নাহিদ খান: মা শোনো, আমি না খুব ক্লান্ত, অস্তিত্ব বাঁচানোর সংকটে, নিজেকে টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে, ঘরে-বাইরে অহর্নিশ কালবৈশাখীর ঝাপটায় আমি বিপর্যস্ত আর বিপন্ন। আমরা বন্ধুরা বলি- শ্যাটার্ড, বাংলায় হবে ‘ছিন্নভিন্ন’।

আমার আর ভালো লাগে না, ছোট হয়ে যেতে ইচ্ছে করে, যখন টিকে থাকার লড়াই ছিলো না…
– আচ্ছা? কতো ছোট হবি? স্কুল ছাত্রী? ক্লাস নাইন?
– ক্লাস নাইন? নাহ্, ক্লাস নাইন আমার বড় কষ্টে কেটেছে, এইটে বৃত্তি পাইনি, তুমি আর বাবা সারা বছর সেই খোঁটা দিতে। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করতো। তারপর গলির মোড়ে কয়েকটা ছেলে মিলে দাঁড়িয়ে থাকতে শুরু করলো হঠাৎ করে, আমি যখন ক্লাস নাইনে। স্কুলে যেতে আসতে তাদের হাসি, টিটকিরি, এমনকি একবার চিঠি না কী যেন ছুঁড়ে ও দিলো। কাউকে বলতে পারতাম না, আমার নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করতো। পাশের বাসার মুনিরা চাচী একদিন বললো, ‘তোমাকে দেখে এমন করে কেনো, অন্য কাউকে তো করে না’।
ক্লাস নাইন ভালো ছিল না মা।
আর ঐ গোলাপী রঙয়ের উচ্চতর গণিত বইটা, অমন সুন্দর বইটা, আমি সেজন্য উচ্চতর গণিত নিলাম, কিন্তু অঙ্ক পারতাম না। অঙ্ক স্যার এমন সব বাজে বকা দিতেন আমার অদৃশ্য হতে ইচ্ছে করতো।
মা, আমি আরো ছোট হতে চাই, ক্লাস নাইনে আমি নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করেছি।
– তাহলে প্রাইমারি স্কুল? ক্লাস ফোর?
– ক্লাস ফোর? মা তখন তোমরা কোত্থেকে ঐ হুজুরকে পেয়েছিলে বলো তো? হুজুর আমার পৃথিবী দোজখের আগুন, কবরের সাপ আর পুলসিরাতের ধারালো সাঁকো দিয়ে দুর্বিষহ করে তুলেছিলো। তোমরা জানো না, আমি স্বপ্নে আগুন আর সাপ দেখতাম, এখনও দেখি।
মা আমি আরো আরো ছোট হয়ে যেতে চাই, তোমার পেটের ভিতর, একদম একটা ভ্রুণ, যার কোনো ভাবনা নেই, কোনো লড়াই নেই…
– তাই বুঝি? একটা ভ্রুণ কে মায়ের শরীরে টিকে যেতে কতো সংগ্রাম করতে হয়, তুই জানিস না? মা’র শরীরে ভ্রুণ একটা ‘ফরেন পার্টিকেল’, শরীর তাকে ফেলে দিতে চায়।
শোনরে মেয়েটা- একটা ডিম্বানু আর শুক্রাণু মিলে যেই মুহূর্তে একটা মানব-ভ্রুণ তৈরি করে, সেদিন থেকেই মানুষের টিকে থাকার লড়াই শুরু, জনমভর সেই অস্তিত্বের সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ নেই, মুক্তি নেই, নিষ্কৃতি নেই…