বর্ণবাদী আমরা, মনের গহীন থেকে

রাবেয়া জাহান আভা: আমার মায়ের গায়ের রং অসম্ভব সুন্দর, দুধে আলতা যাকে বলে। আর বাবা ছিলেন ব্ল্যাক প্রিন্স, সত্যিকারের প্র্রিন্সের মতো, অন্তত যারা তাকে দেখেছেন এমনটিই বলবেন। আমরা কেউই মায়ের বা বাবার রং কোনটাই পুরোপুরি পায়নি।

গ্রামে বেড়ে উঠলেও কোনদিন গায়ের রং বা চেহারা নিয়ে আমাকে কটু কথা শুনতে হয়েছে, মনে পড়ে না। আসলে আমাদের সমাজে বোধহয় এসবই শুনতে হয় মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে বা পরে। প্রথমবার শাশুড়ির কাছে যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, পাশের বাড়ি বেড়াতে গেলে দু:সম্পর্কের এক আত্মীয় আমার বরকে বললেন, তোর বউ তো দেখতে বেশ ভালো, তোর মা যে বললেন, কালো? পছন্দ করে বিয়ে করা বউ সম্পর্কে এমন কথা বললে প্রতিটি ছেলেরই খারাপ লাগার কথা। আমার বরেরও লেগেছিলো। বাড়ী এসে প্রতিবাদ করলেও তা মা’র কথার কাছে ধোপে টেকেনি। সেদিন আমি খুব কষ্ট পেলেও এভাবে ভেবেছি, ছেলের মা-এ শক্তিতেই তিনি কথাটি বলেছেন, হয়তো অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়।

ava-edited
রাবেয়া জাহান আভা

প্রথম সন্তান জন্ম দেবার ক্ষেত্রে সব মেয়েরই একটা নিজস্ব চাওয়া থাকে সৃষ্টিকর্তার কাছে। অন্য সব মায়ের মতো আমিও চেয়েছিলাম ছেলে বা মেয়ে যাই হোক যেন সুস্থ্য হয়। আর বন্ধু, স্বজনের পরামর্শ পেতাম কি খেলে বাচ্চা ফর্সা হয়। বাড়তি যত্ন-আত্তিও পেতাম। তাই আমারও হয়তো মনের কোনে একটা বাড়তি আশা থেকেই বা গর্ভাবস্থায় সৃষ্টিকর্তার কাছে যা চাওয়া যায় তা পাওয়া যায়-এরকম ভাবনা থেকেই সন্তান যেন একটু ফর্সা হয় এমনটাই চেয়েছিলাম, অন্তত আমাদের দুজনের চেয়ে।

কিন্তু আমার ভাবনাকে অতিমাত্রায় সত্যি প্রমাণিত করে আমার ছেলেটি সৃষ্টিকর্তার পাওয়া সবটুকু শুভ্রতা নিয়ে যেন আমার জগত আলোকিত করলো। ওর জন্মের পর শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দেয়ায় পোস্ট অপারেটিভ রুমে আমরা মা-ছেলে পাশাপাশি বেডে থাকলাম। এ্যানেসথেশিয়ার ঘোরে তন্দ্রাচ্ছন্ন আমি রং দেখে নয়, শুধু ওর চোখের দিকে তাকিয়েই কাটালাম সারারাত। কী এক অদ্ভুত মায়া ওই চোখে! হয়তো সব মা’ই এই একই রকম মায়া অনুভব করেন তার নিজের সদ্যজাত সন্তানটির জন্য।

খুব কাছের এক আত্মীয় প্রথমবার ওকে দেখে সালমান খান, আবার কেউবা রাজপুত্র বললেও আমার সন্তান তো আমার কাছে রাজপুত্রই। তার জন্য আমাকে রানী হওয়া লাগবে এমন তো নয়। এরপর ওকে যেখানেই নিয়ে যাই, সবাই শুধু ওর রংটার জন্যই আমাদের সাথে ওর অমিল খুঁজতে চেষ্টা করে। প্রথম ধাক্কাটা খেলাম যখন একজন আত্মীয় বলে বসলেন, তুমি ওর মা সবাই বলে তো? আমার বাচ্চা, এটাই যথেষ্ট আমার জন্য-কিছুটা ধাক্কা খেলেও প্রচণ্ড রাগে সেদিন উত্তরটা দিয়েছিলাম।

এরপর বরের চাকরিসূত্রে ঢাকার বাইরে। তখনো বুঝিনি ঢাকার বাইরে বর্ণবাদীদের মুখোমুখি হতে হবে আরো বেশি। অন্তত তাদের মন্তব্য ক্ষতবিক্ষত করবে আমাকে। প্রথম সন্তান তার উপরে ছোট এবং আপনজন ছেড়ে আমি একা-বাচ্চা সামলানোর এক একটা দিন ভুলবার নয়। খাওয়া, ঘুম কোনোটাই ঠিকমতো হতোনা। অপারেশনের ধকল কাটিয়ে সোজা হয়ে দাড়াতে আমার পাক্কা একবছর সময় লেগেছিলো-স্পষ্ট মনে আছে। ‍এরপর ওকে নিয়ে বের হলেই দেখতাম সবাই ওর রঙয়েরই প্রশংসা করছে এবং আমাদের সাথে ওর পার্থক্য।

‘কার মতো হয়েছে দেখতে’ এই প্রশ্নটা মোটামুটি গা সওয়া হয়ে গিয়েছিলো। প্রতিবেশীরা দেখলেই একই প্রশ্ন করতেন বারবার। আমি পূর্ব অভ্যস্ততায় হাসিমুখে বারবারই বলতাম আমার মা’র মতো। কিন্তু তাদের চোখে স্পষ্ট অবিশ্বাসের ছাপ দেখতে পেতাম। কারণ ওখানে যাবার পর আমার মা তখনো যাননি আমার বাসায়। কয়েকদিন যাবত একই উত্তর পেয়ে আমার এক প্রতিবেশী শেষে একদিন বলেই বসলেন, ‘ও আসলে কার মতো, ডিএনএ টেস্টটা সাথে রাখবেন’। আমি সত্যিই খুব আঘাত পেয়েছিলাম সেদিন। শুধুমাত্র রংয়ের কারণে কোনো মাকে এই কথা কেউ শোনাতে পারে আমার ভাবনারও বাইরে ছিলো। কান্না চেপে চলে আসলেও এই একটা কথায় সেদিন আমি সারারাত কেঁদেছিলাম।

আমার মেয়েটার জন্মের সময় মা যাওয়াতে তারা অন্তত কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন, মা’কে দেখে। এরপরও তাদের আলোচনায় ভাটা পড়েনি। মেয়েটার জন্মের পর তাদের উৎকন্ঠা ছিলো তার রং নিয়ে। ক্লিনিক থেকে ফিরেই একজনের ফোন ‘কেমন হয়েছে, ছেলের মতো রং কিনা? আমি হেসে যখন উত্তর দেই ‘অতটা নয়’, তখন পাল্টা প্রশ্ন ‘এবার কি মেকানিজম ইউজ করলেন, ছেলের মতো হলো না?’ কষ্ট নিয়ে শুধু ‘মেয়ে হয়েছে তাতেই খুশী’ এটুকু বলতে পেরেছিলাম। সেদিন বলতে পারিনি, সন্তান জন্ম দেবার ক্ষমতাটুকু স্রষ্টা আমাকে দিলেও, তার রং, শরীর গঠনের মেকানিজম তিনি কাউকেই দেননি। উল্লেখ্য, তাদের কারো সাথেই আমার কোন ধরণের কোন মনোমালিণ্য বা শশ্রুতামূলক কোনো রাগ ছিলোনা। আমি তাদের প্রত্যেককেই অনেক পছন্দ করতাম এবং আজো করি।  

আজো যখন আমি দেশের বাইরে, আমি জানি প্রথম দেখাতেই সবার মনে একই প্রশ্ন আসে, জিজ্ঞেসও করে অনেকে কিন্তু কেউ ওভাবে বলেনা, আঘাত দিয়ে। সুক্ষ একটা বর্ণবাদী মন থেকে এই যে আমরা অন্যকে আঘাত দিয়ে আনন্দ পাই, আমরা কি একবারও ভেবে দেখি, এই একই ঘটনা যদি আমার মেয়ে বা বোনের বেলায় ঘটে তখন আমার কেমন লাগবে? যখন তাদের প্রত্যেকেরই একটি বা দুটি করে মেয়ে আছে। ওইসব মানুষদের প্রতি আমার কোন রাগ নেই বরং আমি কৃতজ্ঞ তাদের প্রতি, সেদিন সহ্য করতে পেরেছিলাম বলেই আজ লিখতে পারছি।    

শেয়ার করুন: