ডিভোর্স-দ্বিতীয় বিয়ে এবং সন্তানেরা

সেবিকা দেবনাথ: বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ কিংবা দ্বিতীয় বিয়ের ঘটনা অনেক সন্তানই মেনে নিতে পারেন না। না পারার পেছনে অনেক যৌক্তিক কারণও আছে। মানিয়ে নিতে না পেরে অনেক সন্তান বিপথগামী হয়। কখনও কখনও আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়। এমন ঘটনা খুব একটা বেশি না হলেও নেহায়েত কম নয়। পত্রিকার পাতায়ও এমন খবর চোখে পড়ে।

আমি মনোবিজ্ঞানী নই। মানুষের মনোজগৎ সম্পর্কে খুব যে একটা পড়াশোনা আছে, সেই দাবিও আমি করছি না। তাই বাবা-মায়েদের প্রতি উপদেশ দেবার ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে পরিচিতদের মধ্যে দেখা তিনটি ঘটনায় মনের মধ্যে বেশকিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

বনিবনা না হলে স্বামী-স্ত্রী ডিভোর্স দিতেই পারেন। চাইলে নতুন করে আবার সংসারও করতে পারেন। কিন্তু সন্তানকে পাশ কাটিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া কতোটা যৌক্তিক? বাবা-মায়ের এমন সিদ্ধান্ত সন্তানের উপর কী এবং কতটা প্রভাব ফেলে এ বিষয় নিয়ে কতজন ভাবেন? অনাকাঙ্খিত এমন ঘটনা যদি ঘটেই, তাহলে বাবা-মায়ের কি উচিত নয় সন্তানদের বিষয়টি জানানোর? সন্তানরা কি চায় সে বিষয়টি জানার? তাদের অনুমতি নেওয়ার? সন্তানদের আরও একটু সময় দেয়ার?

আমার পরিচিত এক ভদ্রলোক থাকেন সুদূর আমেরিকায়। স্ত্রী-দুই সন্তান নিয়ে প্রায় ১৫-২০ বছর যাবত তিনি সেখানে আছেন। মেয়েটির বয়স ১৬। আর ছেলেটির ১০। সম্প্রতি ওই ভদ্রলোক দুই সন্তানকে নিয়ে দেশে এসেছেন। বেড়াতে নয়। বিয়ে করবেন বলে। কোনো একটা কারণে বছরখানেক আগে স্ত্রীর সঙ্গে উনার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। ভদ্রলোক যে মেয়েটিকে বিয়ে করবেন বলে দেশে এসেছেন তারও আগে একটি বিয়ে হয়েছিল। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। মেয়েটিরও ওই সংসারের দুটি সন্তান আছে। পরিবারের অমতে ওই ভদ্রলোক এই বিয়ে করছেন।

বিয়ের তিন দিন আগে উভয়পক্ষের সন্তানদের নিয়ে রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেতে গেলেন দু’জনে। ভদ্রলোকের দু’টি সন্তান ওই রাতেই প্রথম জানতে পারলো তাদের দেশে আসার মূল উদ্দেশ্য। বাবা-মায়ের আলাদা থাকার বিষয়টিই এখনও পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি বাচ্চা দুটো। এর মধ্যে বাবার এমন সিদ্ধান্তে চিড় ধরা ওদের পৃথিবীটা যেন মুহুর্তে গুড়িয়ে ধুলিসাৎ হয়ে গেল। ঘটনা জানার পর থেকে শয্যা নিয়েছে মেয়েটি। ছেলেটি হাউমাউ করে কেঁদেই চলছে। দুই ভাইবোনের নাওয়া-খাওয়া, কথা বলা বন্ধ। ওই ভদ্রলোক তার সিদ্ধান্তে অটল হয়ে রইলেন। এবং তিনি বিয়ে করলেন।

এক ভদ্রলোক পেশায় চিকিৎসক। তার স্ত্রী এবং ১৩ বছর বয়সী একটি মেয়ে আছে। বছর দেড়েক আগে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম একটি মেয়েকে বিয়ে করেছেন তিনি। বাবার এমন কাজ মেনে নিতে পারেনি মেয়েটি। বাবার কৃতকর্মের জন্য অনেকেই তাদের বাঁকা চোখে দেখে। আড়েঠারে ওই প্রসঙ্গটিই টেনে আনতে চায়। ওইটুকুন মেয়ে দুইবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। দুইবারই প্রাণে বেঁচে যায়। কিন্তু স্বাভাবিক কাজকর্ম থেকে সরিয়ে নিয়ে নিজেকে অনেকটাই ঘরবন্দি করে রেখেছে মেয়েটি। কারও কথাই কানে তোলে না সে।

তৃতীয় ঘটনাটি আমার এক সহপাঠীর। পারিবারিকভাবেই ওর বিয়ে হয়েছিল। ব্যবসায়ী স্বামীর অন্য নারীতে আসক্ত থাকার বিষয়টি আমার সহপাঠী যখন টের পায় তখন তাদের ছেলের বয়স এক কী দেড় বছর। বিচার-সালিশ, নীতিবাক্য ব্যয়, মানিয়ে চলার চেষ্টা, সবকিছুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সহপাঠীর স্বামী একদিন দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে বাড়িতে হাজির। তখন তার ছেলের বয়স তিন অথবা চার বছর হবে। এনিয়ে বাড়িতে তুলকালাম। একটা পর্যায়ে স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে বাবার বাড়িতে চলে আসে মেয়েটি।

সেবিকা দেবনাথ, সাংবাদিক

ওই ঘটনার বেশ কয়েক বছর পর মেয়েটির বাবা-মা তাকে আবার বিয়ে দেয়। এরপর থেকে ছেলেটা নানার বাড়িতে থাকে। বাবা-মা কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না। নানার বাড়িতে মা বেড়াতে এলে ছেলেটি অন্যের বাসায় গিয়ে থাকে। উচ্চ মাধ্যমিকের মাঝপথেই পড়াশোনা বন্ধ করে ঢাকায় এসে একটা চাকরি নিয়েছে।
অনেকেই হয়তো সব বিষয় সন্তানের সঙ্গে আলোচনা করেন। আবার অনেকেই হয়তো বলবেন, বাচ্চারা ছোট। তাই সংসারের অনেক কিছুই ওরা বোঝে না। কথা সত্য।

কিন্তু ওদেরও তো মন আছে। নতুন একটা সম্পর্কে নিজেকে মানিয়ে নিতে নিজের সাথে ওদেরও অনেক বোঝাপড়া করতে হয়। ওদেরও সময় প্রয়োজন হয়। যৌথ পরিবার থেকে একক পরিবারে আসার সংস্কৃতি আমাদের দেশে এখন আর নতুন নয়। আর চারপাশে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনাই প্রমাণ করে দিন দিন পারিবারিক বন্ধনগুলো কতটা আলগা হয়ে গেছে এবং প্রতিনিয়ত হচ্ছে।

আর কিছু না হোক, বাবা-মায়ের জীবনে প্রতিটি সন্তানই গুরুত্বপূর্ণ এবং ছোট হলেও ওদের মতামতেরও যে গুরুত্ব আছে, এই বোধটুকু কি আমরা ওদের ভেতর জাগাতে পারি না? ভালবাসা দিয়ে ওদের আরও একটু বেশি আগলে রাখতে পারি না?

শেয়ার করুন: