জার্নি বাই পাবলিক বাস এন্ড মাই ইমোশনস

আফরিন শরীফ বিথী: পাবলিক বাসে চড়তে গিয়ে আমরা মেয়েরা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হই। যেসব সমস্যায় পড়ি তা কম বেশি সবারই জানা। অনেকের কাছে এটা এক ভয়ংকর যাত্রা। লেখাটা পূর্ণাঙ্গ করতে সেসব সমস্যা একটু তুলে ধরতে হচ্ছে।

এই লেখায় আমি আমার সমস্যা এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাই বলছি। কারণ পাবলিক বাসে চড়া একজন নারী হিসেবে আমার মাধ্যমেই সব নারীর অবস্থাটা বেরিয়ে আসবে বলে আশা করছি। ও হ্যাঁ বলে রাখাটা প্রয়োজন মনে করছি, প্রতিদিন রিকশা অথবা সিএনজি চড়ে যাতায়াতের সামর্থ্য আমাদের নাই।

4প্রথমত, অফিস শেষে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকি। কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় তার কোনো সময়সীমা নেই। আশেপাশের বেশিরভাগ মানুষই থাকে পুরুষ। বাস আসে। পুরুষেরা ধাক্কাধাক্কি করে যে যেভাবে পারে বাসে উঠে যায়। তখন আমাকে হয় তাকিয়ে তাকিয়ে তা দেখতে হয়, নয়তো ঐ ভীড়ের মধ্যেই ধাক্কাধাক্কির প্রতিযোগিতায় নামতে হয়।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণই করতে পারি না। কারণ সিট নাই বলে আমাকে আগেই বাতিল ঘোষণা করা হয়। ভদ্রস্থভাবে মান-সম্মান নিয়ে বাসায় ফিরতে সিটের আশায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবো, নাকি ভীড়ের মধ্যেই বাসে উঠবো, আমাকে ভাবতে হয়।

ঠিক আছে দাঁড়িয়েই রইলাম। এক ঘণ্টা হয়ে যায়, দুই ঘণ্টা হয়ে যায় সিট পাওয়ার আশা করা তো দূরের কথা, পর্যাপ্ত জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়ারও কোন উপায় থাকে না। আশেপাশের উৎসুক পুরুষেরা জিজ্ঞেস করতে শুরু করে কোথায় যাবেন। উত্তর দিতে ক্লান্তি লাগে। কখনো উত্তর দেই, কখনো দেই না। উত্তর না দিলে আবার পাগল ভাবে। কী জ্বালা! অবশেষে অত পুরুষের ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকেই বাসায় আসার সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

দ্বিতীয়ত, অনুনয়-বিনয়ের পর যখন হেলপার বাসে উঠতে দিতে দয়া করে কেবল তখনই উঠতে পারি। কোনমতে উঠি বাসে। শুরু হয়ে যায় পুরুষ প্যাসেঞ্জারদের হেলপারকে ধমকাধমকি। মহিলা সিট নাই, কেন উঠালো আমাকে? আমি বলি, দাঁড়িয়েই যেতে পারবো। তাদের উত্তর, আমাদের তো দাঁড়াতে সমস্যা হচ্ছে।

কী বলবো তখন তাদের! পাবলিক বাসে ঝগড়া করাটা বড্ড অশোভনীয় দেখায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলি, একটু কষ্ট করেন, রাত বাড়ছে, বাসায় তো যেতে হবে। মাঝে মাঝে দু একজনকে পাওয়া যায়, যারা সহমর্মিতা দেখায়। ঠিকমতো দাঁড়াতে জায়গা করে দেয়। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় তখন চোখে পানি চলে আসার উপক্রম হয়। কী জ্বালা!

14355750_1215277518528915_829526233485027059_n
আফরিন শরীফ বিথী

তৃতীয়ত, বাস থামলো এক স্ট্যান্ডে। একজন মহিলা তার বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে বাসে উঠার খুব চেষ্টা করছে। হেলপার উঠতে দিবে না। সে এক প্রকারের হাতে পায়ে ধরেই উঠলো। কয়েকজন তীব্র প্রতিবাদ শুরু করে দিল, হেলপারকে ধমকাধমকি, কেন উঠালো মহিলাকে। এতো কষ্ট করে দাঁড়িয়ে যাবে মহিলাটি, এটা তারা মানতে পারছে না। আমি কথা না বলে পারলাম না। বললাম, এত মায়া আপনাদের! রাস্তায় যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো সেটা ভেবে মায়া লাগছে না? সে দাঁড়িয়ে যেতে পারবে বলেই উঠেছে।

কেউ আর তখন কথা বলল না। বাচ্চা মেয়েটাকে একটা ছেলে কোলে বসালো। ছেলেটার প্রতি কৃতজ্ঞতায় চোখে পানি চলে আসলো।

এই যে হাস্যকর মায়া আপনাদের এটা আপনারা কেন বুঝতে পারেন না! একটা মেয়ে যে সিটের অপেক্ষায় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে, হুস করে কোন মাইক্রোবাস এসে তাকে টুক করে তুলে নিয়ে যাবে না এতোটা নিশ্চিত আপনারা কী করে হোন! কেন যমুনা ফিউচার পার্কে চাকরি করা এক আদিবাসী মেয়েকে যে চিলের মতো এসে একটা মাইক্রোবাস তুলে নিয়ে গেল, সেটা ভুলে গেছেন! নাকি তাতে আপনাদের কিছু যায় আসে না! এতোটা খারাপ কিন্তু আপনাদের মনে হয় না।

চতুর্থত, একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা বাসে উঠলো। বাসের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়েছিল। সে বার বার পিছনে দাঁড়ানো লোকটার প্রতি অভিযোগ করছিল, কেন তার গায়ে এসে পড়ছে বার বার। লোকটা ক্ষেপে গেল। বললো, আমি ইচ্ছে করে তো পড়ছি না। বাস ব্রেক করলে, আর পিছন থেকে ধাক্কা দিলে অাপনার সাথে ধাক্কা লাগছে, আমি কী করবো!

আমিও বুঝতে পারছিলাম লোকটা ইচ্ছে করে করছে না। আমার সাথেও এমনটা ঘটে। কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। বললাম, আন্টি ইচ্ছে করে ধাক্কা দিলে বোঝা যায়। তখন ছাড়বেন না। আর অনিচ্ছাকৃত হলে তো কিছু করার নেই। আর লোকটাকে বললাম, ইচ্ছে করে করছেন না বুঝতে পারছি, কিন্তু কষ্ট করে একটু নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবেন।

এই যে প্রতিদিনের এমন পরিস্থিতি, কী সমাধান আছে এর? লোকগুলো যদি ক্ষেপে গিয়ে বলে, গায়ে লাগলে সমস্যা তাহলে পাবলিক বাসে এতো ভীড়ের মধ্যে উঠেছেন কেন? হেলপার যদি বলে এজন্যই তো উঠাতে চাই না। কী উত্তর আছে তখন! বস্তুত প্রতিদিনই তারা এমন বলে। বলাটা যৌক্তিক। আমি নিজেই মাঝে মাঝে কিছু মেয়ের উপর বিরক্ত হই। কারণ তারা দেখে শুনেই ভিড়ের মধ্যে একটা পাবলিক বাসে উঠেছে। অথচ তাদের হাতের সাথে কেন টাচ লাগলো, পায়ের সাথে কেন লাগলো, এমন অহেতুক অভিযোগ করতে থাকে। অত ভিড়ের মধ্যে অনিচ্ছাকৃতভাবে একটু লাগবেই, সেটা মেনে নিতে না পারলে সে কেন পাবলিক বাসে উঠেছে, এই প্রশ্ন অযৌক্তিক নয়।

এই যে দেশের পরিবহন ব্যবস্থার সমস্যার জন্য যে আমাদের ভুগতে হচ্ছে এর সমাধান কি আমরা করতে পারবো! পারবো না। নারীদের জন্য আলাদা বাস সার্ভিসের একটা প্রসঙ্গ উঠেছিল। এই সমতার বিপ্লবের যুগে সেটা কতোটা যৌক্তিক!

তাই পুরুষদের ইচ্ছেকৃত নোংরামির প্রতিবাদ করার সাথে সাথে আমাদেরও মানসিকতা বদলাতে হবে। সমস্যা হচ্ছে, একজন নারীর সাথে একজন পুরুষের ধাক্কা লাগলে বা শরীরের সাথে শরীর লাগলে পুরুষরা কখনো অভিযোগ করে না। হয়তো তাদের অস্বস্তি লাগে না। কিন্তু আমাদের অস্বস্তি লাগে। তাই আমরা অভিযোগ করি। এরকম নিরুপায় পরিস্থিতিতে যখন কারোরই দোষ না, তখন কি আমাদের অস্বস্তি কাটানো উচিৎ না? অবশ্যই উচিৎ। নাহলে চলবে কী করে! আমাদের তো রাজপথে নামতে হবে, কর্মস্থলে যেতে হবে।

পঞ্চমত, একজন বয়স্ক নারী বাসে উঠেছে। কেউ তাকে বসতে দিচ্ছে না। আমি উঠে বসতে দিলাম। তার দোয়ায় আমি দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে যাওয়ার যোগাড়। যাহোক আবার চোখে পানি চলে আসার সম্ভাবনা দেখা দিল। কী জ্বালা!

এই যে একজন বয়স্ক নারী, তাকে বসতে দেয়ার জন্য কি আমাদের নারী-পুরুষের সম অধিকারের যুক্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে! একজন বয়স্ক পুরুষের বেলায়ও আমি উঠে বসতে দেই। অনেক মেয়ে ঠিকমতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, পড়ে যায়। কখনো দেখা যায়, একজন অথবা দুজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাস ব্রেক করলে সব পুরুষেরা তাদের উপর এসে পড়ছে। ওদের তখন ভীষণ অস্বস্তিতে পড়তে হয়। এটা খুবই স্বাভাবিক এবং যৌক্তিক। তখন কোন পুরুষ যদি সিটটা ছেড়ে দিয়ে বসতে দেয় সেটার জন্য কোনো তর্ক-বিতর্কে যাওয়ার দরকার হয় কি! আমার মনে হয়, হয় না।

ষষ্ঠত, একদিন ঘটলো ভয়ঙ্কর বিস্ময়কর ঘটনা! একজন পঙ্গু মানুষ ক্রাচে ভর করে বাসে উঠলেন। কেউ তাকে বসতে দিচ্ছে না! আমি ছিলাম ড্রাইভারের পাশের মহিলা সিটে বসা। অবস্থা দেখে লজ্জায় মরে যাওয়ার যোগাড়! তাড়াতাড়ি উঠে বসতে দিলাম। কয়েকদিন আগের ঘটনা। খুবই বৃদ্ধ এক নারী বাসে উঠতে পারছে না। আরেকটা মেয়ে বাসের হেল্পারদের অনুরোধ করছিল তাকে বাসে উঠিয়ে দেয়ার জন্য। হয়তো মেয়েটা নিজে সাহস পাচ্ছিল না। আমি বললাম, আমাকে দিন। আমি বৃদ্ধার হাত ধরে জ্যামের মধ্যে রাস্তার মাঝখানে ২৭ নাম্বার বাসে উঠলাম। বাসের সবাই ভেবেছে আমি বৃদ্ধার নাতনি। এতো রিস্ক নিয়ে, সাহস করে বৃদ্ধার হাত ধরে বাসে উঠেছি বলে অনেকেই বাহবা দিল।

আমাদের পাশের লোকটা বৃদ্ধার সাথে কথা বলছিল। সে যখন শুনলো আমি বৃদ্ধার কেউ না, অবাক হলো খুব। তাদের দুইজনের দোয়ায় আমার ছোটখাটো চাকুরিটা চলে যাওয়ার সম্ভানা দেখা দিল। ইয়ে মানে তারা আমার অনেক বড় চাকরির দোয়া করছিল।

এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক একটা বড় পুটুলি নিয়ে বাসে উঠলো। হেলপার ও আমি তার সাথে কথা বলছিলাম। হেলপার তার ভাড়া চাইলো, সে নির্দ্বিধায় পাঁচ টাকা বের করে দিল। আমি বললাম, টাকাটা না নিলে হয় না? হেরপার টাকাটা ফিরিয়ে দিল। ফিরিয়ে দিয়ে তার মুখে যে প্রশান্তির ছায়া দেখলাম, সারাদিন ভাড়া তুলেও মনে হয় না তার এতো শান্তি লেগেছে।

মহিলা সিটে একা বসে আছি। পাশের সিটগুলো খালি। দুইটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। দ্বিধা করে বসছে না। বললাম, এখানে বসেন, ওরা বসলো।

এখন বলবো সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনাটা। মহিলা সিটে বসে আছি কয়েকজন। দুইজন নারী সাতদিনের একটা বাচ্চা নিয়ে বাসে উঠলো। বাচ্চা কোলে মহিলাটি ইঞ্জিনের সিটে বসলো, ওখানে জায়গা একটু বেশি ছিল, আমরা চাপাচাপি করে বসেছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল ওখানেই ভাল করে বসতে পেরেছে। তাই আমি আমার সিট অফার করিনি।

কিন্তু ঐ মহিলাটি আমার পাশের মেয়েটাকে বিনয়ের সাথে বললো তাকে বাচ্চাটা নিয়ে ওর সিটে বসতে দিতে, ওখানে বসতে তার সমস্যা হচ্ছে। মেয়েটা যে কতোটা ভয়ঙ্কর সুরে রুক্ষভাবে না বললো, তা না দেখলে বিশ্বাস করার কথা না। বিস্ময় নিয়ে ওর মুখের দিকে তাকালাম। ওকে ঠিক একটা ডাইনির মতো লাগলো আমার ওই মুহূর্তে। আমি ওই নারীকে আমার সিটে বসতে দিলাম। ড্রাইভারকে বললাম, একটু সাবধানে চালাতে, বাচ্চাটা বমি করছিল। হেলপার, ড্রাইভার দুজনই বিরক্ত হলো। বললো, এটুকু বাচ্চা নিয়ে এই বাসে কেন উঠেছে? অথচ মহিলা দুজনকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল গাজীপুর সিএনজি নিয়ে যাওয়ার মতো সামর্থ্য তাদের নেই। ওদের তিনজনকেই একটা করে চড় দিতে ইচ্ছে করছিল।

এই ঘটনাগুলো বলার কারণ আমার বাহাদুরি দেখানো না, বরং এই যে এতোটুকু মানবতা দেখাতে কি আমাদের নারীবাদী-পুরুষবাদী তর্কে যাওয়ার দরকার হয়! এটুকু করতে পেরে আমরা যে প্রশান্তির অাবেগের ভেলায় ভাসি, সেজন্য কি কোনো হিসেব নিকেশের প্রয়োজন পড়ে!

এসব অবুঝ বর্বর পুরুষগুলোর প্রতিবাদ না করে আমি কীভাবে পারবো! আর এই যে ন্যাকা মেয়েগুলোর পক্ষ আমি কীভাবে নেব!

জাগ্রত হোক বিবেক বুদ্ধির, জয় হোক মানবতার।

শেয়ার করুন: