ফারহানা হাফিজ: নারীর সমঅধিকার আদায়ের লড়াই ও সংগ্রামে পুরুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ অতি আবশ্যক তো বটেই, বরং উল্টো করে বললে পুরুষই অন্যতম লক্ষিত জনগোষ্ঠী যাদের নারীর প্রতি সমতাপূর্ণ মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি আনয়নের মাধ্যমেই সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইটি বেগবান হবে।

কিন্তু আমাদের চারপাশে সংবেদনশীলতা নামক মুখোশের আড়ালে এমন কিছু পুরুষের অবস্থান টের পাই, যারা নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার বাহানায় আসলে নারীর উপর নিয়ন্ত্রক হিসেবে আবির্ভূত হন। আপাত দৃষ্টিতে তাদের মতামত এ কাজকে নারীর পক্ষে মনে হলেও দিনশেষে আসলে তারা ক্ষমতালিপ্সু চরম পুরুষতান্ত্রিক মোড়ল ভিন্ন কিছু নয়।
আসুন এদেরকে চিনে নেই, এরা কারা।
‘নারী নয়, পুরুষ নয়- আসুন সবাই মানবতাবাদী হই’ শ্লোগানধারী পুরুষ: নিশ্চয়ই আমরা আমাদের চারপাশে প্রায়শই এমন কিছু পুরুষ পাই, যারা যেকোনো নারী/পুরুষ সমঅধিকার বিষয়ক আলোচনায়, সমালোচনায়, তর্কে-বিতর্কে এই যুক্তি নিয়ে আবির্ভূত হন।
তারা মানবতাবাদ ধারণা দিয়ে নারী-পুরুষের মধ্যকার কাঠামোগত বৈষম্যকে আড়াল করতে চান। এদের লক্ষ্যই থাকে যে বৈষম্যমূলক নিয়ম ও ব্যবস্থা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারী-পুরুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে তাকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে না দেয়া।
কিন্তু তারা সরাসরি তা করে না। মুখে তারা সবসময় নারী পুরুষের সমতায় বিশ্বাসী হিসেবে আবির্ভুত করবেন। কিন্তু যখন নারী- পুরুষের সমতাভিত্তিক কেন আলোচনার তাদের বক্তব্যের সুযোগ আসবে, তখন বৈষম্যমূলক ক্ষমতা কাঠামোকে একেবারে পাশ কাটিয়ে এক ধরনের সত্য যুধিষ্ঠীরের মতো বলবেন, আসুন আমরা নারী-পুরুষের বিভেদ ভুলে মানবতার ধর্মে বিশ্বাসী হই। এখানে শয়তানির মারপ্যাঁচটি এতো সুক্ষ্ম যে, বিভেদ ভোলার উদারতার তাগিদে বিরাজমান সকল অন্যায়, অবিচার, অপরাধ ঢেকে যাবে।
‘বিচার মানি কিন্তু তালগাছ আমার’ এই অহমবোধ সর্বস্ব চরম স্বৈরাচারী ও নিয়ন্ত্রক পুরুষ: এই দ্বিতীয় গুণের বা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী পুরুষ সব থেকে বিপদজনক। প্রথম গুণবিশিষ্ট পুরুষদের আনাগোনা সচরাচর বেশি হলেও দ্বিতীয় গুণবিশিষ্টরা বেশিরভাগ সময়ে অতি সংবেদনশীলতার মুখোশ নিয়েই বিচরণ করেন। তারা সুযোগ মতো ছলে, বলে, কৌশলে পুরষতান্ত্রিক মারণাস্ত্র ব্যবহার করেন, যখন তার ক্ষমতার প্রভাব বলয়টি দুর্বল হয়ে যায়। এদের একটি মারণাস্ত্রমূলক স্বগতোক্তি ‘আমি তো নারীদের জন্য এটা করে দিয়েছি’, ‘আমি আমার স্ত্রী-কন্যার স্বাধীনতা দিয়ে দিয়েছি’, মনে হয় নারী স্বাধীনতা দেবার ডিলারশিপ খুলে বসেছে। এই গুণবান পুরুষেরা শুধু মুখেই নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলবে যতদূর তার ক্ষমতার বলয়টি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন না হয়।
কিন্তু এই সকল পুরুষও তার সমকক্ষ বা তার সমান বা তার বেশী যোগ্যতাসম্পন্নদের জন্য নরকের কীটের সমান।
নারী -পুরুষের সমতার আন্দোলনে আমরা সেই পুরুষকেই পাশে চাই, যারা কোনো সাইনবোর্ড নিয়ে নয়, পায়ে পায়ে পথ চলার সহযাত্রী হবার যোগ্যতা রাখেন, যারা নারীর জন্য উপদেশ নয়, আস্থা ও বিশ্বাসের হাতটি বাড়িয়ে দেন।