করতেও পারে, আবার নাও করতে পারে। আগে থেকে কে, কেমন তা যেহেতু জানা যায় না, তাই এসব থেকে দূরে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ! বিয়ের পরই স্বামীর সাথে সবকিছু করলে সবচে ভাল, কেননা আমাদের দেশ, সমাজ, সংস্কৃতি আর ধর্ম বিয়ের পরে শারীরিক সম্পর্ক করতে বলে, আগে কোনমতেই নয়।

আম্মু বলেছিলেন, এরপর আরও নানা প্রশ্ন জাগবে মনে। সমবয়সীরা অনেক ভুল জ্ঞান, ধারণা রাখে, কাজেই আমার সব প্রশ্ন আমি যেন আম্মুর থেকে জেনে নেই! আজ থেকে কত বছর আগের কথা বলছি! রক্ষণশীল মনোভাব রেখেও যে আধুনিক মানসিকতা ধারণ করা সম্ভব আমার মা তা শিখিয়েছিলেন!

ফিরে আসি সিয়ামে, সিয়ামের মতো ঘটনা প্রতি পরিবারেই কম-বেশি ঘটে। বড় হয়ে ওঠার সময়টায় নিষিদ্ধ কতকিছু সামনে চলে আসে! একে তো নিষিদ্ধ বিষয়, তার উপর জানি না, কিন্তু জানতে যে হবেই- মনে এই বিপরীতমুখী প্রবল ঝড় ওঠে বয়ো:সন্ধি কালটায়! এমন সময় মোবাইলে কিংবা পিসিতে নিষিদ্ধ কিছু চোখে পড়লে বেশিরভাগ বাবা মা’ই সিয়ামের বাবা-মায়ের মতো রাগারাগিই করেন সন্তানের সাথে। যেন রাগারাগি করলেই বাচ্চা আর সেদিকে যাবে না!

কী যে ভুল ধারণা এটা। টিনেজ সময়টাই এমন। যেমন করেই হোক জানতেই হবে- এই তাড়না কিছু দিয়ে দমাবার নয়, ধমক দিয়ে তো নয়ই। যা যত নিষিদ্ধ তাতে তত কৌতূহল! আর এখন তো নেট সুলভ হয়ে যাওয়াতে সবকিছু হাতের মুঠোয়! ছেলে মেয়েরা এখন অনেক কম বয়সেই অনেক কিছু জেনে ফেলে। এটা কি ওদের দোষ? একদমই না। এখনকার পরিবেশটাই এমন!

একটা ছোটো উদাহরণ দেই, গত মাসে এক গায়ে হলুদে গেলাম। এখন গায়ে হলুদের গানের প্রধান উপকরণ সানি লিওনের হিন্দি গান! হঠাৎ শুনি এক পিচ্চি আরেক পিচ্চিকে বলছে ‘কে এই সানি লিওন’, যাকে বললো, সে বলছে ‘দাঁড়াও গুগল করি, বাবার হাত থেকে ট্যাব নিয়ে দুই পিচ্চি সানি লিওন কে গুগল করতে যাবে, হতবাক আমি দৌড়ে পিচ্চিদের হাত থেকে ট্যাব নিয়ে ‘ক্যাডবেরি কিনতে যাচ্ছি, কে কোনটা কিনবে’ বলে তাদের দৃষ্টি ঘোরালাম! এখন এরা যদি গুগল করতো ‘সানি লিওন’, তাহলে গুগল কী সাজেস্ট করবে তা কি বলে দিতে হবে? নার্সারি পড়ুয়ারা পর্যন্ত এখন জিএফ, বিএফ বুঝে!!

আমার নার্সারিতে পড়া ভাগ্নি চিন্তায় থাকে, কারণ তাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় নাকি ‘খ’ শাখার ফার্স্ট গার্লের সাথে বেশি খাতির রাখে। ওর ধারণা ওই মেয়েকেই তাদের ফার্স্ট বয় জিএফ করবে!! তাই সে বেশি বেশি পড়াশোনা করে যাতে তার রোল এক হয়।

কী নির্দোষ ভাবনা, অথচ শুনে পিলে চমকে যায়! আমরা পুতুলের লোভে বেশি বেশি পড়াশুনা করতাম! আর এখন? আমাদের যে কালচার ছিল, তা এখন অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। বাঙালির গায়ে হলুদে সানি লিওনের মুভির গান এখন অংশ, সানি লিওনি নিয়ে কৌতূহল হবেই, এবং তা নিবৃত্ত করতে যেয়ে সন্তানের মোবাইলের সার্চ অপশনে আপনি পর্ণ পেতে পারেন! পেলে কী করবেন? গায়ে হাত তুলবেন?

‘গোঁড়ামি’ কখনই ইতিবাচক কিছু আনে না এই উপলব্ধি যত দ্রুত হবে ততই মঙ্গল। কাজেই সিয়ামের বাবা-মায়ের মত যেসব রক্ষণশীল, ধার্মিক অভিভাবক আছেন তাদের বলি রক্ষণশীল কিংবা ধার্মিক হয়েও কিন্তু আধুনিক চিন্তা ধারণ করা যায়। রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে উঠেও আমি আমার বন্ধুদের থেকে জ্ঞানে সবচে বেশি আধুনিক ছিলাম, এই কথা সাহস করেই বলতে পারি। রক্ষণশীল মনোভাব ধারণ করেও সমাজের কিংবা সময়ের পরিবর্তনশীলতার সাথে তাল মিলিয়ে চলা সম্ভব, আর আপনি যদি তা নাও পারেন তারপরেও চেষ্টা করতে হবে, কেননা আপনার সন্তান এমন একটা সময়েই বড় হচ্ছে যেখানে রাখঢাক কিছু নাই। সব খোলামেলা।!

Robert A. Heinlein বলেছেন, ”Being a mother is an attitude, not a biological relation.” আর আমি এ কথা বলি সমগ্র প্যারেন্টিং এর ক্ষেত্রে। অভিভাবক কেবল রক্তের সম্পর্কে হলেই হয় না, আচরণেও হতে হয়। কাজেই এখনকার সকল অভিভাবক, যাদের টিন এজ সন্তান আছে, তাদের বলি, সন্তানের বন্ধু, আত্মার সঙ্গী হয়ে উঠুন। সম্পর্ক এমন করে তুলুন, সে যেন দরজা আটকে গুগল করার প্রয়োজন বোধ না করে। সরাসরি আপনাকে জিজ্ঞেস করার সৎ সাহস রাখে। এমন পারিবারিক আবহ গড়ে তুলুন যাতে সে ‘সেক্স’ সম্পর্কে কৌতূহলী হলে আপনার থেকেই সে সম্পর্কে সঠিক দিকনির্দেশনা পায়, যে দিক নির্দেশনায় থাকবে আমাদের মূল্যবোধ, সংস্কৃতি আর ধর্মীয় প্রতিফলন।

মনে রাখবেন, আপনি তাকে যেভাবে গাইড করবেন গুগল কিংবা সমবয়সী কেউ সেভাবে পারবে না। ‘তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড কে?’ এ প্রশ্নের উত্তরে এক মুহূর্ত চিন্তা না করে যেন সন্তান উত্তর দিতে পারে ‘আমার বাবা-মা’- এমন হোক প্রতি অভিভাবকের সাথে তার সন্তানের সম্পর্ক- এ শুভ কামনা রইলো।

শেয়ার করুন: