এ কেমন নারীবাদ, এ কোন নারীবাদী! নারী তুমি চেতন হও

বিশ্বাস তীর্থ: মুঘল বাদশা হুমায়ুন হিন্দুস্তান ঘুরে দেখতে বের হয়েছেন বাদশা নয়, সাধারণ প্রজার বেশে। একটি জায়গাতে তিনি দেখলেন সতীদাহের আয়োজন চলছে অতি উচ্ছাস আর উদ্দীপনায়। হুমায়ুন এগিয়ে এলেন এ অমানবিক নির্মমতা বন্ধে। তাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেও লাভ হলো না। তিনি সেই বিধবাকে রক্ষা করে নিয়ে গেলেন। কিন্তু বহু বছরের এ প্রথা বাদশা হুমায়ুন উদ্যোগ নিয়েও বন্ধ করতে পারেননি।

tirtho-biswas
তীর্থ বিশ্বাস

এ বর্বর প্রথার প্রবল বিরোধী হবার পরও কেন তিনি সেটা বন্ধে কঠোর হলেন না সেটা ভিন্ন রাজনৈতিক ইতিহাস। এর দীর্ঘপর এসে রাজা রামমোহন রায়ের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে লর্ড বেন্টিঙ্ক সাহেব এ প্রথা রদ করলেন। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় নিজের ছেলেকে এক বিধবার সাথে বিয়ে দিয়ে বিধবা বিবাহ প্রথা শুরু করলেন। হুমায়ূন হয়তো শুধুই মুঘল বাদশা, কিন্তু রামমোহন বা বিদ্যাসাগর ছিলেন সমাজ সংস্কারক। নারীবাদী কি নন তাঁরা? বাঙলায় নাদীবাদের শুরু কি তাঁদের হাতে নয়?

নারীবাদ নারীদের জন্য আন্দোলন, নারীর আন্দোলন নয়। কোনো কালেই তা শুধুমাত্র নারীর আন্দোলন ছিল না। ১৮৪৮ সালে নিউইয়র্কে সেনেকা ফলস কনভেনশনে যখন শুধুমাত্র নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন হয় তখন সেখানে তিন শতাধিক পুরুষ সেই অন্দোলনে শামিল হন। সালটা ১৮৪৮, ঐ সময়ে এতো বেশি পুরুষের অংশগ্রহণটা খুব স্বাভাবিক বিষয় নয়। সেই সময়ে এই নারীবাদী আন্দোলন ছিল নারীর ভোটাধিকার এবং রাজনীতিসহ সামাজিক নানা ক্ষেত্রে পুরুষের সমান অধিকার আদায়ের দাবিতে।

জন স্টুয়ার মিলও ছিলেন এই উদারনৈতিক নারীবাদী আন্দোলনের অন্যতম এক পথ প্রদর্শক। রামমোহন রায় এবং বিদ্যাসাগরও উদার নারীবাদী। নারীবাদের প্রথম দিককার এই দাবিসমূহ কঠোরপন্থীদের কিছু সমালোচনা বা বিরোধিতার মুখে পড়লেও তা সচেতন মানুষের কাছে সমাদৃতই হয়।

নারীবাদ নারীর সমঅধিকার আদায়ের আন্দোলন নামেই সমাদৃত। অধিকার আর সমঅধিকার শব্দটি খুব কাছাকাছি হলেও যৌক্তিক-তার্কিক বিচারে পার্থক্য যোজনসম। অধিকারের অন্দোলন প্রতিটি মানুষের আছে। এখানে পুরুষ বা নারী ভেদাভেদ করাটা অহেতুক। অধিকার রক্ষার আন্দোলন সভ্যতার শুরু থেকে। অধিকার রক্ষার আন্দোলন চলছে আজও। পূঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় অধিকার রক্ষার আন্দোলনের বহতা অন্তহীন। সেই ব্যাখ্যা পর্যালোচনা করাটা হবে অপ্রাসঙ্গিক বাচালতা।

প্রসঙ্গ যেখানে নারীবাদ, সেখানে  নারীর অধিকারের বিষয়ে ফিরে আসাই ভাল।
নারীবাদী আন্দোলন ১৯৬০-৭০ এর সময়ে প্রথমবারের মতো কঠোর সমালোচনার মুখোমুখি হয়। এই সময়টাতে ইউরোপ ও আমেরিকায় নারীদের কর্মক্ষেত্র ছিল অনেকাংশে কেবলমাত্র শিক্ষকতায় সীমাবদ্ধ। অন্য যেকোনো পেশা থেকে শুরু করে পরিবারসহ সব জায়গাতেই নারীর সম্মান অনেকাংশেই ছিল অবহেলার পর্যায়ে। ২০ বছরের পর তাদের বিয়ে দিয়ে দেবার একটা বৃহৎ প্রবণতাও ছিল সেই সময়টাতে। ফলে তারা স্বামী-সন্তান-সংসারে সহজেই আবদ্ধ হয়ে পড়তো।

rape-2এই কঠোরতা থেকে বের হতে শুরু হয় নারীবাদের নব উচ্চারণ। এবং এই পরিবার, সমাজ ও কর্মক্ষেত্রে নারী অধিকার আদায়ের দাবির পাশাপাশি সেই সময়টাতেই সমকামী আন্দোলনের ধাপটাও প্রথমবার জনসমক্ষে চলে আসে। এই আন্দোলনের একটা বৃহৎ অংশ প্রচলিত বিবাহ রীতিকে অস্বীকার করে, তারা মাতৃগর্ভ ব্যতিত সন্তান জন্মদানের দাবিও উথাপন করে এবং পুরুষতান্ত্রিকতার সরাসরি বিরুদ্ধে এসে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়। কিছু প্রথাসিদ্ধ মানুষের কাছে এই নারীবাদ অসভ্যতা হিসাবে গণ্য হয়।

এই সময় নারীবাদীরা একটি বিশ্বাসের কথা প্রচার বা ধারণ করে যে, “নারীর ভিতর যে গুণাগুণ আছে, তা শুধুমাত্র ইউনিকই নয়, বরং পুরুষের চেয়ে তারা বেশি সামর্থ্যবান’’। এই বিশ্বাসটি নারীবাদের সমঅধিকারের যে মূল দর্শন সেটা ছাপিয়ে উচ্চাধিকার বা পুরুষবিরোধী একটি ধারণার সৃষ্টি করে। যেটা প্রথমদিককার নারীবাদের মূল তত্ত্বের জায়গা থেকে সরে এসে একেবারেই ভিন্ন এবং অনেকাংশে নেতিবাচকতা সৃষ্টি করে।

একটি গোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের আন্দোলন যদি হয় অন্য গোষ্ঠীকে হেয় করা বা অন্য গোষ্ঠীর অধিকার কেড়ে নেয়া, সেটিও কিন্তু আরেক প্রকার অন্যায় হয়ে দাঁড়ায়। মাঝে বেশ কিছুকাল রেডিক্যাল ফেমিনিজম নিরব থাকলেও ৯০ শতকের পর তা একটা নুতন ঘরানার দাবিতে এসে পৌঁছায়, যা সরাসরি পুরুষবিরোধিতা করে এবং সেটা অনেকাংশে পোস্ট মর্ডানিস্ট ভাব ধারার ফলশ্রুতিতে।

torture-3আমাদের দেশের তসলিমা নাসরিন একজন রেডিক্যাল ফেমিনিস্ট। তিনি যতটা লেখক হিসাবে খ্যাত, তার অধিক তিনি পরিচিত হয়েছেন ধর্ম ও পুরুষতান্ত্রিকতার বিরোধিতা করে। তিনি মৌলবাদের বিরুদ্ধ মত হিসাবে আরেক মৌলবাদিতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। অমানবিকতা, অসভ্যতার প্রতিবাদে দ্বিতীয় অমানবিকতা বা অসভ্যতাকে দাঁড় করানো কতটা যৌক্তিক, সেটা প্রশ্নবিদ্ধ! অসভ্যতার প্রতিবাদ যদি অসভ্যতা দিয়েই হয়, তবে সভ্যতা আসবে কোথা থেকে?
মজার ব্যাপার হলো বর্তমানে এই রাষ্ট্রে তসলিমা নাসরিন অনুসারী নারীবাদীর সংখ্যা দিন দিন উর্দ্ধগামী। আমি জানি না তিনি নারীর জন্য কী করতে পেরেছেন, নিজেকে আলোচনা-সমালোচনায় রেখে খ্যাতি কুড়ানোর চেষ্টা ছাড়া তার মতবাদ সমাজে কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।

তসলিমা নাসরিনের এই ধর্মবিরোধিতা এবং পুরুষবিরোধিতার ফলে তার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা একশ্রেণীর তরুণ নারীকে খ্যাতির মোহে বিহ্বল করে পুরুষবিরোধিতায় ঠেলে দিচ্ছে। এবং সেটাকে তারা নারীবাদ হিসাবে স্বমহিমায় আখ্যায়িত করছে। এই তসলিমা নাসরিন অনুসারী রেডিক্যাল ফেমিনিস্টরা সমাজের সাধারণ নারীর জন্য কিছুই করেনি। তারা আদৌ করতে চায় কিনা সেখানে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তাদের কর্মকাণ্ডে দৃশ্যত তারা নারীবাদের তকমা গায় জড়িয়ে নিজেকে জনপ্রিয় বা প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। এরা অসচেতন বা সচেতনভাবে নিজের স্বার্থে নারীকেই হেয় করছে।
আবার একটু পিছনের ইতিহাসে ফিরে গিয়ে বলি, উদারনৈতিক নারীবাদ পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্য সবখানেই নারীর অধিকার, সম্মান, অনেক কিছু অর্জন করেছে। নারী আজ বিশ্বে ভোটাধিকার পায়, নারী প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপ্রধানের সংখ্যা নেহাত কম নয়, নারী বিচারিক প্রধান থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রধান, পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ নানাক্ষেত্রেই উচ্চ পদে আসীন।

নারীবাদী আন্দোলন এসেছে সমাজ-সামাজিকতার পরিবেশ বিবেচনায়। অহেতুক অমূলক ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার আক্ষেপে নয়। হাইপেশিয়া যখন আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের শিক্ষক তখন এক ব্যক্তি তাকে ভালো লাগার কথা বলাতে হাইপেশিয়া সেই ব্যক্তিকে তার কাপড়ে রক্তের দাগ দেখিয়ে বলেছিলেন, আমার শরীর ভালবাসতে প্রস্তুত নয় এখন।

৩৫০-৪১৫ খ্রিস্টাব্দে এটা ছিল হাইপেশিয়ার ব্যাক্তি উদ্ধৃতি, কোনো অবস্থাতেই তাকে দিয়ে সামগ্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে পরিমাপ করা যাবে না। ঐ সময়ের প্রেক্ষিতে এই কথা দ্বিতীয় কোনো নারী কল্পনাও করতে পারে না। এমনকি আজও হয়তো সমগ্র জাতিগত হিসাবে নারীর বেলাতে ঐ উক্তি কল্পনাতীত। কিন্তু কিছু নারী এই উক্তি করতে পারেন, এমনকি বাঙালি নারীও। সেটা ব্যক্তির প্রেক্ষিতে কী হিসাবে বিবেচ্য সে আলোচনায় যাবো না, সামগ্রিকতায় এক প্রকার অসভ্যতা। সেটা হয়তো অধিকাংশ নারীও বলবে।

আমাদের দেশে নারীরা এখন কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার নয়। সমাজে অসম্মানিত? অন্তত বাংলাদেশে এই সময়ে এসে এই কথা বলাটা পাপ। যেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, স্পিকার নারী, বিরোধী দলীয় নেতা এবং প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রধান নারী (সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে)। দেশের অনেক জেলার প্রশাসন এবং পুলিশ প্রধানও নারী আছেন। এতোকিছুর পরও নারী নির্যাতিত হচ্ছে আজকের তথাকথিত বা স্বঘোষিত নারীবাদীদের উচ্চবাচ্য সেটা নিয়েই।
হ্যাঁ, সত্যিই নারী নির্যাতিত হচ্ছে এবং হয়তো হরহামেশাই হচ্ছে। সেই দোষ কার, পুরুষের? একেবারেই তা নয়। এখানেই সমস্যার মূল। মানবিক এবং নৈতিক এই দুটি শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যায় যাই।

mollahat-2সভ্যতার এই পর্যায়ে এসেও আমরা মানবিকতার, নৈতিকতার দাবি নানাক্ষেত্রেই তুলছি। নারী নির্যাতিত হলে কেন এই শব্দ দুটি ভুলে যাচ্ছি। পুরুষ নামক জাতি বাচক শব্দটি কোন ক্ষমতা বলে মানবিক ও নৈতিক শব্দ দুটিকে গ্রাস করছে? পুরুষ বা নারী বিভেদের প্রয়োজন নেই। একজন মানুষ হিসাবে যদি ঐ মানুষটি যথার্থ মানবিক গুণ সম্পন্ন এবং নৈতিক হয়, তবে সে অন্য মানুষ কেন, কোনো প্রাণীকেই নির্যাতন করবে না।

দ্বিতীয়ত সমাজ ব্যবস্থার গোড়া থেকেই সবল দুর্বলের উপর নির্যাতন করে আসছে এবং আজও তা হচ্ছে সব রাষ্ট্রেই। সেক্ষেত্রেও পুরুষ নারী বিভেদ করাটা একেবারেই অযৌক্তিক অজ্ঞানতা।
প্রসঙ্গ আসতে পারে তবে কি নির্যাতন সহ্য করে নারীরা বসে থাকবে? তা নয়। কিন্তু আমাদের সমসাময়িক নারীবাদীদেরই একটি বিরাট অংশ এবং সেটার বেশির ভাগ তরুণ প্রজন্ম, যারা নারীবাদ বলতে সেক্সচুয়্যালিটিকেই অধিক মাত্রায় প্রাধান্য দিয়ে ফেলছে। তসলিমা নাসরিনই সম্ভবত এই প্রবণতার বীজ বুনে গেছেন।

এখন ধরুন একজন পুরুষ যদি কোর্টে মামলা করতে যায় যে, একটি নারী তাকে জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্কে বাধ্য করেছে। কোর্ট কি তার মামলা নেবে? নারীবাদীদের একটি অংশ হৈচৈ করে বলবেন, এটা হলো ঐ পুরুষের ঐ নারীকে হেনস্থা করারই একটি নবপন্থা। নারী খুবই সেনসিটিভ একটি ব্যাপার বিধায়ই খবরে আসছে বারবার। এবং নারী কাঁদলে সমগ্র পৃথিবী বিচার-বিবেচনাহীন নি:সাড় হয়ে তারা পাশে দাঁড়ায়। কেননা নারীই তো মা, নারীই দেবী। সেই সম্মান দিতে পৃথিবী ভোলে না। এটা নারী নারীবাদীদের মনে রাখতে হবে।

আজ আপনারা যারা আপনাদের নারীবাদী লেখক বা নারীবাদী হিসাবে দাঁড় করাতে চান, তারা আসলে ব্যক্তি স্বার্থ মোহে মোহান্বিত হয়ে আছেন। তাই সেক্সচুয়ালিটিকেই নারীবাদ হিসাবে বেছে নিয়েছেন। সেক্স সমস্ত প্রাণীর বেলাতেই একটি অনিবার্য অংশ, সেটা অস্বীকার করার কিছু নেই। সেটা পুঁজি করে জনপ্রিয়তার মোহ, ভণ্ডামি। আমি কোট করে বলছি, “যেদিন কোনো রেপ কেস কোর্টে তোলা হয়, সেদিনই কোর্টে ভিড় বেশি হয়। শুরু করা হয় ধর্ষণের শিকার মেয়েটির যাবতীয় আলামত ……. আরেকবার সবার সামনে তাকে একপ্রকার মানসিক ধর্ষণ করা হয়। সবাই এটা খুব উপভোগও করেন।

যারা শোনেন, তারা মনে মনে কল্পনা করেন তারা ছিলেন ধর্ষকের ভূমিকায় , তাদেরই এক জ্ঞাতির দ্বারা ছিবড়ে হয়ে যাওয়া এক মেয়ের কাছে সেই যৌনসংগমের বর্ণনা শুনে সেখানে নিজেকে কল্পনা করে নিতে কোন পুরুষের না ভালো লাগে ! ”

যিনি এই লেখাটি লিখেছেন, আমি জানি না তিনি কতোটুকু প্রজ্ঞা ও বাস্তবতায় ধর্ষণের বর্ণনাকে উপভোগ্য বা বর্ণনা শোনা সব পুরুষকে ধর্ষকের আসনে বসাতে চেয়েছেন। ধর্ষণ হলো জোর পূর্বক শারীরিক সম্পর্ক বা শারীরিক নির্যাতন। জোর পূর্বক কোনো সম্পর্কই সুখের হতে পারে না। সেই বিবেচনায় ধর্ষণ কিভাবে সকল পুরুষের কাছে উপভোগ্য বা কাম্য হয়, জানি না। ব্যাখ্যা জানতে পারলে ভাল হতো।
“এ সমাজের অধিকাংশ পুরুষই ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে না। তাদের দৃষ্টিতে এটা একটা বিনোদন। ধর্ষণ হলো যৌনতাড়িত ধর্ষকামি পুরুষের বিনোদনের একটি বিকৃত মাধ্যম। আমি নিশ্চিত, আমাদের সমাজে অনেক পুরুষ আছেন, যারা খবরের কাগজে কোনো ধর্ষণের খবর, তার বিস্তারিত বর্ণনা একাধিকবার পড়েন শুধু এক বিকৃত আনন্দলাভের জন্যে।”

যে শ্লোগান হবে চেতনা জাগানিয়া, সেখানে তুমুল ক্রোধের অচেতন ভারিক্কি অসহ্য লাগে। কাদের উদ্দেশ্যে আপনি কথাগুলো বলছেন? সচেতন পুরুষ নাকি কতক বর্বরদের উদ্দেশ্যে, সেটা আপনাকে ভাবতে হবে। বর্বর চেতনা জাগানো এতো সোজা নয়। তাদের মনে শুদ্ধতার সৃষ্টিতে আপনার এই শ্লোগান যে নিশ্চিত ব্যর্থ, সেটা আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি।

কোন প্রতিবাদ কিভাবে করা উচিত, কিভাবে করলে তা ফলপ্রসূ হবে সেটা নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়। তবে কেন? অসভ্য বর্বরতার প্রতিবাদ কি শালীনতা শুদ্ধতার মননে হওয়া উচিত নয়?
“পুরুষ আর পুঁজিবাদ যখন স্তনের মালিক!” “আমার শরীর-ইচ্ছে হলে ঢাকবো, নয় খুলবো!” এই শিরোনামগুলো কি উদ্দীপক নয়! মানবিকতা বা নৈতিকতা জাগানোর হাতিয়ার কীভাবে এই লেখায় সম্ভব? এই উদ্দীপনা জাগানো লেখাগুলো কোন অবস্থাতেই নারীর অধিকার বা সম্মান বৃদ্ধির হাতিয়ার হতে পারে না। সেটা  বরং নারীর সম্মান প্রতিষ্ঠার দাবি নয়, এক প্রকার তৃতীয় শ্রেণীর রগরগা চটির আবহ তৈরি করে।

“সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’’ এটি টোব্যাকো কোম্পানিগুলোর সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। তেমনি এক শ্রেণীর স্ব-স্বীকৃত নারীবাদীর  লেখাগুলো নারীর প্রতি অসম্মান বা নারী নির্যাতনকে উস্কে দিচ্ছে সজ্ঞান বা অজ্ঞানে।

সমাজ অনেকখানি পাল্টেছে। পাল্টেছে সব রাষ্ট্রেরই সমাজ সংস্কৃতি। সেটা পাল্টে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তালেবান পূর্বক আফগানিস্তানের সংস্কৃতি বা সমাজ ব্যবস্থার সাথে আজকের আকাশসম পার্থক্য। তখনকার সময়ে কাবুলের রাস্তায় আধুনিক সাজ-সজ্জায় নারীদের দেখা যেত, আজ যা কল্পনাতীত।

সমাজ ব্যবস্থা, সংস্কৃতি পাল্টেছে বাংলাদেশেরও। নভেরা আহমেদ যখন গলায় মালা পরতেন, শামীম সিকদাররা যখন শার্ট-প্যান্ট পরতেন, তখন অনেকেই কটু কথা বলেছে, আজ সে পরিস্থিতি নেই। আজ নারী নারী হিসাবে সমাজে যথেষ্ট সম্মান নিয়ে চলছে, স্বকীয়তায়, স্বাধীনতায়। তাকে পরাধীন ভাবার কোনো কারণ নেই। কিছু নারী পরাধীন আছে। সবাই স্বাধীন হতে চায়ও না, সেটা মাথায় রাখতে হবে। সব স্বাধীনতা মঙ্গলজনকও হয় না অনেক সময়। সিরিয়ার মতো স্বাধীন রাষ্ট্রের চেয়ে হংকং এর মতো পরাধীন থাকা ভাল নয় কি?

কিছু মানুষ  ভিন্ন মতের আছে, যারা নারীকে ছোট করে দেখে তবে সেটা সামগ্রিক সমাজের দোষ নয়। এখনও কিছু পুরুষ নারীদের কটুক্তি করে নানা বিষয়ে, কিন্তু এ নিয়ে সামগ্রিকভাবে পুরুষজাতিকে হেয় করাটা অযৌক্তিক। আর ধর্ষণ সেটা নিশ্চিত বর্বরতা। এবং আমি দৃঢ়তার সাথে উচ্চারণ করছি এটি ঐ পুরুষের মানসিক সমস্যা। ধর্ষণকারী মানসিকভাবেই বিকারগ্রস্ত, একটু অশ্লীলভাবে বলতে গেলে যৌন নেশাগ্রস্ত। সেই ব্যাখ্যাটা এই লেখায় দেয়া অনুচিত হবে। নারীবাদের নামে এই তথাকথিত শ্রেণীর প্রলাপ বন্ধ হওয়াটা জরুরি, কেননা তারা নিজেদের জন্য সামগ্রিকভাবেই নারীকে হেয় করছে। সেটা অচেতন বা ব্যক্তি স্বার্থে সচেতনভাবেই হোক।

প্রতিবাদ হোক শালীনতায়, নম্রতায়, সভ্যতায়। অশ্লীল প্রতিবাদী ভাষা সমাজে শালীনতা আনবে সে প্রত্যাশা দূরাশা হবেই নিশ্চিত থেকো হে স্বার্থবাদী নারীবাদী (একশ্রেণীর)।

শেয়ার করুন: