তন্ময় কুমার হীরা: অশ্লীলতা সম্পূর্ণ মানসিক। এক নির্বোধ বিচারের নাম পোশাকের মানদণ্ডে শ্লীলতা বিচার। পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতায় পুরুষের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু আজো নারীর শরীর। খুবই স্পর্শকাতর পুরুষ নারীর শরীর ও পোশাকের ব্যাপরে। আবহমান কাল থেকে বাঙলায় নারী যে পোশাক পরে আসছে তা আসলে পুরুষতান্ত্রিক পোশাক।
আজকাল নারীরাও এই সহজ সত্যটি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হচ্ছে যে – যে পোশাক তারা পরছে, বা পরে গর্ববোধ করছে তা আদতে পুরুষতন্ত্রের গন্ধযুক্ত পোশাকই। পুরুষ শাড়ীকে করেছে নারীর পোশাক দীর্ঘদিন থেকে। নারীকে একটি অচল জড় সুন্দর পুতুলে পরিনত করতে শাড়ির জুড়ি নেই। নারীর চঞ্চলতা ধূর্ত পুরুষ পছন্দ করে নাই কালে, আজও করছে না, হয়তো করবে। দুরন্ত চঞ্চল নারীকে শান্ত স্নিগ্ধ কোমল রমনীতে (নারীতে নয়) পরিণত করতে এরূপ পোশাকের বিকল্প নেই। নারীকে স্বল্পবসনা দেখলে সংখ্যাগুরু কামুক পুরুষের কামানল দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে।
পুরুষ তাই নারীর স্বল্প বসন পছন্দ করে না, বসনহীনতা তো দূরের কথা। নারী, পুরুষের মতে, এমন পোশাক পরিধান করবে যাতে তার পা, হাত, পেট, স্তন-এগুলো দৃশ্যমান না হয়। কেননা পাছে তাতে যৌনব্যাধিগ্রস্থ পুরুষগুলোর দ্রুত রেতপাত হয় অথবা তাৎক্ষণাৎ বীর্যস্খলনজনিত আপৎকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলায় নারীর জননাঙ্গে অন্যায় দখল নিতে চায়।
সিংহভাগ বাঙালি পুরুষ, এবং একাংশ বাঙালি নারী, এমনকি কিছু আপাত নারীবাদী বাঙালি নারীও মননে এই ধারণা পোষণ করে যে নারীকে পোশাকের শালীনতা বজায় রেখে চলতে হয়। ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাকই দায়ী – খোদ নারীবাদী নারীরাও এ ধারণা লালন করে আজও মননে।
অনেককেই বলতে শুনি নারী স্বাধীনতা মানেই কি নগ্নতা? তাদের জন্য বলি- পোশাকের স্বাধীনতা নারী স্বাধীনতার সম্ভবত সবচেয়ে বড় অংশ। পুরুষ যদি নারীর শরীরের ওপর থেকে নিজেদের অন্যায় দখল তুলে নেয় তবে নারী হয়ে পড়বে প্রায় স্বাধীন। আগেই বলেছি পুরুষের রাজনীতি নারীদেহকেন্দ্রিক, গুরু হুমায়ুন আজাদ যার নাম দিয়েছেন বলেছেন ‘লৈঙ্গিক রাজনীতি’।
পোশাকজনিত কথিত শ্লীলতা বজায় রাখার নির্বোধ যেসব অজুহাত পুরুষ, এমনকি কিছু নারী প্রায়ই দিয়ে থাকে তাদের মধ্যে একটি বহুল ব্যবহৃত অপযুক্তি হল- পোশাকে র আবরণ খুলে ফেললে মানুষ ও পশুপাখির তফাৎ কোথায়? তাদের জন্য বলি, মানুষও এক প্রকার প্রাণী। মানুষকে বলা হয় উন্নততর প্রাণি। মানুষ অ-প্রাণি নয়। তাই, অপরাপর প্রাণীর বৈশিষ্ট্যের সাথে মানুষের বৈশিষ্ট্যের হুবহু মিল।
মানুষ সেক্স করে, প্রাণীও সেক্স করে, মানুষ সন্তান জন্ম দেয়, প্রাণীও সন্তান জন্ম দেয়, মানুষ আহার গ্রহণ করে, নিদ্রা যাপন করে, প্রাণীও তাই করে। তবে কি মানুষ অমানুষ হয়ে যায়? অপরাপর প্রাণী থেকে মানুষের তফাৎ একটাই, এক জায়গাতেই। মানুষ বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন জীব। মানুষের আছে মনন, আছে বিবেক, আছে চিন্তাশীলতা, আছে সৃজনশীলতা। এই একটি বৈশিষ্ট্যই মানুষকে মানুষরূপে পরিচিতি দান করে। এটাই মনুষ্যত্ব, শ্লীলতা নয়।

পোশাকের আবরণে দেহকে জড়ানো মনুষ্যত্ব নয়, এমনকি মনুষ্যত্বের অংশও নয়। পশুর মতই পোশাকহীনতায় যদি মানুষ পশু হয়ে যেত, তবে পশুর মতই আহার নিদ্রা আর যৌন মিলনেই মানুষ পশু হয়ে যেত। তবে কি মানুষ নিজেকে মানুষ প্রমাণের জন্য আহার নিদ্রা সেক্স বাদ দিয়ে দেবে?
কেউ মন চাইলে বোরখা পরতে পরে, কেউ বিকিনি কেউবা পুরো নগ্ন। তাতে মনুষ্যত্ব লোপ পায় না, মানবিকতা ও বিসর্জিত হয় না , মানুষ অসভ্য হয় না। অসভ্য হয় ইভটিজিংএ, অসভ্য হয় পুরুষতান্ত্রিকতায়, অসভ্য হয় ধর্ষণে, মেরিটাল রেইপে, অসভ্য হয় ধর্মান্ধতায়, কুসংস্কারে, নারী নির্যাতনে, নারী বিরোধে, অসভ্য হয় নারীকে পোশাকের শালীনতা বজায় রাখতে বললে।
অশ্লীল মননের পুরুষ নারীর হাত পা নিতম্ব পেট, স্তন এমনকি সমস্ত নারী দেহকেই যৌনাঙ্গ মনে করে। অশ্লীলদের চোখে নারীদেহ মানে যৌনবস্তু। তাইতো একটু নগ্ন বাহু দেখলে ই ওরা চিৎকার চেচামেচি করে। ওরা ওদের ওপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলে। ওরা হয়ে ওঠে পশু, ওরা করে ধর্ষণ। ওরা হয় অসভ্য। যৌনবিকারগগ্রস্থ পশু পুরুষ নিজেদের পাশবিকতাকে অপ্রমাণ করার জন্য দোষ চাপায় নারীর কাধেঁ। পশুরা আজকাল মানুষকে শালীনতা শেখায়, পশুরা আজ সভ্যতা শেখায়। সভ্যতা আজ পশুদের দখলে, সমাজ আজ পশুদের দখলে। এ সমাজ তাই পশুদের। মানুষরা এখানে নির্যাতিত, নিপীড়িত, নিগৃহীত, অবহেলিত, লাঞ্ছিত, শোষিত, বঞ্চিত আর অত্যাচারিত। পশুরাই আজ মানুষের রক্ষক, ভক্ষক আর নির্যাতক।
পশুদের অনিয়ন্ত্রিত দুর্বার পাশবিক যৌনকামনা নারীর স্বাভাবিক মানবিক জীবনযাপনে আজ সম্ভবত সবচেয়ে বড় বাধা। পশুদের সমাজে মানুষ আজ বড় অসহায়। সর্বত্রই আজ পশুদের জয় জয়কার। পশুদের পাশবিকতাকে নিবৃত্ত করতে না পারলে মানুষের জীবন বিপন্ন হবে, নারী হবে একদিন বিরল প্রজাতির প্রাণি। তার সন্ধান হয়তো তখন মিলবে যাদুঘর কিংবা চিড়িয়াখানায়। নারী আর হবে না ভালোবাসার মানুষ, নারী আর হবে না সহপাঠী, সহযোগী, সহযোদ্ধা।