ইশরাত জাহান ঊর্মি: লাগেজ তোলার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। বেল্ট নাম্বার ওয়ান। মেয়েকে কদিন দেখিনি। মগ্ন হয়ে ওর কথাই ভাবছিলাম।

: আর ইউ বাংলাদেশী?”
আচমকা একদম ঘাড়ের কাছে প্রশ্নটা শুনে অন্যমনস্ক আমি দারুণ চমকাই। অলমোস্ট বাঙালী চেহারার ভদ্রলোক কেন ইংরেজিতে আমারে কেন প্রশ্ন করলেন আমার মাথায় ঢোকে না। বলি, ইয়েস! আমার বিস্ময় দেখে ভদ্রলোক কাঁধ শ্রাগ করে বলেন,
: আ’য়াম জাস্ট আস্কিং।
আমি জানতে চাই, আপনি কোথা থেকে?
(এই প্রশ্ন করাই বোধ হয় কাল হলো) তিনি বলেন, দিল্লী। তারপর জানালেন, বিদ্যুত বিষয়ক সরকারি কোনো একটা প্রজেক্টে কাজ করতে ঢাকায় এসেছেন। বললেন, আপনার ফোন নাম্বার পেতে পারি? ততোক্ষণে আমার লাগেজ চলে এসেছে। বেল্ট থেকে গাব্দা-গোব্দা দুইটা লাগেজ ট্রলিতে তুলতে তুলতে আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না লোকটা কেন ফোন নম্বর চাইছেন। আমি বলি,
: কেন?
তিনি বলেন, না আমি বিদেশী, আর এখানে কোনো বন্ধু-বান্ধব নেই…
বিদেশী একজন লোক আমার ফোন নম্বর চাইছেন, হয় আমি না বলার মতো স্মার্ট এনাফ নই, অথবা খানিকটা গাধা। তাই ব্যাগ হাতড়ে কার্ড দেই। তিনি জানতে চান, আমি হোয়াটস অ্যাপ এ আছি কীনা। নাই শুনে বললেন, ভাইবার? জ্বী, আমি ভাইবারে আছি।
চলে এলাম। এবং বাড়ি পৌঁছানোর খানিক পর থেকেই তার ম্যাসেজ পেতে শুরু করলাম। কী ম্যাসেজ বিস্তারিত বলছি না। শুধু এটুকু বলি, তিনি ধরেই নিয়েছেন, তিনি বললেই আমি তার সাথে দেখা করবো, বন্ধুত্ব (?) করবো এবং পরবর্তী ধাপে যাবো। “পরবর্তী ধাপ” আশা করি পাঠক বুঝতে পারছেন।
এর খানিক আগে কলকাতা এয়ারপোর্টে ডিউটি ফ্রি শপে আমাকে কেনাকাটা করতে দেখে এবং বাংলায় কথা বলতে দেখে একজন জানতে চাইলেন, কোন ফ্লাইটে যাচ্ছি? উত্তর দিলে জানা গেল, তিনিও একই ফ্লাইটে ঢাকা যাচ্ছেন। গুলশানে থাকেন। বললেন,
আপনি কি কোন টেলিভিশনে কাজ করেন? চেনা চেনা লাগে!
টেলিভিশনে কাজ করি এবং টিভির নাম শুনে তিনি জানালেন, আমার টেলিভিশনের মালিকের ছেলে তার বন্ধু ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি জানালাম, আমি সাধারণ স্টাফ, মালিকের ছেলেদের সাথে আমার পরিচয় নাই। তো, দু’একটা কথার পর তিনি খুবই কাঁচুমাচু হয়ে জানতে চাইলেন,
: কিছু মনে করবেন না, আপনি কি বাই রিজিয়ন হিন্দু?
আমি বলি,
: না, মুসলিম। কেন?
তিনি খুবই বিব্রত হয়ে বলতে লাগলেন, না না এমনি। আপনারে দেখে মনে হলো হিন্দু, তাই…..।
আমারে দেখে কী কারণে হিন্দু মনে হলো তার, আমি কিছুতেই ধরতে পারলাম না। শরীরের কোথাও তো হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানের কোনো চিহ্ন থাকে না, তবে?
অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো এবার। ইন্ডিয়ার যে স্টেটে সেমিনারে গিয়েছিলাম, ৩৫টা দেশ থেকে ডেলিগেশন এসেছিল, বেশিরভাগই ইউরোপ আর কিছু এশিয়ার দেশ থেকে। সাংবাদিক, ট্যুর অপারেটর। আমাকে অন্তত: তিনজন জিজ্ঞাসা করলেন,
: তুমি মুসলিম?
একজন এও জানতে চাইলেন, তাইলে যে হিজাব পরো নাই!
তব্দা খাওয়ার দশা। খুব বেশি বিদেশ ঘোরার অভিজ্ঞতা আমার নেই। কয়েক বছর আগে ইউএসএ গিয়েছিলাম, তখন কিন্তু এরকম কোন প্রশ্ন শুনিনি। একা একা এর আগে ইন্ডিয়া গিয়েছি অফিসেরই প্রোগ্রামে, তখনও এরকম কোনো প্রশ্ন শুনি নাই।
এখন কী হলো? কোথাও কি কিছু বদলে গেছে? ফেসবুকের বন্ধু বিদেশে থাকা তিনজন নারী এবং একজন পুরুষের সাথে কথা বললাম। নারীদের একজন বললেন, তার এরকম কোনো অভিজ্ঞতা হয়নি। তবে এও বললেন, তার ওঠাবসা প্রগতিশীল মানুষজনের সাথে। বাকী দুজন জানালেন, হিজাব না থাকলেই মুসলমান না ভাবা, এইগুলা ইদানিং শুরু হয়েছে।
আমার ধারণা ছিল, বাংলাদেশের কালচারাল ডাইভার্সিটি, ধর্ম নিয়ে খুব কনসার্ন না থাকা, এইসব বিদেশীরা পছন্দ করে। কিন্তু কবে থেকে বাইরের লোকজন আমাদের জাস্ট সৌদি আরব বা ইয়েমেন বা ইরাক-ইরানের দেশের মানুষের মতো “জাস্ট মুসলিম” ভাবতে শুরু করলো, সেটা বেশ আগ্রহ উদ্দীপক এবং একইসঙ্গে বেদনার।
মডারেট মুসলিম কান্ট্রি থেকে তবে কি আমরা কট্টর মুসলিম কান্ট্রি হয়ে উঠছি? সেজন্যই আমার মাথায় হিজাব না দেখে তাদের বিস্ময়?
ধর্মের কথা বাদই দিলাম। উইম্যান এমপাওয়ারমেন্ট, নারীর এগিয়ে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে আমরা অনেক আহ্লাদ করি, কিন্তু আসলে কী চোখে এখন দেখছে আমাদের বহি:বিশ্বের মানুষ?
এয়ারপোর্টে একটা একলা মেয়েকে দেখে একজন বিদেশী ভাবছেন এই মেয়েটা ইজি গোয়িং। যেহেতু সে হিজাব করছে না, অতএব তাকে এধরনের ম্যাসেজ পাঠানো যায়! অন্য কোনো দেশের মেয়ে, ধরেন ইউরোপ বা আমেরিকা বা অন্য কোনো উন্নত দেশের মেয়ের ফোন নম্বর চেয়ে এবং কড়া বা সতর্ক রিপ্লাই পাওয়ার পরও কি কোনো পুরুষ মেয়েটাকে নিয়মিত ম্যাসেজ পাঠানোর সাহস করতো? বলতেই পারেন যে, এটা খুব একতরফা এবং একটা একক অভিজ্ঞতা মাত্র। দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে একলা কাজ করা, ট্রাভেল করা বাংলাদেশী নারীদের সাথে এই অভিজ্ঞতা নাও মিলতে পারে।
জানি না দুনিয়ার খারাপ অভিজ্ঞতাগুলো আমারই কেন হতে হবে! তবে শুধু এয়ারপোর্ট কেন, নাগাল্যান্ড এর পাহাড়ে বসে অসম্ভব অতিথিপরায়ণ নাগা পিপল এর বানানো লোকালি মেইড ওয়াইন খেতে খেতে সহযাত্রী স্পেনের স্বল্পভাষী হোসে বলেন, ঊর্মি তোমার দেশ সম্পর্কে বলো।
আমি মুখে ফেনা তুলে তুলে, ইংরেজি জ্ঞান যতটা আছে তা খাটিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলি। হেরিটেজ সম্পর্কে বলি, পহেলা বৈশাখ নিয়ে বলি, আদিবাসীদের কথা বলি, গণতন্ত্র আর উন্নয়নের কথা বলি, নারী স্বাধীনতার কথা বলি (বেশিরভাগই অর্ধসত্য, তবু বলতে ভালো লাগে)।
বুড়ো সব শুনেটুনে শান্ত গলায় বলে, কিন্তু তোমরা তো মুসলিম কান্ট্রি তাই না? আর আমরা ইউরোপীয়ানরা ভাবি, অল মুসলিম কান্ট্রিই এক। তোমাকে দেখে আমি তাই অবাক!”
নানান সূচকে এগিয়ে থাকা নারী ক্ষমতায়নের এই দেশের একজন নারীকে এখন অনেকেই তাহলে এভাবে দেখছেন? তারা ভাবছেন, আমাদের সমাজ রক্ষণশীল। ভাবছেন, যারা পর্দা করছেন না, তারা নিশ্চয়ই মুসলিম না। হায় আমাদের ধর্ম এবং আমাদের কালচার এসবকিছুর দারুণ মিশেল নিয়ে আমাদের গর্ব ছিল কত!
প্রার্থনা করি, আমার এইসব অভিজ্ঞতা শুধুই আমার একলার। এবং ভুল অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশ, বাংলাদেশের নারীদের আশা করি বাইরের বিশ্ব ধর্ম এবং ধর্মের কারণে আটকে থাকা মানুষ বলে ভাবে না। আমাদের এগিয়ে যাওয়া আশা করি দেখতে পায়, আমাদের ক্ষমতায়নের যে গল্প আমরা বলি, আশা করি তা তারা বিশ্বাস করে। আই উইশ!