কামরুন নাহার রুমা:
রাত আটটা হবে, দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। আমি একটু অবাক। আমার বাসায় এই সময় কে! দরজা খুলে দেখি এক ছাত্র দাঁড়িয়ে। ঘরে ঢুকলো, বসলো, পানি খেল, স্থির হলো। তারপর বললো, ‘ম্যাম, আজ রাতে আমি আপনার বাসায় থাকবো’।
আমি বললাম ‘কেন বাবা’? ও বললো, ‘আমার বাসায় মেহমান এসেছে, জায়গা নেই’। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। কারণ আমি একা থাকি; কেউ যদি কোনভাবে টের পায় একজন পুরুষ (তার বয়স যত কমই হোক) আমার বাসায় এসেছে, তাহলে পরদিনই পুরো এলাকায় ‘কাহানি ঘার ঘার কি’ হয়ে যাবে।
ওর সাথে বসে গল্প করলাম, পুরো পরিস্থিতি ওকে বুঝালাম। পেট ভরে খাইয়ে-দাইয়ে একবুক কষ্ট নিয়ে ওকে বিদায় দিলাম। সমাজের এই ঠুনকো বিধিনিষেধকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আমি ছেলেটাকে সেই রাতে একটু আশ্রয় দিতে পারিনি, এই মানসিক দৈন্যের কারণে আমি সে রাতে প্রবল অনুতাপের আগুনে পুড়েছি, এখনও পুড়ি।
কারণ কতোটা ভালবাসলে, আস্থা রাখলে একজন ছাত্র তার শিক্ষকের বাসাকেই বেছে নেয় রাতে থাকার একটু আশ্রয় হিসেবে, সেটা আমি সেই রাতে প্রবলভাবে অনুভব করেছিলাম। বাবা যদি পারো এই অক্ষম ম্যাডাম মাকে ক্ষমা করে দিও। আমি নিজের সম্মানটুকু দেখেছি, তোমার কষ্টটুকু বুঝেও না বোঝার ভান করে তোমায় বিদায় করে দিয়েছি।
আর এক সন্ধ্যায় তিন ছাত্রছাত্রী বাসায় এলো পড়া বুঝে নিতে, কারণ ওরা ক্লাসটা মিস করেছিল; আমিই বলেছিলাম আসতে। ওরা এলো, খেলো, পড়াও বুঝলো। ছেলে দুটোকে বিদায় করে দিয়েছিলাম, মেয়েটাকে রেখেছিলাম সেই রাতে, কারণ ওর হোস্টেল বন্ধ হয়ে গেছে ততোক্ষণে। এমন আরও অনেক ঘটনা আছে লিখতে বসলে শেষ করা যাবে না।
আমার বাসায় কিছুদিন পরপরই ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে আসে, আমি রান্নাবান্না করি, ওরা খায়-দায়, দিনভর মাস্তি করে, ভরপুর আড্ডা দেয় – আমার ভীষণ ভালো লাগে। ভালো লাগে এই ভেবে যে, আমি ওদের শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও ওরা কতো সহজে আমার বাসায় আসতে চাওয়ার, খেতে চাওয়ার বায়নাটা ধরতে পারে।
কোনো একজন তার ব্যাচম্যাটদের জন্মদিনের ট্রিট দেবে হয়তো, কিন্তু হোস্টেল বা আত্মীয়ের বাসায় থাকার কারণে বাসায় রান্না করে খাওয়াবে, সেটা পারছে না। সেই ক্রাইসিস মোমেন্টে আমাকে এসে যখন সে বলে যে, আমার বাসায় সে সব বন্ধুদের ট্রিট দিতে চায়, আমি যদি একটু এলাউ করি এবং কষ্ট করে একটু রেঁধে দেই, তখন অদ্ভুত এক ভালোলাগায় আমার মন ভরে যায় এই ভেবে যে, আমি ওদের এতোটা কাছের একজন হতে পেরেছি, যাকে তারা শুধুই শিক্ষক নয়, তার চেয়েও আপন একজন ভাবছে, যার কাছে খুব সহজে একটা আবদার করা যায়।
আমি অনেকের কাছেই একটা কথা প্রায়ই শুনি, আর তা হলো ছাত্রছাত্রীদের কখনও বন্ধু ভাবতে নেই, বা তারা শিক্ষককে বন্ধু ভাববে, সেই স্পেসটাও ওদের দিতে নেই। কারণ শিক্ষকের দেয়া বন্ধুত্বটার মূল্য ওরা বোঝে না। তাঁদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, কথাটা আংশিক সত্য, পুরোটা নয়। একজন শিক্ষকের কোনকিছুকেই সহজভাবে নেবে না এমন গুটিকয়েক শিক্ষার্থী সবখানেই আছে, থাকবেও। তাদের জন্য বাকিদের বঞ্চিত করার কোনো মানে নেই। কারণ অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই শিক্ষকের সেই বন্ধুতার হাতটা চায়, যে হাতটা পরীক্ষার খাতায় নম্বর দেয়ার পাশাপাশি, তাকে তার খুব ব্যক্তিগত সমস্যার অতল গহ্বর থেকে টেনে তুলবে একজন বন্ধু হয়ে। এটা আমার সাত বছরের শিক্ষকতা জীবনের উপলব্ধি নয়; এটা আমার শিক্ষকতা জীবনের শুরুর দিকেরই উপলব্ধি।
ভার্চুয়াল কমিউনিকেশনের এই যুগে যখন একজন শিক্ষকের হানিমুনের ছবি থেকে শুরু করে তার প্রেমের, ডিভোর্সের , তার সাফল্যের বা ব্যর্থতা সবকিছুর খবরই একজন শিক্ষার্থী জেনে যাচ্ছে তখন ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মধ্যে একটা ‘গুরুগম্ভীর দেয়াল’ তুলে রাখাটা আমার কাছে অন্তত হাস্যকর ঠেকে। না তার মানে এই নয় আমি বলছি যে যেটা আপনার দ্বারা হয় না, সেটা আপনি জোর করে করুন, বা দলে দলে ছাত্রদের বন্ধু হয়ে যান; সবার জন্য সবকিছু নয়, আবার সেই সবকিছুর একটুও সবার জন্য নয়, তাও কিন্তু নয়।
শিক্ষকরা তাদের ব্যস্ত শিডিউল থেকে একটু সময় বের করে এক কাপ চা খেতে খেতে যদি একজন শিক্ষার্থীর কাঁধে হাত রেখে জানতে চান, ‘কী সমস্যা তোমার একটু বলতো শুনি’ তাতে করে সেই শিক্ষকের কোন স্কলাস্টিক কাজের খুব বেশি ক্ষতি হবে বা ব্যক্তিত্বেরও খুব বেশি হ্যাম্পার বলে আমার মনে হয় না।
যে ছাত্রীটি লেখাপড়ার মাঝপথে সংসারী হয়ে লেখাপড়াকে ‘বাই বাই’ বলে চলে গেছে বহু আগে, সেই ছাত্রীটিও আমাকে তার মেয়ের প্রথম জন্মদিনে নিমন্ত্রণ করে মেয়েটিকে একটু আশীর্বাদ করে আসার জন্য নিমন্ত্রণ করে, অথবা যে মেয়েটি ঘর বেঁধেছিল ভালবেসে, সেইসাথে ছেড়েছিল লেখাপড়াও, সে আজও আমার ছোট বোন হয়েই আমার জীবনে থেকে গেছে। বাসায় মায়ের সাথে অভিমান হলে সে আমার বাসায় এসেই গাল ফুলিয়ে বসে থেকে অভিমানের জল ঝরায় দুচোখ থেকে।
সব শিক্ষককে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শিক্ষার্থীর পাশে বসে তার প্রথম লেখা ডায়েরিটা হারিয়ে যাবার গল্পটা বা সেমিস্টার ড্রপ দেবার গল্পটা জানতে হবে এমন নয়, কোন কোন শিক্ষক না হয় তেমনটি হলেন। শিক্ষক তো অনেকেই আছেন কিন্তু আমি একজন শিক্ষার্থীর সেই বন্ধু হয়ে বাঁচতে চাই যাকে একটা পড়া একবার না বুঝলে বারবার বোঝার জন্য অনুরোধ করতে পারে, শিক্ষা সফরে বহুদূরের পথ চলার সময় যার কাঁধে মাথা রেখে সে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। মূল জায়গাটা ঠিক রেখে সময়ের হাত ধরে শিক্ষকতার ধরন-ধারণ পরিবর্তিত হয়েছে; সেই পরিবর্তিত ধরনকে আমি ধারণ করেছি, ভালবেসেছি কারণ আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের ভীষণ ভালবাসি। ভালবাসা নাকি ‘প্রকাশিতে’ নাই – যারা বলে আমি তাদের দলে নই। শিক্ষক তো সবাই-ই, আমি না হয় বন্ধুও হলাম।