ধর্ম-বর্ণ বৈষম্যে হাহাকার আমার মন

জান্নাতুন নাহার: খুব অস্থির হয়ে পড়েছি। বুকের ভিতরটায় যেন সিঙ্ক হোলের মত এক বিরাট গর্ত আর সেখানে হু হু করে ঢুকছে শীতের বাতাস। আমি নিঃশব্দ গৃহপালিত কবুতরের মত রুমে বসে আছি আর একটা ফিরোজা রঙের প্রজাপতি যেন বুক চিরে আটকা পড়েছে আমার অভ্যন্তরে। সে ছুটে পালাতে চাইছে, মুক্তি চাইছে এই পৃথিবী থেকে।

মাঝে মাঝে মনে হয় বিয়ে করে খুব ভুল করেছি। বিয়ে সময়ের এক নিষ্ঠুর অপচয়। আমার বিষণ্ণ বিকেল, ভাবুক মন, দূরের কোন রেললাইনে বসে থাকা, অচেনা সব পথে হেঁটে গাছেদের সাথে কথা বলা। আমি যেন ছিলাম ঝড়ে হারিয়ে যাওয়া বিচ্ছিন্ন পাখি, তবু ভাবনাহীন চিন্তাহীন এক বিষণ্ণ পায়রার মতো উড়েছি কত। এখন শৈশবের রাজা গল্পের মত আমার পায়ে যেন শেকল বসেছে। উনুনের উত্তাপ, পরের বেলার মেন্যু এই ছাড়া আর কী ভাবছি আমি! বাকি যা সময়, বিয়ে করা লোকটির সাথে লেপটে থাকা, ফেলে আসা জীবনের বা আগামীর গল্প; আর রক্তে মনের ভাঁজে ভাঁজে সুখের কী ভীষণ অনুরণন তখন।

jannatun-nahar
জান্নাতুন নাহার

আমার হৃদয় দুঃখ পিয়াসী। দুঃখের মতো সুখ আমি আর কিছুতে পাইনি। তীব্র সুখ যন্ত্রণার মতো মনে হয়, সেখানে কোনো আত্ম অনুসন্ধান আমি পাইনি। হয়তো স্কুল থেকে ফিরে ডিনার বানিয়ে জানালার দেওয়ালে গা লাগিয়ে এক অন্যের উত্তাপ নিতে নিতে গল্প করছি, ওদিকে দেওয়ালের ওপারেই আছে আমার পুরনো বন্ধু; ঠাই দাঁড়িয়ে থাকা একলা কাঠ বাদাম গাছ। আমার চিৎকার করে কেন জানি বলতে ইচ্ছে করে, আমি উদাস হতে চাই, অচেনা ভিড়ের মাঝে আরও একা হতে চাই। সমাজ, দায়িত্ব-দায়ভার আমাকে ভীষণ ক্লান্ত করে তুলেছে। আমি আমার মতো পথ দিয়ে হাঁটতে চাই। আমার ইচ্ছে করে এক সপ্তাহ একা ঘরে বন্দী থাকি, কারো সাথে আমার দেখা না হোক।

না চাইলেও রোজ স্কুলে যেতে হয়, হেসে কথা বলতে হয়, বিনয়ী হয়ে অন্যের গল্প শুনতে হয়। গল্প আমার ভাল লাগে, গল্পে আমি জীবন পড়ি। আমি গল্প শুনতে চাই, পৃথিবীর প্রতিটি আস্তরণে যে বিষাক্ত মাকড়শার বাসা তার গল্প, ভিজে নদীর গল্প, বঞ্চনার গল্প, একটা ঝকঝকে উদ্যত ফলার মত প্রতিবাদের গল্প, উঠে দাঁড়ানোর গল্প।

আমার ল্যাবমেট মাইকেল গল্প শুরু করলে দূরপাল্লার বাস হয়ে যায়। মাইকেলের সাথে পরিচয় সামার থেকে। এর আগে ক্লাস নিয়েছি একসাথে, আগুন্তুকের মত দৃষ্টি বিনিময় হয়েছে, কথা হয়নি। মাইকেল রোজ বেশ সকালে আসে, তারপর প্রতিটি সকাল সে শুরু করে আমার সাথে গল্প দিয়ে। সে আমাকে তাদের কালোদের বৈষম্যের অনেক গল্প শুনিয়েছে। সে যখন একটা সাদাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে চাকরি করতো, তখন একদিন বিকেলে ঝিমানোর অপরাধে কী ভীষণ অপমান তারা ওকে করেছে। ওরা বলেছে, “এরা এরকমই”। আমি জানি না মাইকেল সত্যি ঘুমিয়েছিল কিনা, তার অপরাধ কতটা গুরুতর ছিল। কিন্তু তার প্রজ্জলিত ফুঁসে ওঠা চোখ যখন দেখি, মনে হয় সে যেন ভিতরে ভিতরে ফিদেল কাস্ত্রোর মতো এক বারুদ হয়ে জ্বলছে যে বারুদ কিউবা থেকে আফ্রিকার গহীন অরণ্য সব পুড়িয়ে বাতাসে ভেসে বেড়ানো ফেলনা ছাই করে দেবে।

সেদিন মাইকেল তার দুঃখের গল্প করছে। ঘড়ির কাঁটা দশটা পেরুচ্ছে, টার্কিশ প্রফেসর ডক্টর ডগানের ক্লাসে যেতে হবে আমায়। মাইকেল বলে চলেছে, আমি যদি একটা হোয়াইট কমুউন্যিটি দিয়ে হেঁটে যাই, ওদের রাস্তায় খেলারত ছোট বাচ্চারা কী ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখবে আমাকে, যেন কোন পিজার দোকানের অশিক্ষিত জেনিটর হয়ে বেঁচে আছি। ওরা কী জানে আমি ডক্টরাল ডিগ্রি পেতে যাচ্ছি। আমার বাবার ডক্টরাল ডিগ্রি আছে, আমার মা ম্যাথে গ্রাজুয়েশন করেছে।

মাইকেল বলে চলেছে অবিরাম, ওদের সাফল্য পৃথিবীর পথে রেখে যাওয়া ওদের কীর্তির কথা। আমি ওর প্রতিটি শব্দে ধেয়ে আসা ভলকানোর উত্তাপ পাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি ওর চোখে একশোটা দেয়াশলাইয়ের সবকটি বারুদ একসাথে জ্বলছে। কিন্তু সে বারুদে জ্বলে ওর ফুঁসে ওঠার সঙ্গী হবার সময় আমার হাতে একদম নেই। আমি ঠোঁট কিছুটা ফাঁক করে কয়েকবার ক্লাসের কথা বলার চেষ্টা করেছি, এবার বই খাতাও গুছিয়ে নিয়েছি।

মাইকেল বললো, তার আন্ট মিসিসিপির প্রথম আফ্রিকান আমেরিক্যান ওম্যান যার ডক্টরাল ডিগ্রি আছে। দশটা পাঁচ বেজে গেছে, আমি এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছি। ক্লাসে যাবার সত্যিই দেরি হয়ে যাচ্ছে, বৈষম্যের এই সনাতন গল্প অন্যদিন শোনা যাবে।

মাইকেল বললো, “আমার গ্রেট গ্রান্ড ফাদার ছিল স্লেভের নাতি, জানো আমি তাকে দেখেছি। আমাদের পরিবারের সকলেই এডুকেটেড। তুমি না জেনে আমায় যা তা ভাবতে পারো না। তবে আমার কয়েকজন দাদী তারা অবশ্য লিখতে পড়তে পারে না। তুমি চিন্তা করতে পারো, ওবামা যখন প্রেসিডেন্ট হলো, প্রথম একজন কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হচ্ছে আর আমার দাদী ভোট দিতে পারিনি, এর চেয়ে বড় দুঃখ একটা মানুষের জীবনে আর কী হতে পারে”।

এইটুকু বলে মাইকেল ভীষণ বিষণ্ণ হয়ে পড়েছে। যেন তার দাদীর থেকে বেশি দুঃখ সেই পেয়েছে। এখন সে ভীষণ চুপ করে তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। মেঝের দিকে তাকিয়েই সে আরও কিছু বলার চেষ্টা করছিল। মাইকেলের এই গভীর বেদনাবোধের সাথে ভীষণ নিষ্ঠুর আচরণ করলাম আমি। বললাম, মাইকেল আই এঞ্জয়েড ইওর টক, বাট আই হ্যাভ ট্যু গো।

ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। ডক্টর ডগান আজ পড়াচ্ছেন ‘লো নয়েজ এমপ্লিফায়ার’, বরাবরের মতো ভীষণ বাজে পড়াচ্ছেন তিনি। আমি ডক্টর ডগানের দিকে তাকিয়ে আছি আর দেখতে পাচ্ছি মাইকেলের আন্টের ডক্টরাল গ্রাজুয়েশন, ঝলমলে দুপুরের রোদে অসংখ্য সাদার ভিড়ে তাঁর গাউন পরে হেঁটে যাওয়া, পৃথিবীর বৈষম্যের প্রাচীরে থুতু মেরে তাঁর ছিনিয়ে নেওয়া জয়ের অমূল্য হাসি, একটা ব্লাক কম্যুউনিটির উজ্জ্বল উল্লাস।

উপরের লেখাটা ১৭ই অক্টোবর আমার ডায়েরিতে লেখা।

ক্যাম্পাসে থাকতে এক বান্ধবী খুব করে ধরলো ওর সাথে খুলনা শহরে যেতে হবে। একা সে কিছুতেই যেতে পারবে না। আমাদের ক্যাম্পাস ছিল কিছুটা গ্রাম এলাকায়। তবে শহরে যাবার দরকার হলে ক্যাম্পাসের বাসে যেতে হতো আর সেটি ছিল খুব সহজ, নিরাপদ। সবসময় একা চলাফেরার একটা বদঅভ্যেস ছিল আমার। তাই একা না যেতে পারার কারণটি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। তবুও ওর অনুরোধে কিছুটা নিশ্চুপ থেকে রাজী হলাম।

বাসে যেতে যেতে বান্ধবীটি বললো, আদিবাসী হওয়ার কারণে রাস্তার লোকেরা তাকে বাজে কথা বলে আর একা থাকলে সেটি আরও বেশি করে। শুধু আদিবাসী হওয়ার কারণে কেউ কাউকে উত্যক্ত করতে পারে, ব্যাপারটি কিছুতেই আমার বোধগম্য হলো না, মানুষ নিশ্চয়ই এতোটা বর্বর মস্তিষ্কের এখনও হয়নি। ডাকবাংলায় ক্যাম্পাসের বাসগুলো দাঁড়ায়। আমরা নামতেই শুনতে পেলাম ‘এই চাকমা এই চাকমা…’।

আমরা একটা রিকশা নিয়ে নিউমার্কেটের দিকে যাচ্ছিলাম। তখনও আশপাশ থেকে সেই একই রকম শব্দ কানে আসছিল। আমার বন্ধু একজন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ওম্যান। সে হলিক্রস কলেজে আমার সাথেই পড়তো। পেশায় কম্পিউটার প্রকৌশলী, সে দেশের বাইরে প্রেস্টিজিয়াস পদে কর্মরত। আমার নিজেকে ভীষণ ছোট লাগছিল সেদিন। আজ যখন এতো বছর পরে এই লেখাটা লিখছি, আমরা নিশ্চিতভাবে সেই ভীষণ ছোট হয়েই আছি।

আমাদের আছে, ‘আমাদের তোমাদের’

আমাদের দল, তোমাদের দল

আমাদের ধর্ম, তোমাদের ধর্ম

আমাদের গোত্র, তোমাদের গোত্র

আমাদের দেশ, তোমাদের দেশ

আমাদের নেই ‘শুধু আমাদের’ বলে কিছু।

লেখক: জান্নাতুন নাহার, পি এইচ ডি ক্যান্ডিডেট, ইলেকট্রিক্যাল এন্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং, নর্থ ক্যারোলাইনা এ এন্ড টি স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র।

শেয়ার করুন: