জানার অধিকারেই জানতে চাই, বাঁচতে চাই!

ফেরদৌস কান্তা: কদিন ধরেই অনলাইনে একটা ছবি নিয়ে বেশ তোলপাড়। একটা শিশুর ছবি, রোহিঙ্গা শিশু। ছবিটা দেখলেই বুকটা মুচড়ে উঠে। কাদার মাঝে উল্টে বাচ্চাটা পড়ে আছে। আমার একটা বাচ্চা আছে। সেই হিসাবে আমার কলিজা মোচড় দেয় আরও বেশি। কোন মায়ের বুকের ধন, আহারে! এভাবে মৃত্যু লেখা ছিল।

rohingya-child-1প্রতিদিন মরছে এভাবে কতশত মানুষ পথে প্রান্তরে। মরার জন্য তৈরি হচ্ছেনও অনেকে ধুঁকে ধুঁকে। আমাদের সবার বুক ভরা মায়া। এইসব শুনলে বা দেখলে চোখে পানি চলে আসে। কেঁদে ফেলি, চোখ মুছি। ভুলেও যাই দ্রুত। মনে এতো জায়গা কই?

শীত এসেই পড়েছে। রাস্তাঘাটেও কতশত অনাথ শিশু কিংবা বৃদ্ধরা কষ্ট পাচ্ছেন ঠাণ্ডায়। তাদের জন্য ভাবি আর কিছু করার চেষ্টা করি সবাই মিলে চলুন। তার আগে আসুন এবার কিছু মনে করিয়ে দিবার চেষ্টা করি। বাংলাদেশ নামের একটা স্বপ্নপুরি আছে, যেখানে নাসিরনগর নামের একটা জায়গা আছে। সেইখানেও কিছু মানুষ সুখে শান্তিতে(!)  বসবাস করতো।

সেখানে কিছু ঘটেছিলো কয়দিন আগে। মনে পড়ে? না পড়লে মনে করিয়ে দিচ্ছি, সমস্যা নাই। সেখানে মানুষ প্রজাতি কয়েক শ্রেণীতে ভাগ হয়ে বসবাস করতো। এই যেমন সংখ্যাগুরু শ্রেণী, সংখ্যালঘু শ্রেণী এইরকম! তো , কোন একদিন সেইখানে গুজব উঠলো চিলে কান নিয়েছে, শুনেই সবাই চিলের পিছনে ছুটলো কান উদ্ধার করতে (ছোটবেলায় পড়া কবিতাটা বড় হয়ে দেখলাম কতটা কার্যকরি)।

attack-12একজন রসরাজ দাদা নাকি কাবা শরীফের  উপর শিবের ছবি লাগাইছিলেন ফটোশপ করে। তো দাদা হইলেন সংখ্যালঘু প্রজাতির। ব্যস গেল গেল সব গেল, ধর্ম, জাত, হায়! হায়! সব শেষ! তো কী উপায়? এতো সাহসের জবাব দেয়া লাগে। চিন্তা করার সময় নাই। একটাই শাস্তি ভাঙো, জ্বালাও, পোড়াও। সবগুলিরে দেশ ছাড়া করো। যাচাই করার সময় কই? সব মালাউন (দুঃখিত), এরা ইসলামের বদনাম করছে। তাই রক্ষা নাই।

ধর্ম রক্ষার উল্লাসে নিমিষেই তছনছ কতশত সাজানো ঘর-বাড়ী! সেইসাথে নষ্ট হয়ে গেলো কত ভালোবাসা, স্বপ্ন-সাধ! তবে এখানে আমি কনফিউজ, স্বপ্ন-সাধ নিয়ে আসলেই এইদেশে সংখ্যালঘুরা কতোটা বেড়ে উঠে! এই শীতে তাদের খবর নিলেন কয়জনা?

অতপর আসুন আসল কথায়। একদিন জানা গেলো দাদা রসরাজ কাজটি করেননি। করেছেন আমাদেরই এক জাতভাই জাহাঙ্গীর। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ধরাও হয়েছে তাকে। আগেই মাফ চেয়ে নিচ্ছি এই জন্য যে, ইসলাম সম্পর্কে আমার জ্ঞান সীমিত। কিন্তু সীমিত জ্ঞানের মাঝে আমি যতোটা জানি তা হলো, ইসলামে অন্যায়ের শাস্তি কঠিনভাবে দেয়ার বিধান আছে।

তো এখন যারা প্রকৃত অন্যায়কারী, তাদের শাস্তিটা নিশ্চিত হবে কি? তারা কি কঠিন শাস্তি পাবে? জাহাঙ্গীর ভাইজানকে ধর্ম অনুযায়ী প্রকাশ্যে ছেড়ে দিন। ধর্মের অবমাননার কঠিন শাস্তি জনগণ দিক তাকে। তাও আমরা লাইভ দেখতে চাই। ধরার খবর পেয়েছি। ব্যাস, শান্তি! এটা আর ভাববো না। এখন শাস্তি পাচ্ছে এবং খুব কঠিন রকমের শাস্তি, এটাও নিশ্চিত হতে চাই। এবং চাই দাদা রসরাজের কাছেও প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া হোক।

