জীবনে সঙ্গী লাগে, মেয়ে তুমি একা থেকো না

শিল্পী জলি: পুলিশ সুপার বাবুল আকতারের স্ত্রী খুন হতেই যে খবরটি এসেছিল তাহলো, আহা সন্তানদের কথা চিন্তা করে তাঁকে হয়তো আবার বিয়ে করতে হবে! 

তাঁর নিয়মিত উপার্জন থাকা সত্ত্বেও আমাদের দরদী সমাজ ভেবেছে,
আহা বউ ছাড়া তাঁর চলবে কি করে?
ঘর সামলাবে কে, আর বাইরে সামলাবে কে?
যদিও কথায় আছে টাকা থাকলে বাঘের চোখও মেলে।
বাবুল আক্তারের বয়স আনুমানিক পঁয়ত্রিশ তো হবেই– অন্তত: জীবন কিছুটা হলেও তিনি দেখেছেন, উপভোগও করেছেন। তারপর স্ত্রীর মৃত্যু হতে না হতেই সমাজ তাঁর বাঁকী জীবন নিয়ে উৎকন্ঠিত। অথচ হুমায়ূন আহমেদ যখন মারা যান তখন তড়িঘড়ি করে শাওনকে দিয়ে যে কথাটি বলিয়ে নেয়া হয়েছিল, বা তিনি নিজে থেকেই যে কথাটি বলেছিলেন, তাহলো জীবনে আর কখনও বিয়ে করবেন না।

কারও মৃত্যুর সময়টি কি ঐ জাতীয় প্রতিশ্রুতি আদায়ের সময়?
নাকি, ওটি হীন উদ্দেশ্য সাধনের পাঁয়তারা?

shilpi-jolley-3
শিল্পী জলি

একজন বড় ভাইকে দেখেছিলাম। সে হাসতে হাসতে যখন তখন এগারো/বার বছরের ছোট ভাইটির প্যান্ট টেনে খুলে ফেলতো। একদিন প্রশ্ন করলাম, এটা কেন করছো, সেতো বড় হচ্ছে , তাকে প্রাইভেসি দাও।
উত্তরে বললো, এমন করলে সে বড় হবে দেরিতে– সহজে প্রেম-প্রীতিতে জড়াবে না। বাংলার অনেক মা-বাবা, ভাই, সমাজ এমন কারসাজি করেন ছেলে/মেয়ের জীবনকে নিজেদের পছন্দমতো করে কন্ট্রোল করতে, আর তার নাম দেন ভালোবাসা বা সভ্যতা।
সম্প্রত, মৌসুমী আক্তার সালমার ডিভোর্স হলো। তার আচার-আচরণ নিয়ে এমপি স্বামী কটাক্ষ করতে না করতেই তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, তার বাকি জীবনটি মা-বাবা, গান, আর মেয়েকে নিয়েই কাটাবেন। ডিভোর্স হতে না হতেই চরিত্রহরণ রোধ এবং সুরক্ষার বা আত্মরক্ষার ঢাল হিসেবে তাকে একথা বলতে হলো, কেন?
তাৎক্ষণিকভাবেই গণমাধ্যমের সামনে সিল দিয়ে পুরো জীবনের প্লান করে ফেলতে হলো তাকে।

অথচ তার থেকে ১০/২০ বছর বড় বয়সী বর একবারও বললেন না যে, তিনি আর বিয়ে করবেন না– বয়স হয়ে গিয়েছে, জীবনে আর বউয়ের প্রয়োজন নেই, অথবা বিয়ে করা বা সেক্সজীবন প্রয়োজনীয় নয়।
অথচ একবার বিয়ে হতে না হতেই আমাদের সমাজ মেয়েদের উপর পরোক্ষভাবে চাপ সৃষ্টি করা হয় যেনো বয়স ১৮/১৯ হলেও মেয়েটি আর জীবনে বিয়ের নাম-গন্ধ মুখে আনার সাহস না করে।

আইনে কোন বাধা না থাকলেও সমাজের চাপ অতি তীব্র, যদিও আমাদের দেশের মেয়েরাই আর্থিকভাবে বেশী পরনির্ভরশীল এবং সঙ্গী ছাড়া হলে বলতে গেলে আশ্রয়হীন। এখনও সমাজে মেয়েরা একা বাস করতে পারে না, হয় তাদের স্বামীর সাথে থাকতে হয়, নয় বাবা-মা বা ভাইবোনের পরিবারের সাথে। তখন তাদের অনেকেরই জীবনটি হয় পরগাছার মতো–অন্যের তালে তালে তাল রাখা।

ওদিকে সময়ের সাথে সাথে বাবা-মা এবং ভাইবোনেরও জীবনযাপনের ধরনও বদলে যায়। নিজেদের জীবন চালাতেই হয়তো তাঁদের তখন হিমশিম খেতে হয়– তখন আদরের মেয়ে বা বোনটি আর কতটুকু আদরের থাকে?
যেখানে পরিবারের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথেই দেখা যায় রক্তের সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও ঘরে ঘরে সম্পদ ভাগাভাগিতে টানাটানি এবং কারচুপি শুরু হয়ে যায়, সেখানে কে কার আশ্রয়?
দেশীয় এমপিদের জীবনযাপন, লক্ষণ, ঘাত-প্রতিঘাত, ক্ষমতা, টিকে থাকা সবকিছু সম্পর্কেই জনগণ কমবেশি ধারণা রাখেন।

torture-7সেখানে বরের হাঁটুর বয়সী সালমার কোনো অন্যায়ে তাকে বিশ ঘাটের পানি না খাওয়াতে পারা অথবা দুনিয়া থেকে উধাও করে দেবার ক্ষমতা না রাখা তো কারও এমপি হবার যোগ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। যেখানে লক্ষ বদমাশের সাথে কাজ কারবার করে তাদেরকে টিকে থাকতে হয়, সেখানে এক সালমার অন্যায়কে হ্যান্ডেল করতে না পারলে এমপিই বা হওয়া যায় কী করে?
তারপরও সালমাদেরকে কেন জাস্টিফাই করতে হয়, সংসার চেয়েছি, ভালোবেসেছি ,গান তো আগেই করতাম, চরিত্র খারাপ নয়, কিন্তু থাকতে পারলাম না!
ভালোবাসার বিয়ে ভেঙে গেলে কোনো একটি ঘাটতির কারণেই ভাঙে। ওখানে মেয়ে পরকীয়ায় জড়ালেও কারণ থাকে। দু’জনার বিয়ে নানা কারণেই ভাঙতে পারে, তাই বলে বিয়ে ভাঙলেই বা বিধবা হলেই মেয়েদের বৈরাগ্যের জীবন হবে, এটা কেমন কথা?

কম বয়সে মানুষের জীবনে একজন সাথী এবং সেক্সের চাহিদা যেমন স্বাভাবিক, তেমনি বৃদ্ধ বয়সে একজন সাথীর প্রয়োজন। জীবনে স্বীকৃত এবং বৈধ চাহিদা স্বীকারও কেন মেয়েদের জীবনে অপমানকর?
যে বর ভালোবাসেনি, ভালোবাসার মূল্যায়ন করেনি, ঘরহারা করতে দ্বিধা করেনি, সেই অতীত ঘটনা কেন একটি মেয়ের জীবনের দিক নির্ধারক হবে?
এখানে ৬০/৭০ বছর বয়সী ছেলেদেরকে যখন দেখি টেস্টোটেরন হরমোন নিয়ে সেক্স জীবন ঠিক রাখছেন, হুটহাট বিয়ে করতে ছুটছেন, তখন মনে পড়ে যায় আমাদের দেশের কম বয়সী শাওনদের কথা, তাদের সঙ্গীহীন, স্বপ্নহীন পথ চলার কথা, দিনশেষে একাকি জীবনের কথা।

স্বামী পুরুষ জীবন ভোগ করে মরে গিয়ে কবরে মিশে গেলেও সেই ঘানি টানতে হয় কত কম বয়সী স্ত্রীদের। যেনো একবার ভুল করে ভালোবেসেছো তো আর নিস্তার নেই–একেবারে ফাঁসির সাজা। শুধু এই কারণেই দেশে অনেক ছেলে বিয়ের পরে আর বউকে তোয়াক্কা করে না। কেননা বিয়ে হতেই তারা উপলব্ধি করে, এখন থাকতে পারলে থাকো, না থাকতে পারলে না থাকো। আমাকে ছাড়া তোমার আর গতি নেই–ভাত জুটলেও একাকি জীবন, পদে পদে খোঁটা, আর তসবি গোণা। নো সেক্স ইন লাইফ।
শুনেছিলাম, লুৎফন নাহার লতার প্রাক্তন বর বাড়ি কেনাবেচা করতে গিয়ে বউ কিনে এনেছিলেন। বিদেশ বিভূঁয়ে কাজ, সংসার, সন্তান, এবং নিজেকে চালাবার দায় তাঁর তখন। জীবনের মাঝপথে ধাক্কা সামলানো–হিমশিম অবস্হা। ধাক্কা ঠিকই সামলেছেন, যোগ্য ছেলে এসে মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছে।

ছেড়ে যাবার সময় তথাকথিত বরটি হয়তো ভেবেছিলেন লুৎফন নাহার লতা আর কোনো জীবনসঙ্গী পাবেন না বাকি পথটুকু চলার। কিন্তু তাঁর সন্তান মায়ের জন্যে বর ঠিক করে এনেছে– বর বিদেশি, কালচার আলাদা, ভাষা আলাদা। হয়তো তাঁর সাহিত্য বোঝেন না, কর্ম বোঝেন না, ভালোলাগা বোঝেন না, কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে তাঁকে মূল্যায়ন করেন, তাঁর সঙ্গকে কদর করেন, নিঃসঙ্গতায় পাশে থাকেন, বিপদে হাত ধরেন।
বিয়ে মানে জীবনে একজন সাথীকে পাশে পাওয়া, লজ্জার নয়।

শেয়ার করুন: