সাবিনা শারমিন: পুরুষাধিপত্য ও নারীর উপর পীড়নের আর এক নাম গালাগাল। বিষয়টি অনেকটা মৌখিক ধর্ষণের মত, যা উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত, শিক্ষিত অশিক্ষিত সকল শ্রেণীর পুরুষের মধ্যেই কম বেশী লক্ষ্য করা যায়। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এ ক্ষমতাটুকু নারীকে হেয় করার জন্য পুরুষ আজীবন উপভোগ করে আসছে।
পুরুষরা যখন নারীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে ব্যর্থ হয়, তখন নারীর উপর অশ্লীল বাক্য ছুঁড়ে দিয়ে নিজেকে নিরাপদ করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায়ই থাকে না। কিন্তু নারীরা এই অবস্থার জন্য কোনভাবে দায়ী না হয়েও যুগ যুগ ধরে এই করুণ বিপর্যয়ের শিকার হয়ে আসছে। নিজের ব্যর্থতার ভার নারীর উপর চাপিয়ে, তাদের ব্যর্থতার গ্লানি, দুর্বলতা ঢাকার সুযোগ সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগায় পুরুষ। একটি কাল্পনিক অপরাধ নারীর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে পুরুষ নিজেকে নিষ্কলুষ প্রমাণের ব্যর্থ হিংসাত্মক প্রচেষ্টা চালায়।
গালাগাল করা এবং রেগে যাওয়া পুরুষের মানসিক বিকার। পুরুষতন্ত্রের অনৈতিক সুবিধায় লালিত-পালিত হওয়ার একটি জটিল মনস্তাত্বিক অবস্থা। যে অবস্থায় মনের সাথে সাথে তাদের দৈহিক অবস্থারও ব্যাপক পরিবর্তন হতে থাকে। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, গালাগালের সময়ে পুরুষরা নারীর উপর ব্যভিচারের অভিযোগ চাপিয়ে দেয়। সমাজে ব্যভিচার নিষিদ্ধ, অশ্লীল এবং অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়ার কারণে এ জাতীয় গালাগাল দিয়ে নারীদের ঘায়েল করা খুব সহজ হয় তাদের জন্য।
ক্ষমতাশীল এবং সুবিধাপ্রাপ্ত পুরুষদের দ্বারা ক্ষমতাহীন নারীদের গালাগাল ও চরিত্র হরণের এই সংস্কৃতি পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের পুরুষতন্ত্রেরই একটি হীনমন্য সংস্কৃতি। নারীকে অপমান, নীচ এবং লজ্জাজনক পণ্য হিসেবে ভাবিয়ে তুলতে তাই নির্মমভাবে তুচ্ছজ্ঞান করার সকল ধরনের চেষ্টাই তারা করে। তবে গালাগাল অনেকটাই একটি কাল্পনিক হুমকি, যার উদ্দেশ্যটিই হচ্ছে নারীকে হীনজ্ঞান করে নিজে বড় হতে চাওয়া। বিশেষ করে এই অশ্লীল আনন্দের মূলে রয়েছে নারীর চরিত্র হনন।
ঘায়েল করার জন্য গর্ভধারিণী মাকে উদ্দেশ্য করে গালি দেয়া পুরুষতন্ত্রের এক চিরায়ত রূপ। গালাগালের সময়ে পুরুষের হিতাহিত জ্ঞান এতোটাই লোপ পায় যে, তারা বুঝতেও পারে না যে, প্রতিপক্ষের মাকে গালি দেয়া মানে প্রকারান্তরে নিজের মাকেই গালি দেয়া।
গালাগাল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পেশীশক্তি ও সন্ত্রাসবাদেরও এক ধরনের নেতিবাচক অভিব্যক্তি। এই পেশিশক্তির শ্রেষ্ঠত্ব নিয়েই একটি শিশু সমাজে বড় হতে থাকে। সেই সুবিধা ও শ্রেষ্ঠত্বের জায়গায় যখন আঘাত লাগে, তখন তারা সেটি কোনভাবেই মেনে নিতে পারে না। আর ঠিক এ অবস্থায় পুরুষরা অন্য কাউকে নয়, অপর পক্ষের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা মায়ের চরিত্রকে হনন করে গালাগাল দিতে থাকে। তারা মনে করে এই দুর্বল জায়গায় আঘাত করলেই পুরুষের পৌরুষত্ব বেঁচে যায়। এ অবস্থায় অন্যের মাকে হেয় করার মাধ্যমে নিজেকে নগ্ন করা ছাড়া জিতে যাওয়ার আর কোনো কৌশলই তাদের জন্য থাকে না।
যেন বিষয়টি এমন যে, প্রতিপক্ষ নারী হোক, আর পুরুষই হোক, গালিটি দিতে হবে কিন্তু ঠিক কারো মাকেই। কারণ মা ব্যতীত অন্য কাউকে গালি দিয়ে যেন মনের সন্তুষ্টি অর্জন হয় না পুরুষের। তাই মাকে বিভিন্ন বিশেষণ যুক্ত করে ম, খ, চ, বর্গের বর্ণ দিয়ে জঘণ্য গালি দিতে হয়। মাকে অপদস্থ করতে পারলেই যেন ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করা তাদের সহজ হয়।
এ সমস্ত গালির পুংলিঙ্গের সংস্করণ অভিধানে কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না। শুধু মাকেই নয়, সাথে সাথে আশেপাশের আরও নারী চরিত্রকেও চরমভাবে কলুষিত করা হয় নানান শব্দ দিয়ে। হিন্দিতে ‘বেহেন’ শব্দটি যোগ করলে পুরুষের যেন চরম পুলক জাগে। কখনো কখনো আরবি ভাষা যোগ দিতে পারলে যেন ভিন্নরকম এক শিহরণ জাগে। মৌখিক অপভাষার সাথে কখন কখনো শারীরিক অঙ্গভঙ্গিও অনেকের যুক্ত হয়ে যায়।
আর ইংরেজীতে ‘মাদার …’ না বললে কোনভাবেই বোঝা যাবে না যে তাদের ইউরোপ আমেরিকা ভ্রমণের যোগ্যতা আছে ! এখানে নারী, নারীর দ্বারা এসব গালাগালের প্রতিক্রিয়া হয় খুব কম, কারণ এই ক্রোধের অধিকারী একান্তভাবেই পুরুষের। কারণ স্রষ্টার কাছ থেকে তাঁরা আদায় করে নিয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী । যে দাম্ভিকতার বড়াই করে পুরুষেরা একে অপরের নিরপরাধ মাকে আক্রমণ করে অত্যন্ত নোংরা জঘন্য এবং নির্মম ভাষায়, যাকে হয়তো কোনদিন দেখেওনি সে পুরুষ।
গালাগাল সংস্কৃতির বীজ পুরুষের হাতেই রোপিত হয়েছে সৃষ্টির শুরু থেকে। সে সময়ের শুরুতেই নারীকে দোষের বোঝা মাথায় তুলে দেয়া হয়েছে গন্ধম ফল খেয়ে ফেলার জন্য। অপরপক্ষে পুরুষ স্রষ্টার দেয়া শ্রেষ্ঠত্ব ও আধিপত্য দাবী করে আসছে প্রথম থেকেই। যেখানে নারীকে অধীনস্ত করে তার অধিকার হরণ করে চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করার জন্যে তৈরি করেছে হাজার হাজার অশ্লীল নাম। যা দ্বারা নারীদের সমাজের আদর্শ থেকে পতিত হওয়াকেই বোঝায়। কিন্তু এখানে যারা নারীর চরিত্র হরণের জন্য প্রকৃতভাবেই দায়ী, তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় না।
বহুগামিতার দায় নিতে হয় না পুরুষকে, নিতে হয় নারীকে। তাদের প্রবৃত্তির দায় নিজের কাঁধে না নিয়ে নারীর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে পুরুষ হয়ে ওঠে সাংঘাতিক ‘এক মহান শক্তিধর পুরুষে ‘। তারা যতো বেশী নারী সম্ভোগের হুমকি দেবেন, ততবেশী পুরুষ হয়ে উঠবেন সমাজ সংসারের কাছে। কিন্তু একজন নারী তার প্রতিপক্ষ পুরুষকে কখনোই মাকে তুলে ‘চ’ বর্গীয় গালিটি দিতে পারে না। পারলেও নারী মনে করে এটি তাঁর নিজেরই অসম্মান।
সমাজে আমরা যাদেরকে অপাংক্তেয় ভেবে ‘পতিতা’, ‘বেশ্যা’ বলি তারা শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে পুরুষের অপরাধের ও কৃতকর্মের বোঝা আজীবন বহন করে। তারা এ ধরনের গালি খেয়ে খেয়ে সারাজীবন ধরে বিদ্ধ হয়। কিন্তু এখানে যাদের প্রয়োজনে তাঁরা এই গালিটি মাথা পেতে নেয়, তারা থাকে পর্দার আড়ালে। যৌনকর্মীরা জীবনের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য এই পেশায় নিয়োজিত থাকলেও কখনো দোষী পুরুষকে এ ধরনের গালাগাল দিতে পারে না। এর কারণ নারীর সাথে পুরুষের শারীরিক পার্থক্য এবং পুরুষ দ্বারা নারীর অবদমন।
আমরা দেখতে পাই যে সমাজে নারীর চরিত্রকে ঘিরে এবং কেন্দ্র করে অপমানের যে সমস্ত অশ্লীল ও তীব্র ভাষা ব্যবহার করা হয়, পুরুষের ক্ষেত্রে কখনোই তা ততটা নয়।
মানসিকভাবে ধর্ষণের বিকৃত, হীনমন্য এই জিঘাংসা পুরুষের রক্ত ও প্রবৃত্তির সাথে মিশে হাজার হাজার বছর ধরে নেতিবাচক প্রথার মত হয়ে দাড়িয়েছে। এই প্রবৃত্তি থেকে ইচ্ছে করলেই তারা খুব সহজে বের হয়ে আসতে পারে না। উদ্দেশ্য হাসিলের কৌশল হিসেবে নারীর প্রতি তারা সৃষ্টি করেছে এক ধরনের অসম্মান ও ভীতিকর অবস্থা। যেখানে কাজ করে সন্ত্রাস, আতঙ্ক, বলপ্রয়োগ এবং জবরদস্তি।
অন্যান্য সামাজিক সমস্যার মতো নারীকে অবমাননা করে গালাগালও একটি বিকৃত রুচির জঘণ্য অপরাধ, যা অনেক সময় নারীকে আত্মহত্যায়ও প্ররোচিত করতে পারে।
কিছুদিন আগে একজন তরুণী মডেলকে তার প্রেমিকের বাড়ির লোকেরা পতিতা বললে মেয়েটি তা সহ্য করতে না পেরে ভিডিও আপলোড করে আত্মহত্যা করেন। কিন্তু প্রেমিকের বাড়ীর লোকজন তাদের নিজেদের পরিবারের পুরুষটিকে তিরস্কার না করে করেছিলো নারীকে।
হত্যা ধর্ষণ যদি অপরাধ হয়, তাহলে অসম্মান করে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শারীরিক ধর্ষণ যদি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হয়, তাহলে মাকে উদ্দেশ্য করে ধর্ষণেচ্ছাও এক ধরনের নৈতিক বিপর্যয়ের অপরাধ। তাই একে ভর্ৎসনা ও তিরস্কারের মাধ্যমে সমাজে নারীপুরুষের যোগ্যতা এবং অর্জন ভিত্তিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে একে শাস্তির আওতায় আনা যায় কিনা তাও ভেবে দেখতে হবে ।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সংস্কৃতিতে পুরুষরা ইচ্ছে করলেই হঠাৎ করে একদিনে এই প্রবৃত্তি এবং অভ্যাস থেকে বের হয়ে নারীকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে দেবে এটি অকল্পনীয়। কারণ যুগ যুগ ধরে যে তন্ত্র মন্ত্র তারা সিন্ধুকের মধ্যে উত্তরাধিকার সূত্রে আগলে রেখেছে, সে সংস্কৃতি পাল্টাতে হলে প্রয়োজন ঘরে বাইরে এই সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ঘৃণা তৈরি করা। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে আমরা দেখি তার উল্টো। সে তন্ত্রে ঘি ঢেলেছে সমাজ। কখনো কখনো আত্মঘাতী নারী নিজেও। ঘরে যে গালি পুরুষ অন্য কোনো মাকে দিচ্ছে, সে পরিবারের মা সেই একই গাল হয়তো তার ছেলের বউকেও দিচ্ছে। একজন নববধুকে সপরিবারে গালাগাল দিয়ে নিপীড়ন করার সংস্কৃতি আমাদের সকলের ধমনীতেই প্রবাহিত।
আমাদের সমাজে আমাদের পুরুষেরা সেই তন্ত্র-মন্ত্রের গৌরবে মাকে উল্লেখ করে রাগ-ক্ষোভের পাশাপাশি গালি দেয় আনন্দ-উল্লাসেও। ব্যর্থ হয়ে গালি দেয়, হতাশ হয়ে গালি দেয়, বেদনা বিধুর হয়ে গালি দেয়। হাস্যরসেও গালি দেয় ওই মাকেই। এমনকি বিজয়ের আনন্দেও পুরুষ নারীকে গালি দিতে ছাড়ে না।
কিছুদিন আগে ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে জয়ী হওয়ার আনন্দে গণমাধ্যমে একজনকে দেখলাম মাকে তুলে গালাগাল দিয়ে উল্লাসের ইতর আনন্দ উপভোগ করছে। হায় পুরুষ ! কবে তোমরা মানুষ হবে ? কবে তোমরা পুরুষ না হয়ে একজন গর্ভধারিণী মায়ের সন্তান হবে ? কবে তোমারা পৌরুষের অহমিকা ত্যাগ করে নিজেদের সম্মান করতে শিখবে নিজের অর্জিত যোগ্যতায় ?
সাবিনা শারমিন
[email protected]