স্যানিটারি প্যাড মানেই যখন ছিল সেনোরা  

মারজিয়া প্রভা: পাহাড়ের উচ্ছল জীবনেই কেটেছিলো মেয়েটির ছোটবেলা। পাহাড়ি কথার টান দেখেই সেটা বোঝা যায়। একদিন পিরিয়ড হলো। মা তার হাতে তুলে দিল কাপড়। কিন্তু সেই মেয়েই বড় হয়ে যখন শহরে পড়তে এলো, পেলো আরামদায়ক সেনোরাকে। তাই মাকে চিঠি লেখে সেনোরার পার্সেল পাঠাতে এক মুহূর্ত দেরি করলো না।

senora-1ফেসবুকে অ্যাডটা চোখে পড়তেই কতজনকে মেসেজ করেছিলাম মনে নেই! তবে মেয়েটার বলার ভঙ্গিমা শুনে বার বার সারা গায়ে লোম দাঁড়াচ্ছিল। আমি তো কিছু পরিসংখ্যান জানিই। এখনো দেশের প্রায় ৯৭% নারীই অপরিচ্ছন্ন মাসিক জীবনের ফলে ভুগছে সার্ভিক্যাল ক্যান্সারে। দেশের ৮৭% মেয়েই এখনো ব্যবহার করছে কাপড়। মাত্র ১৩% মেয়ে ব্যবহার করছে প্যাড। তাই মেয়ে যখন মাকে প্যাড ব্যবহারের জন্য উৎসাহ দেয়, সেটা বিশাল পাওয়াই আমাদের জন্য।

ছোটবেলায় সেনোরার অ্যাড যখন টিভিতে দেখতাম, কিছু বুঝতামই না। বলা হতো, “আরামদায়ক, শোষণক্ষমতা বেশি”। এখন বুঝি, ওইসময় অতটা টিভি অ্যাডে বলাটাই ছিল বিশাল ঝক্কির। সাদা কালো টিভিতে ঐ অ্যাডের সময় মা ইচ্ছে করে এন্টেনা টেনে ঝিরঝির করাত। উদ্দেশ্য আমাকে দেখতে না দেওয়া।  

আমার মায়ের বালিশের নিচে যেবার প্রথম সেনোরার প্যাকেট পেয়েছিলাম, সেদিন বার বার ঝিরঝিরতে দেখা অ্যাডের কথাই মনে আসছিল। যে জিনিস মা আমাকে টিভিতে দেখতে দেয় না, সে জিনিস তাহলে বালিশের নিচে রাখে কেন?

ক্লাস ফাইভে সেনোরা এসেছিল আমাদের স্কুলে সেমিনার করাতে। অত বড় ব্যানার দেখে আমাদের ক্লাস ফাইভ ফোরের মেয়েদের কী গা টেপাটিপি! সেমিনারে আমাদের ঢুকতে মানা ছিল। ক্লাস সেভেন থেকে টেন পর্যন্ত মেয়েরা কেবল যেতে পারবো। অথচ ক্লাসে আমিসহ পাঁচ-ছয়জন ততোদিনে ঋতুবতী হয়েছিলাম। তবুও সেই সেমিনারে সেদিন আমাদের যেতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু কেন? আন্দাজ করতে পারি না এখনো।

senora-2পিরিয়ড ট্যাবু। কেন ট্যাবু, মালুম নয়! ছোটবেলা থেকে আজ অবধি ফিসফিসানি এই ট্যাবুকে দিনে-দুপুরে ভেঙ্গে দেওয়ার জার্নিতে নেমেছিল সেনোরা আর তার বিজ্ঞাপনেরা । রাস্তায়, মাঠেঘাটে সেদিন দেখতাম বিশাল পোস্টার, ব্যানারে ছেয়ে থাকতো সেনোরার বিজ্ঞাপন।

একবার মনে আছে, কেমেস্ট্রি স্যারের বাসায় মডেল টেস্ট দিতে গিয়েছি এসএসসি এর আগে। টেবিলে এক ন্যুড মেয়ে আঁকা, তার পাশে সেনোরা লেখা। স্যারের মেয়ে স্টুডেন্ট বেশি ছিল না। ওটা ছেলেদেরই কাজ। ন্যুড মেয়েকে দেখে তারা যতোটা কামনা অনুভব করতো, ততোটাই করতো সেনোরার অ্যাড দেখে কিংবা নাম শুনে।

সেই জায়গায় কতো বদল হলো, বলুন তো? আজ যখন পাহাড়ি মেয়ে ঢাকায় পড়তে এসে মাকে শেখাচ্ছে সেনোরা ব্যবহার, তখন সেখানে একটাও বাজে কমেন্ট আমি পেলাম না। বরং বিজ্ঞাপনের কন্টেন্ট সবার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।  

সেনোরা কিন্তু পেরেছে! আমাদের দেশের যৌন অবদমন করতে করতে মাসিকের মতো সাধারণ বিষয়কেও সেক্স অবজেক্ট ভেবে ফেলা মানুষের মাথা থেকে কিছুটা হলেও নামাতে পেরেছে। এই সেনোরা, এই মাসিক কোনো যৌন বিষয় না। এ আপনারই মা বোন বা স্ত্রীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। যে বিষয়ের চূড়ান্ত ফল আপনার জন্ম নেওয়া।

আমাদের দেশে পিরিয়ড শুরু হওয়ার এক থেকে চার বছরের মধ্যেই এখনো ৬৮% মেয়ের বিয়ে হয়। ৪০% মেয়ে নিয়মিত স্কুলে যেতে পারে না এই সময়ে। গড়ে ৬ দিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকে নারীরা। মাসিক সাধারণ বিষয় হলেও, এর শারীরিক জটিলতা কম নয়। তাই মাসিকের সময় এক্সট্রা কেয়ার রাখতে হয় নারীর! আর সেটা রাখার দায়িত্ব বাড়ির পুরুষের। তাই পুরুষদেরকে এই বিষয়ে জ্ঞান দেওয়াটা একটা বিশাল দায়িত্ব।

সেই দায়িত্বই কাঁধে নিয়েছে সেনোরা। সেনোরা এখন বলতে পারছে নির্দ্বিধায় , “বাবাও মেয়ের স্যানিটারি প্যাড কিনে দিতে পারে”। এতে লজ্জার কিছু নেই। সেনোরা জানাতে পারছে এখন, “মেয়ের মাসিক মানেই পড়াশোনা অফ নয়। আমাদের মেয়েরা আরও পড়বে”।

কিন্তু এই জায়গায় আসতে সেনোরার হাজার হাজার দিন লেগেছে। তাই যখন মেয়ে আজ মাকে বলে “সেদিন সেরা ভেবে কাপড় দিয়েছিলে, জানলে হয়তো সেনোরা দিতে”। তখন যেন মনে হয় এতোটা লড়াইয়ের ফলে এই প্রজন্মকে পেয়ে সেনোরা আজ সার্থক।

হয়তো আগামী প্রজন্মে মাসিক নিয়ে যত মিথ আর ট্যাবুর বাক্সবন্দী, সবটাই ভেঙ্গে দিবে সেনোরা। আমার ছোটবেলায় সাদাকালো ঝিরঝির টিভিতে দেখা সেই সেনোরা।  

যে বিজ্ঞাপন নিয়ে এতো কথা বলছি সেটার ইউটিউব লিংক: https://www.youtube.com/watch?v=W0VgpsJzQ8Y&list=PLo6zp1Zrikn5mT3uzWZSvyWTe1xo5L6Dp

শেয়ার করুন: