জান্নাতুন নাঈম প্রীতি: ইনবক্সে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা মেসেজ পেলাম। ম্যাসেজ পাঠিয়েছে দ্বাদশ শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থী। সামনে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবে সে।
ম্যাসেজের মূল ভাষ্য হচ্ছে- “আপু, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড অনুমোদিত আমাদের দ্বাদশ শ্রেণীর ‘পৌরনীতি ও নৈতিক শিক্ষা’ দ্বিতীয় পত্রের পাঠ্য বই ও গাইড বই, দুটোতেই দশম অধ্যায়ে ইভ টিজিংয়ের কারণ হিসেবে মেয়েদের ‘অশালীন পোশাক ও বেপরোয়া চালচলন’ এর কথা বলা আছে। আমার পড়তে ভীষণ অসহ্য লাগছে। আমি জানি তুমিই পারবে এর প্রতিবাদ করতে”।
তাকে বললাম- ঠিক আছে, বইয়ের ছবি তুলে পাঠাও। সে সঙ্গে ছবিও তুলে পাঠালো।
আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। হতবাক হয়ে দেখলাম সারাদিন আমরা যারা নারী অধিকার, নারী পুরুষ সমতা নিয়ে গলা ফাটাচ্ছি তাদের চোখের সামনে কী চমৎকার তামাশাটিই চলছে নির্বিবাদে!
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের অনুমতি ও অনুমোদন নিয়ে দ্বাদশ শ্রেণীর বইয়ে কীভাবে এরকম হতচ্ছাড়া একটি লাইন ইভ টিজিংয়ের কারণ হিসেবে থাকতে পারে, তা আমার মাথায় ঢোকে না। তার আগে বলে রাখা ভালো- এই একটি লাইন দিয়েই প্রতিটি ধর্ষণ মামলা, ইভ টিজিংয়ের দায়ে উত্যক্ত হয়ে করা মামলা প্রতিটির আসামীই অপরাধ থেকে বেকসুর খালাস পেয়ে যেতে পারে! কারণ ইভ টিজিং বা নারীকে অন্যায়ভাবে উত্যক্ত করার কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে- অশালীন পোশাক ও বেপরোয়া চালচলন।
খুবই দুঃখের বিষয় ‘অশালীন পোশাক’ নামের অজুহাতে তনু থেকে শুরু করে খাদিজা- প্রতিটি ঘটনার অপরাধীর হাতে একটি সোনার কাঠি তুলে দেয়া হলো। এবং সেখানে আরও চমৎকার একটি অজুহাত হচ্ছে- বেপরোয়া চালচলন। মানে তনুকে হত্যা করা হত্যাকারীটি বা খাদিজাকে কোপানো অপরাধীটি যদি প্রমাণ করতে পারে- তনু ও খাদিজা অশালীন পোশাক পরেছিল, তাহলে সেটা ‘হালাল’ করার জন্য আইন আদালতের কাছে যাবার আগে এখন শিক্ষা বোর্ডের কাছে যেতে হবে!
কারণ শিক্ষাবোর্ড অনুমোদিত এই বই দশ লাখেরও বেশি উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের হাতে গিয়েছে। যেখানে পই পই করে বলে দেয়া আছে- অশালীন পোশাক হচ্ছে ইভ টিজিংয়ের কারণ!
ইভটিজিংয়ের কারণ হিসেবে দ্বিতীয় বিশেষণ হচ্ছে- বেপরোয়া চালচলন।
মানে আপনি যদি কর্মক্ষেত্র থেকে দেরি করে বাসায় ফেরেন, তখন শুধু বাসার পুরুষ প্রতিনিধিটির অথবা সমাজের ‘দেরিতে বাসায় ফেরাকে পুঁজি করে নারীর চরিত্র নিয়ে কথা তোলা গোষ্ঠী’টির চোখ রাঙানিই সহ্য করতে হবে না, সাথে সহ্য করতে হবে- বোর্ড বইয়ের বলা লাইনটিও। যেখানে চমৎকার করে নারীকে উত্যক্ত করার কারণ হিসেবে বলে দেয়া হয়েছে- বেপরোয়া চালচলনের কথাটি!
এখন জানা দরকার ‘অশালীন পোশাক’-এর সংজ্ঞাটি ঠিক কী?
ছোটো জামা?
বুকে ওড়না না দেয়া?
শরীরের কোনো অংশ বাইরে বেরিয়ে থাকা?
শিক্ষাবোর্ড নামের প্রতিষ্ঠানটি অথবা যারা এই বইয়ের অনুমোদন দিয়েছে চোখ বন্ধ করে, তারা কী দয়া করে ব্যাখ্যা দেবে- ‘অশালীন পোশাক’ বিষয়টি ঠিক কী?
গতবছর জার্মান একটি মেয়ের সাথে একবার কথা হয়েছিল। যে মেয়েটি খুব সাহস নিয়ে বলেছিল- যদি আমি কোনো পোশাক না পরেও বাইরে যাই, কারো অধিকার নেই আমাকে উত্যক্ত করবার। কারণ মানুষ হিসেবে আমি স্বাধীন, আমার পোশাকের স্বাধীনতাটিও আমার হাতেই। আমি কী পরবো তা একান্তই আমার ব্যক্তিগত। এটি নিয়ে কথা বলবার, উত্যক্ত করবার, হয়রানি করবার অধিকার কারোর নেই।
মেয়েটিকে আমিও গর্ব নিয়ে বলেছিলাম- এদেশের মেয়েদের প্রধান পোশাক ‘শাড়ি’ নামের একটি বারো হাত মাপের সেলাইবিহীন কাপড়। যেটি মেয়েরা একাধিক বিশেষ ভঙ্গিতে পরে থাকে।
এখন আমার গর্বের কথাটির কী হবে?

-২০১৫ সালের পহেলা বৈশাখে যে মেয়েটির শাড়ি টান দিয়ে খুলে ফেলেছিল কিছু নোংরা হাত, মেয়েটিকে লাঞ্ছিত অপমানিত করেছিল, তারা কী এখন অজুহাত দেবে না যে মেয়েটি অশালীন পোশাক পরেছিল? যে পোশাকটির সেলাই ছিল না, যেটি টান দিয়ে খুলে নেওয়া যায়!
সেক্ষেত্রে- অশালীন পোশাকের সংজ্ঞা হিসেবে খুব চমৎকার একটি যুক্তি হতে পারে খোদ বাঙালিয়ানার প্রধান নিদর্শনগুলির অন্যতম শাড়িটিই! অন্যান্য পোশাক, যেমন- সালোয়ার কামিজ, প্যান্ট, জিনস, টিশার্ট, ফতুয়া, ওড়না, স্কার্ট, গাউন…ইত্যাদির কথা ছেড়েই দিলাম।
অর্থাৎ, পোশাকের অজুহাতে ইভ টিজিংয়ের মতন একটি জঘন্য অপরাধ, ধর্ষণের মতন একটি স্পর্শকাতর অভিযোগকে অপরাধ করেও অতি সহজেই ডিঙিয়ে যাওয়ার অজুহাতটি শিক্ষাবোর্ড অনুমোদিত বই পড়তে বাধ্য হওয়া কয়েক লাখ শিক্ষার্থীর হাতে দিয়ে দেয়া হয়েছে!
এমনকি উচ্চ মাধ্যমিকে পড়া একটি ছেলেও তার মেয়ে সহপাঠীটিকে উত্যক্ত করে, কুরুচিকর মন্তব্য করে, যৌন নিপীড়ক শব্দ বলে খুব সুন্দর করে অজুহাত দিতে পারবে- ওটা তো বইয়েই লেখা আছে! তুমি একটি অশালীন পোশাক পরেছো! কাজেই তোমাকে ইভ টিজিং আমি করতেই পারি! ওই পারমিশন খোদ বইয়েই আছে… পৌরনীতি ও নৈতিক শিক্ষা বইয়ে!
ব্যাস! আর কি লাগে… সঙ্গে যুক্ত হয়েছে- বেপরোয়া চালচলন। বাংলাদেশের সংবিধান মতে নারী পুরুষের চালচলন আলাদা কতটুকু কী হবে সেটি কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নারীর জন্য যতটুকু স্বাধীনতা, পুরুষটিরও ঠিক ততটুকুই স্বাধীনতা। কিন্তু স্বাধীনতাটুকুর দেয়াল তুলে দিতে ‘বেপরোয়া চালচলন’ লাইনটি খুবই কার্যকর। লাইনটি দিয়ে এক ধাক্কায় বলে দেওয়া যায়- তুমি বেপরোয়া চালচলন করছিলে! কাজেই তোমাকে যদি উত্যক্ত করে থাকি, তো ভালোই করেছি। ওটা শিক্ষারই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ!
কতটুকু দৃষ্টিশক্তিজনিত সমস্যা থাকলে একটি শিক্ষাবোর্ড, একটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ও অনুমোদন পাওয়া বইয়ে এরকম ভয়াবহ একটি লাইন থাকতে পারে সেটি আমার মাথায় ঢোকেনা। এই শিক্ষাবোর্ড অনুমোদিত শিক্ষা সম্বলিত শিক্ষার্থীরা সেই বিদ্যার্জিত জ্ঞান নিয়ে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবে, তারাই যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটা র্যাগিং, ইভ টিজিংয়ের মতন অপরাধের অভিযোগগুলিকে কোনোরকম পাত্তা দেবে না, মেয়েদের উত্যক্ত করার বিষয়টি শিক্ষার মাধ্যমে বৈধ বলে ভাববে না, তার গ্যারান্টি কী?
এই বিদ্যা নিয়ে পৃথিবীর যেখানেই যাক সেখানেই নারীকে পণ্য, উত্যক্ত করার একটি মোক্ষম প্রাণী বলে ভাববে না তার গ্যারান্টি কী? এই শিক্ষা নিয়েই বাড়ির বৌকে পেটাবে না, বাসে ট্রেনে ভিড়ের মাঝে মেয়েদের গায়ে হাত দেয়াকে বৈধ বলে ভাববে না, তারই বা গ্যারান্টি কী?
ধর্ষক বা ইভটিজার কী শুধু সমাজের একটি বিপথগামী বখাটেদের গোষ্ঠীকে বলে দায় সেরে নেওয়া যাবে এরপর? শিক্ষা ব্যবস্থাই তো ইভ টিজার আর ধর্ষণে আগ্রহীদের কারখানা! এই কারখানাটির মালিকানা নিয়ে কারা গর্বিত হবেন? শিক্ষাবোর্ড নাকি শিক্ষা মন্ত্রণালয়?
আমি ঠিক জানি না!
আপনারা কেউ জানলে- আমায় জানাবেন প্লিজ!