নারীবাদ ও তসলিমা-দুটোতেই পুরুষের দ্বন্দ্ব

চৈতী আহমেদ: অতঃপর আবারও একজন পুরুষকে লেখক হিসেবে খ্যাতি অর্জনের জন্য তসলিমা নাসরিনকে অস্বীকারের প্রাণান্ত চেষ্টায় লিপ্ত হতে হলো। মানে লেখক হিসেবে পায়ের তলার মাটি পাবার জন্য তাকে তসলিমার উপরই ভর করতে হলো। তসলিমাকে গালি দিয়ে কতোজন বিখ্যাত হয়েছে এই বাংলায়, তার ইয়ত্তা নেই। তসলিমার মতো ‘বেশ্যা’কে বিয়ের খায়েস ব্যক্ত করেও তো পত্রিকার পাতায় নাম তুলেছে কতজন।

chaity-2
চৈতী আহমেদ

এই লেখকও বরাবরের মতো তসলিমাকে বাতিল করলেন নারীর আন্দোলনকে বাতিলের ছলনায়। আর তাতেই সঙ্গে সঙ্গে নারীবাদী বৈঠকের ভিত নড়ে উঠলো! তাই কি?

এই বাংলার মানুষ বরাবরই কেউ তসলিমাকে এক হাত নিতে পারলে তাকে পিঠ চাপড়ে না দিলেও অন্তত মুচকি হাসে। ভাবখানা এমন আমরা তো আগেই বলেছি তসলিমা একটা বেশ্যা। যে তসলিমার একখানা গ্রন্থও পুরো পড়েনি, সেও বিজ্ঞ মাথা নেড়ে বলে, আরে ওতো অমুকরে বিয়ে করে তমুকের বিছানায় উঠে আখের গুছিয়েছে। অমুক অমুকের সাথে বেডরুমের কথা প্রকাশ্যে এনে খ্যাতি কুড়িয়েছে।

এগুলোতো পুরোনো কাহিনী, নারীর কুৎসা এই সমাজে বার বার ভেজে খাওয়া যায়।- তসলিমা বিখ্যাত হওয়ার জন্য অমুক অমুক কে বিয়ে করেছে, তমুকের সাথে প্রেম করেছে।
কেউ বলে না, তসলিমাকে গালি দিয়ে কে কে বিখ্যাত হয়েছে। তসলিমাকে বাতিল করতে গিয়ে কে কে লেখক হিসেবে হালে পানি পেয়েছে। লেখাটা পড়ে খুব বিরক্ত লেগেছে। খুব এয়েছেন নারীবাদ বুঝনেওয়ালা। তিনি কয়েলেন, “নারীবাদ নারীদের জন্য আন্দোলন, নারীর আন্দোলন নয়।”

শুনে সবাই বাহ বাহ করতে লেইগে গেলেন। মেইলশভিনিস্ট ঠেঙ্গাড়েরা পোতায়ে গেলেন। নারীর কান্ধে ভর করে তিনি নারীবাদের অশ্বডিম্ব প্রসব করে হাজার লাইক আর চারশো শেয়ার কামায়ে গেলেন।

নারীর ইচ্ছার মুক্তিই হলো নারীবাদ। পদে পদে এঁকে রাখা লক্ষণ রেখা ডিঙিয়ে যাওয়াই হলো নারীবাদ। নিজের ইচ্ছামুক্তির জন্য পুরুষতন্ত্রের দুয়ারে আঁচল পেতে না দাঁড়ানোই হলো নারীবাদ। লেখাটা এতোই গৎবাঁধা ফাঁপা বুলিতে ঠাসা যে তা খণ্ডন করতেও বিরক্ত লাগছে। বিধবা বিয়ে দিয়ে অথবা নারীকে চিতায় উঠতে বাধ্য না করা নারীবাদ এমন সহজ জিনিস নয়।

যখন নারী বলছে -“আমার শরীর আমার ইচ্ছা” তিনি এয়েছেন নারীবাদকে পেছনে ছেচড়ে ‘সতীদাহ রদ’ আর ‘বিধবা বিয়ে প্রচলন’ এর মতো পুরুষের অনুকম্পার কাছে নিয়ে যেতে।
একজন পুরুষকে নারীবাদ বুঝতে হলে ফিরে নারী হয়ে জন্মাতে হবে। নারীবাদ তো নারীবাদ, শুধু তসলিমাকে বুঝতে হলেও ফিরে নারী হয়ে জন্মাতে হবে। তসলিমা এই দেশের মেয়েদের ইচ্ছার বাঁধ খুলে দিয়েছে।

দীর্ঘ লেখা আজ লিখতে ইচ্ছে করছে না। কখনও হয়তো লিখবো। বিভিন্ন কারণে মন খুব বিপর্যস্ত হয়ে আছে। ক’দিন ধরে অনেকে এসে বলে যাচ্ছেন -আপনি কিছু লিখেন। কেউ কেউ উস্কানি দেয়ার চেষ্টা করলেন এই বলে যে-লেখাটাতে ‘জোঁকের মুখে নুন পড়েছে’।

পড়তে গিয়ে দেখলাম তিনি তসলিমার বিশ্বজয়ে মিইয়ে আসা পুরুষতন্ত্রের অসূয়ার আগুন উসকে দিতে গিয়ে শেষটায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন।

ইচ্ছে নারীর, যুদ্ধটাও নারীর, নারীবাদ শুধুই নারীর আন্দোলন। নারীবাদ চর্চা করে বড়জোর পুরুষ আলোকিত হতে পারে, আলো নয়। পুরুষের অনুকম্পার কালিতে নারীবাদের ইতিহাস কখনই রচিত হয়নি, হবেও না। তসলিমা নাসরিনকে পাশ কাটিয়েও আর লেখা যাবে না সেই ইতিহাস।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.