পাশাপাশি বেড়ে উঠা একই এলাকায় প্রতিবেশীদের উপর কতটা বিদ্বেষ থাকলে এইরকম নৃশংসভাবে আক্রমণ করা যায়? এভাবেই কি প্রজন্ম বেড়ে উঠছে? আমরা তো এভাবে বেড়ে উঠিনি। কী ভয়ংকর অবস্থা! ভাবার সময় এসেছে ধর্মের নামে ছড়ানো বিদ্বেষ আসলেই কী ধর্মের জন্য, নাকি যারা প্রাণ-সম্মান রক্ষার ভয়ে দেশ ছাড়ছেন, তাদের সহায়-সম্পতির জন্য।

ferdous-kanta-2
ফেরদৌস কান্তা

সংখ্যালঘু বলে যাদের ঘরবাড়ী প্রতিনিয়ত দখল করা হয়, দখলদার কারা তা আমরা সবাই জানি। এই এক জায়গায় খুব মিল রাজনীতিবিদদের ও ক্ষমতাবানদের। দলমত নির্বিশেষে, সময়মতো সব এক হয়ে যান। কিছুদিন পর পর ঘরবাড়ি ভেঙ্গে ফেলা, মন্দির-মুর্তি ভেঙ্গে ফেলা, জোরপূর্বক বাড়িঘর দখল সবই যেন পরিকল্পনামাফিক চলে।

আগেও বলেছি, এখনো বলছি খুবই দুঃখের সাথে যে, ‘প্রতিবাদ’ শব্দটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। আমরা সবাই স্বাধীন দেশের চোখ, মুখ আর কান বন্ধ করা ভীষণ রকম সচেতন নাগরিক, যারা শুধু দিন শেষে নিজের ভালটা বুঝতে শিখে গেছি। কিবা আসে যায় অন্য কারও কিছু হলে? আমি তো বেশ ভাল আছি। খাচ্ছি, দাচ্ছি, ঘুমাচ্ছি। আমার সমস্যা হলে পরে ঘাড় নাড়বো।

এইরকম কতশত নাসিরনগর প্রতিদিন পুড়ছে! কখনো প্রকাশ্যে কখনও বা অপ্রকাশ্যে, কারো কোনো দায় নেই! দেশ আগাচ্ছে বলে যারা গর্ব করেন তাদের প্রতি জিজ্ঞাসা, শূন্য দেশে শ্বাস নিতে ভয় পাবেন না তো সামনে? খুব ভাল থাকবেন কী একা একা? ঈশ্বরও কিন্তু একা থাকতে পারেননি। সময় কাটাতে তৈরি করেছেন আমাদের!

বিচারহীনতার যে কালচার তৈরি করেছেন, এর ফাঁদে না আপনাদের জীবন আটকে যায়! মানুষ বলে পরিচয় দিতে যেদিন লজ্জা হবে, সেদিন কিন্তু অনেক দেরী হয়ে যাবে। আর কত বোঝা মাথায় নিবেন, একটু ভেবে দেখবেন কি? নির্বিচারে সংখ্যালঘু উচ্ছেদ, নির্যাতন ও হত্যা, নারী ও শিশু নির্যাতন, পুলিশ দিয়ে শিক্ষক হত্যা, পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের নির্বিচারে নির্যাতন, হত্যা ও জমিজমা দখল- আর কত চললে পরে মনে হবে এবার থামা যায়! কারও কী মনে হয় না যথেষ্ট হয়েছে?

সারাক্ষণ আমাদের যদি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে, তাহলে ধর্মীয় অনুভূতির হক কি শুধু আমাদের একচেটিয়া? এইদেশে আর কারো ধর্মীয় অনুভূতি নাই? যেভাবে সব অন্যায়ের বৈধতা দিয়ে যাচ্ছেন সবাই মিলে, একদিন নিজের কাছেই ক্ষমা চাওয়ার সময় হবে না, জনগণ বহুত দূরের কথা! আমরা বেশি কিছুই চাই না।

শুধু চাই প্রতিদিনের ঘটে যাওয়া অন্যায়গুলির বিচার শুরু হোক। মানুষ হিসাবে নারী-পুরুষের অধিকার সমান হোক। সংখ্যালঘু যাদের বলেন- জনগণের একাংশকে, তাদের সম্মান ও অধিকার নিশ্চিত করুন-দেশটা তাদেরও। শিশু ও নারী নির্যাতন কঠোরভাবে দমন করুন। এইসবগুলি ব্যাপারেই কিছু করুন। ক্রমান্বয়ে আমরা মেরুদণ্ডহীন আর স্বার্থপর জাতিতে পরিণত হচ্ছি। এটা থেকে মুক্তি চাই। এই জাতির গল্প শোনাই না আমার ছেলেকে, সাহসী জাতির গল্প শোনাই। চোখে এখনও অনেক স্বপ্ন। আমাদের ভবিষ্যৎ যারা, তারা যেন মানুষ হিসাবে গড়ে উঠে, শুধু মানুষ। বিভেদ চাইনা আর, কারণ সয়ে নেবার লিমিট অতিক্রম করে ফেলেছি।  

শেয়ার করুন: