“নারী জনম, হয়তো দোয়েল পাখির নয়-মানুষের জনম হোক”

আফসানা কিশোয়ার: “মেয়ে হয়ে জন্মেছো, মাতো হতেই হবে। মাতৃত্ব নিয়ে এত ঢং এর কী আছে? আমার মায়ের বাচ্চা ছিল নয়জন, ঢেঁকিতে পাড় দিতে দিতে আঁতুড় ঘরে গিয়েছে, বাচ্চা হয়েছে,আবার কাজে লেগে গেছে। তোমরা এ যুগের মেয়েরা একজন বাচ্চা লালন-পালন করতে হিমশিম খাও”।

আমরা যারা মধ্যবয়স ছুঁলাম বলে,তারা এমন বাক্য আমাদের বাবা-কাকা-মায়েদের কাছ থেকে শুনে থাকি বা শুনে এসেছি।এমনও শুনি, তোমার দাদী ১২ বছর বয়সে বউ হয়ে এসেছে, কই তাদের তো তোমাদের মতো এতো জটিলতা ছিল না গর্ভধারণ নিয়ে!

lochan
আফসানা কিশোয়ার

জটিলতার কথা তো আপনারা শুনতে চাননি, তাই জানেন না। এই যে মনোয়ারা বেগম বয়স পঁচাত্তর, ডাক্তারের চেম্বারে যাকে দেখলাম, তার পুরো জরায়ু বাইরে। তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো পায়খানা-পেশাবে সমস্যা হয় কি না, তিনি নির্বিকার আঞ্চলিক ভাষায় জানিয়ে দিলেন, “অইডা হাত দিয়ে চাইপে উপরের দিকে উডায়ে বাথরুম কইরে ফেলি”…।

প্রতি এক হাজার জন বিবাহিত নারীর ভেতর দুজনই প্রসবজনিত জটিলতার কারণে ফিস্টুলাতে ভুগছেন।

লেবার পেইন উঠেছে, কিন্তু প্রচলিত যে পদ্ধতি ধাই বা মিডওয়াইফের মাধ্যমে প্রসব করানো, তাতে বাচ্চা বের করা যাচ্ছে না, বাচ্চার মাথা এসে পেলভিক এর টিস্যুর উপর চাপ দিচ্ছে, এ অবস্থায় গর্ভবতী নারী যখন ২৪ ঘণ্টা পার করে ফেললো তখন নারীর জননাঙ্গের সাথের টিস্যুতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে পঁচন ধরে-জোর-জবরদস্তি করে বাচ্চা বের হলো, ফলাফল জননাঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত ছিদ্র তৈরী হওয়া, কখনো রেক্টাম ছিঁড়ে যাওয়া, পেশাবের রাস্তা ও পায়খানার রাস্তা এক হয়ে যাওয়া।

এ ধরনের কাণ্ড বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যাদের সাথে ঘটে সেই হিসাব পাওয়া ২০ লক্ষ নারীর অর্ধেকেরই বয়স ২০ বছরের নিচে। অপুষ্টিতে ভুগছে, ১৫-১৬বছর বয়সে মা হচ্ছে, সিজারিয়ান প্রয়োজন, ফরসেপ বেবি হওয়া দরকার, হাসপাতালের কেয়ার দরকার, অথচ কপালে জুটেছে ধাই বা বয়স্ক কোনো আত্মীয় নারী প্রসবের সহযোগী হিসেবে। এবং সাথে আছে অকাট্য যুক্তি, “আমাদের দাদী-নানী-মা -খালাদের কি বাচ্চা হয় নাই!”

birthযাই হোক বাচ্চা হলো, এরপর শুরু হয় সেই মায়ের অকারণ অভিশাপের এক জীবন, পেশাব ঝরছে, পায়খানা ধরে রাখা যাচ্ছে না, স্বামী সহবাস বন্ধ, শরীরে গন্ধ, পরিবারে জায়গা নাই, এক ঘরে বসবাসের উপায় নাই, নিজে উপার্জন করার যোগ্যতা নাই, কেউ গোয়াল ঘরে পড়ে থাকছে, কেউ বা ভিক্ষা করছে। স্বামী আরেক বিয়ে করে ফেলেছে অবশ্যম্ভাবীভাবে।

এমন এক ঘটনা চাক্ষুষ করলাম আজ তিন বছর। অল্প বয়স্ক মেয়ে, সে নাকী ডিভোর্সি, দু বাচ্চা জামাই রেখে দিয়েছে। তার দ্বিতীয় বাচ্চা হবার সময় ডেলিভারি পেইন ছিল দেড় দিন। তারপর বাচ্চা হয়েছে টেনে হিঁচড়ে, ধাই এর মাধ্যমে।

ব্যস এরপর থেকে তার অল্প অল্প পেশাব ঝরে, পেশাবের রাস্তা দিয়ে স্টুলও আসে। ডাক্তার না, হাসপাতাল না। জামাই বউ এর সাথে ঘুমাতে পারে না, তাই সকাল-বিকাল বউ পিটানো। যতদিন বাচ্চা বুকের দুধ খেয়েছে ততোদিন স্বামীদের গোয়াল ঘরে থাকতে পেরেছে। এরপর ডিভোর্স। ভাসতে ভাসতে আমার কাছে।

বিয়ে হয়েছিলো পনেরো বছর বয়সে, ২১ বছর বয়সে তালাক, শারীরিক এ অসুবিধা নিয়ে।

আমার পণ ছিলো তাকে ভালো করার সব চেষ্টা করবো।

ডাক্তার বন্ধুদের পরামর্শে পেলাম এ কাজে পারদর্শী একজনের দেখা। তিনি গত ২৯শে নভেম্বর অপারেশনের কাজটি করলেন।

আমি রোগীর কে হই? হয়তো মা-ই ছিলাম রোগীর কোনো জন্মে। এতো বড় ইতিহাস লিখলাম এটুকু বলতে, এরপরও কী বিশেষ ধারা রেখে কন্যা শিশুকে ১৬-তে বিয়ে দেয়া বৈধ করার পক্ষে দলকানা সুবিধাবাদীরা কথা বলেই যাবে!

দুধেল গাইকেও এক একটি পরিবার অনেক যত্ন করে। নারীকে করে না। আর করে না বলেই ২০ লাখ নারী প্রসব-পরবর্তী ফিস্টুলায় ভুগে। আমরা বলি এ পাপের ফল। আদতে পাপ কার?

WCL 1৮২ শতাংশ ফিস্টুলা নিরাময়যোগ্য। সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে এর চিকিৎসা আছে। বেসরকারি পর্যায়ে সাতটি হাসপাতাল এ বিশেষ ইউনিট আছে। ২০০৩ এর এক হিসাব মতে যদি একশ ভাগ ফিস্টুলামুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চাই তাহলে ৯১০০০ হাজার ফিস্টুলা রোগীর অপারেশন শেষ করতে আমাদের ২৯৪ বছর লাগবে। সে কারণে বারবার ফিস্টুলা প্রতিরোধের কথা বলা হচ্ছে।

আমি একজনকে রোগ-পরবর্তী সেবা দেবার চেষ্টা করেছি, আপনি পাশের নারীর হাতটি ধরুন, বলুন, কেন মেয়েবাচ্চাকে অল্প বয়সে বিয়ে দেয়া এবং গর্ভধারণ করতে দেয়া বিপদজনক।

মা হওয়া কোন খেলার ব্যাপার নয়, নারীর জীবন দাঁতে আটকানো উচ্ছিষ্ট খাবার নয় যে খিলাল করতে করতে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম, আর মুক্ত হয়ে গেলাম।

নিজে সুস্থ থাকুন,অন্যকেও সুস্থ থাকতে সহায়তা করুন।

তথ্য উৎস্য: ইন্টারনেট (পরিসংখ্যান)

শেয়ার করুন: