নির্বাসিত নিষিদ্ধ নারী!

জান্নাতুন নাঈম প্রীতি: আমার মা বলেন আমি বই পড়া শুরু করেছি স্কুলে ভর্তি হবার আগে থেকেই। সেই বই পড়তে গিয়েই ক্লাস সিক্সে হাতে পেলাম তসলিমা নাসরিনের ‘নির্বাচিত কলাম’। এরপর ‘লজ্জা’, ‘ভ্রমর কইও গিয়া’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘ক’ থেকে শুরু করে পড়া এবং দেখায় যোগ হয়েছে সালমান রুশদির ‘স্যাটার্নিক ভার্সেস’, মকবুল ফিদা হুসেনের ‘ন্যুড সরস্বতী’, অমৃতা শেরগিলের ‘স্লিপ’, অভিজিৎ রায়ের ‘অবিশ্বাসের দর্শন’, ডকিন্সের ‘গড ডিল্যুশান’!

priti-3
জান্নাতুন নাঈম প্রীতি

কলাম আমার তখন দুচোখের বিষ। মুহম্মদ জাফর ইকবাল ছাড়া তখন কারোর কলামই পড়ি না। তবে এই কলামের বইটি হাতে নেবার কারণটি হচ্ছে লেখিকাটি নিষিদ্ধ! অসম্ভব আলোচিত ও সমালোচিত, প্রশংসিত ও নিন্দিত। তাঁকে নিয়ে তাঁর ভক্তদেরকেও বিভক্ত হতে দেখেছি। কাজেই আমার মনের প্রথম প্রশ্ন ছিল- কী এমন লিখেছেন এই লেখক? যাতে করে হয়ে উঠেছেন নিষিদ্ধ?

পড়তে গিয়ে অবাক হলাম। কী ঝরঝরে তরতরে লেখা, কী বৈপ্লবিক ভাষা! ওই ভাষাকে অবশ্য অশ্লীল বলতে শুনেছি অনেক লেখক-পাঠককেই। তবুও নিষিদ্ধ হওয়াকে পুঁজি করে নয়, বরং সত্যকে ধারালো করে বলবার জোরে এবং জেরে আমার অন্তরে ও বাহিরে নির্বাসিত নিষিদ্ধ নারীটি জায়গা করে নিলেন সদম্ভে, স্বমহিমায়।

পড়তে গিয়ে আবিষ্কার করলাম- এই অনন্ত নক্ষত্রবীথির ছোট্ট গ্রহটিতে মানুষ বলে যে প্রাণীগুলি আছে তারা কতো ক্ষুদ্র দুটি পৃথিবী তৈরি করেছে, যার একটির নাম নারী, অন্যটির নাম পুরুষ। কত দেব-দেবতা তৈরি করেছে- যারা নারী-পুরুষের জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের হয়ে উঠতে পারেনি!

আবিষ্কার করতে শুরু করলাম নারীর মানুষ হিসেবে অবস্থান; যেখানে পৃথিবীর আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজিটিতেও মহান সৃষ্টিকর্তাটি ‘গড’ মানে ‘হি’, শী বা ক্লীব নয়! কেবল চোখ নয়, চোখের দৃষ্টির গভীরের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখলাম- ভাষার বৈষম্য, টাকার বৈষম্য, ক্ষমতার বৈষম্য, ধর্মের বৈষম্য, শরীরের বৈষম্য, সমতার বৈষম্য!    

Taslima 4
তসলিমা নাসরিন

নির্বাসিত নারীটির লেখা নিয়ে কথা বলার অপরাধে তাঁর নির্বাসনকে বৈধ করতে কত কথা শুনলাম। আমার প্রতি তিরস্কার তো ছিলই, সেইসাথে কতজন বললো,  অন্দরমহলের কথা বন্দরে দাঁড়িয়ে বলতে তাঁকে কে বলেছে? কে জানতে চায় ঘরে স্বামীটি মার দিচ্ছে কিনা? কে জানতে চায় সে কতজনের থেকে প্রতারিত হয়েছে? আমিও ভেবে দেখলাম- তাইতো! কী দরকার ছিল দেশের লোককে রাগিয়ে দেবার? কিন্তু সেই ‘আমি’টিই যখন বখাটের উত্যক্ত করা বুলি শুনতে পেলো, বুক নামের শারীরিক অঙ্গটি নিয়ে বিকৃত মন্তব্যের নির্যাতনের নানারূপ দেখতে পেলো, বৈষম্যের বিষম খেয়ে হেঁচকি তুললো, তখন বুঝতে পারল- তসলিমাকে কেন দরকার ছিল!

তসলিমা পুরুষতন্ত্রের মুখোশ আঁটা সমাজটির মুখোশে টান দিয়েছে, তসলিমা যুগ যুগ ধরে নারীর বন্দিনী নন্দিনী হয়ে ওঠা রূপের ওপর আয়না ধরেছে, তসলিমা নারীর পণ্য হয়ে ওঠার বাজারে মন্দা হয়ে মন্দরূপে দেখা দিয়েছে। কাজেই তসলিমাকে ভালো লাগবে কেন?

তাই শুধুমাত্র লেখালেখির অপরাধে দেশের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে দেশের সেই নেতারা, সেই নেত্রীরা, যারা নিজের পরিচয়ের চেয়ে বাবা-স্বামীর পরিচয়েই বেশি পরিচিত, সেই সমাজ যারা মত প্রকাশের স্বাধীনতাকেও বাঁধতে চায় পুরুষতন্ত্রের দড়িতে।

নারীর নাকে দড়ি দিয়ে না ঘোরাতে পারলে কি আর পুরুষজন্মের সার্থকতা থাকে? তাই মানবজন্মকে তুচ্ছ করে দলে দলে পুরুষ হয়ে উঠতে হবে, নারীকে চিনিয়ে দিতে হবে স্বাধীনতার পরিধি, নারীকে বুঝিয়ে দিতে হবে নারীজন্মের জ্বালা!

Taslima 1ইউরোপ এবং পরবর্তীতে ভারত তাঁকে জায়গা দিয়েছে। জায়গা দিতে পারেনি বাংলা, না বাংলাদেশ না পশ্চিমবঙ্গ। কারণ কোটি কোটি টাকা জনগণের ঘর থেকে তুলে নিয়ে নয়-ছয় করাটা, কালো টাকা দিয়ে ফুর্তি-বিলাস করাটা, দুর্নীতি করে নীতি কপচানোর কায়দাটা প্রকাশ্যে চলতে দেয়া যায়। কিন্তু নারী ও পুরুষের সমতার জায়গাটা দেয়া যায় না, নারীর মানুষ হয়ে ওঠাকে প্রশ্রয় দেয়া যায় না, নারীর স্বাধীনতার স্বাধীন সত্ত্বাকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে দেয়া যায় না। কারণ- একে তো মেয়ে, তারপর আবার লেখক!

ক্ষমতা নেই, আছে একটা কলম, বড়জোর একটা কীবোর্ডওয়ালা ল্যাপটপ কম্পিউটার। ওটা দিয়ে কেবল লেখা যায়, মঞ্চে দাঁড়িয়ে গলার জোরে জোরে মিথ্যে বক্তৃতা ও অহেতুক আশ্বাস দেয়া যায় না। টাকার জোরে অন্যায়কে ন্যায় করে তোলা যায় না। অন্যায়কে ধর্মের, ক্ষমতার বা বৈষম্যের সুতোয় বেঁধে নিষিদ্ধকরণ সূত্র তৈরি করা যায় না। নিষিদ্ধ করা যায় কেবল লিখলেই, বললেই। কাজেই বের করে দাও! ঝামেলা বিদায় হোক!

তসলিমাকে নিয়ে চূর্ণি গাঙ্গুলির ‘নির্বাসিত’ সিনেমাটা রিলিজ হয়েছে কিছুদিন আগেই। ওই সিনেমায় পরিচালক দেখিয়েছেন- লেখককে নিষিদ্ধ করার ছুতো এবং নিষিদ্ধ হওয়ার ক্ষত। পরিচালক দেখিয়েছেন- পৃথিবী মানুষের হয়নি, ঈশ্বর সবার হয়নি, দেশও লেখকের হয়নি। দেশ মানে রাষ্ট্র, পৃথিবী মানে বিভক্ত। লেখককে বলতে দেয়া হবে না, বাঁচতে দেয়া হবে না, থাকতে দেয়া হবে না।  

তবুও সেই নিষিদ্ধ নির্লজ্জ লেখকটি মাতৃভূমির মাতৃভাষার জাতীয় সঙ্গীতটি শুনে বেহায়া আবেগ নিয়ে লিখতে ভোলেন না- “জাতীয় সঙ্গীত অনেক দেশের শুনেছি। সবচেয়ে জঘন্য বোধহয় ফ্রান্সের জাতীয় সঙ্গীত। আমাদের সৈন্যরা আসছে, তোদের গলা কাটবে, তোদের ছেলেদের গলা কাটবে, রক্তে ভাসাবে সব। এই ধরণের লিরিক। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত আমার মনে হয় সবচেয়ে সুন্দর জাতীয় সঙ্গীত। কোনো ঘৃণা নেই, রক্তপাত নেই, প্রতিহিংসা নেই। আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি। শুরু থেকে শেষ অবধি ভালবাসার কথা। দেশটির গা-গতরে নৃশংসতা আর বর্বরতা, কিন্তু এর জাতীয় সঙ্গীতটি কী চমৎকার ভালবাসা বিলোচ্ছে। দুর্ভাগা বাঙ্গালির আর কিছু না থাক, গৌরব করার মতো একটি জাতীয় সঙ্গীত আছে।”

Taslima Nasrin 2লেখকটির বুকের মধ্যকার টনটন আমি অনুভব করতে পারি। ঝাপসা চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে পারি- লেখক হওয়ার জ্বালা। তাই সান্ত্বনা দিতেই ওকে বলি- ‘নির্বাসিত’ দেখে আমার বুকের মধ্যে জাতীয় সঙ্গীতটাই বেজেছে বারবার, ঠিক তোমার বুকের মধ্যে যতটা তোলপাড় করেছে… বিশ্বাস করো তনা, পৃথিবী একটা একক দেশ হবে একদিন। কাঁটাতার থাকবে না, যুদ্ধ জাহাজ থাকবে না, লেখকেরা লিখতে পারবে তার যা ইচ্ছে…

আমি বলতে পারিনা- দুর্ভাগা বাঙালির কেবল ওই জাতীয় সঙ্গীতটাই আছে, মানব জাতীয় মনটি নেই। যে মন নিয়ে ইউরোপ তোমাকে জায়গা দিয়েছে আর দুর্ভাগা জাতি ছুঁড়ে ফেলেছে। মানুষ হবার শিক্ষাটা সবার হয়নি। দেশ কেবল রাষ্ট্র হয়েছে, রাষ্ট্র কেবল বৈষম্যের হয়েছে। অমানুষ মানুষ হয়নি, জাতি মানবজাতি হয়নি। পৃথিবী কেবল তোমার ‘দ্বিখণ্ডিত’ বইটির মতই খণ্ডিত হয়েছে। একটির নাম মানবজাতি, অন্যটি দানবজাতি!

দানবজাতির কাছে কলমের চেয়ে অস্ত্র বড়। কলম আর অস্ত্রের যুদ্ধে তুমি হারবে নিশ্চিত। কিন্তু দানবতার কাছে মানবতা যেদিন জিতবে, সেদিন তোমার সমস্ত হার দিয়ে ওড়াতে পারবে সমতার সত্যটি। সেদিন তুমি-আমি না থাকি, সত্যটি ঠিক থাকবে। কারণ অস্ত্র দিয়ে নারী ও লেখক দুই-ই হত্যা করা যায়, সত্যকে না!  

শেয়ার করুন: