ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী: স্নান সেরে সকালের পত্রিকা আর কফির মাগ হাতে বারান্দায় বসতে মৌমিতার বেশ লাগে। সাথে পিয়ানোতে রবীন্দ্রসংগীত – জীবন সত্যিই বড্ড সুন্দর! একদম নিজের সাথে সময় কাটানো যায় এসময়। বাচ্চারাও আরাম করে ঘুমোচ্ছে। বারান্দার গাছগুলো তার মতোই সদ্যস্নাত, সতেজ। বাচ্চাদের স্কুলের সাথে তাল মিলিয়ে ছুটিটা নিয়েছে সে। ছুটির কয়েকটা দিন ওদের নিয়ে কক্সবাজার যাচ্ছে এবার। আজ রাতেই রওনা হবে তারা।
আবীর চেয়েছিল সফরসঙ্গী হতে, মৌমিতা সায় দেয়নি। গেলে হয়তো তার ভালোই লাগতো, দীপ্ত আর হৃদিতাও আবীরকে খুব পছন্দ করে। আসলে মৌমিতা বাচ্চাদের সাথে একান্তে কিছুসময় কাটাতে চায়। সেখানে আবীরও তৃতীয় ব্যক্তি।
সারা বছর ব্যস্ত সময় কাটলেও মৌমিতার খারাপ লাগে না।

একটা সময় ছিলো, যখন দুদণ্ড শান্তিতে বসতে পারতো না। দীর্ঘদিন ধরে নিজের জীবনটা অন্যের ইচ্ছেমত চালিয়ে এখন সে আর যাই করুক নিজের জীবনের মূল্যটুকু বোঝা শিখেছে। তাই শত ব্যস্ততার মাঝেও নিজের জন্য সময় বের করতে ভোলে না।
“একটা বয়সী মহিলা, নষ্ট , ডাস্টবিনের পচা মাল.. তোর মতো নোংরা চরিত্রের জিনিসকে আমি বিয়ে করছিলাম কী করে এইটাই আমার মাথায় আসেনা… আমি তোরে ছাড়াতে তুই তো বেঁচে গেছিস.. তোর চরিত্রের খবর আমি জানি না ভাবছিস? আবীরের সাথে শুতে খুব মজা লাগে তাইনা?”.. আস্তে ফোনটা অফ করে দেয় মৌমিতা।পরের কথাগুলো তার জানা।নতুন করে আর কীইবা শুনবে!
আজ তাদের বিয়ের চৌদ্দ বছর পার হয়ে গেল।দুঃস্বপ্নময় চৌদ্দ বছর, যাবজ্জীবন সেই কারাবাস থেকে মুক্ত হবার জন্য রোজ একটু একটু করে চেষ্টা করেছে মৌমিতা। অল্প বয়সে ভালোবেসে আকণ্ঠ ডুবে যাওয়া মেয়েটি বহু আগেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। নিজেকে যোগ্য করে তুলেছে।দুটো শিশু সন্তান নিয়ে যেদিন পথে নেমেছিলো সেদিন এসবের কিছুই ছিল না।
আজকের তারিখটা মনে রাখতে না চাইলেও সেই রঙিন দিনের স্মৃতি ঘুরেফিরে এসে পড়ে মৌমিতার ভাবনায়।
সেই কলেজে পড়ার সময় পরাগদের পরিবার মৌমিতাদের পাশের বাড়িতে এসে ওঠে। পরাগের মা আর ছোট বোন ঝুমুরের সাথে আলাপের সূত্রে একসময় মৌমিতারা তাদের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হয়ে ওঠে। মধ্যবিত্ত আনন্দ-বেদনার মধ্যে দিয়ে, প্রতিবেলার তরকারি ভাগাভাগি করে খেতে খেতে, বিপদেআপদে পাশে থাকার সুবাদে কবে,কখন একে অন্যের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছিলো বুঝতেই পারেনি।
পরাগ আর মৌমিতা সমবয়সী।দুজনের কলেজ আলাদা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে দুজনে একসাথে পড়ার সুযোগ পেয়ে গেল। খুলে গেল জীবনের নতুন এক অধ্যায়। ক্যাম্পাসের পরিচিত, “সুপার গ্লু” জুটি মৌমিতা- পরাগ।
পিতৃহীন সংসারের বড় সন্তান হিসেবে পরাগের দায়িত্ব আর সংগ্রাম দুটোই পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। জীবনের সেই কঠিন পথ চলায় একমাত্র মৌমিতাই ছিল আশীর্বাদ স্বরূপ। তা নাহলে কবেই হাঁপিয়ে উঠতো পরাগ। নিজের লেখাপড়ার পাশাপাশি পরাগের জীবনযুদ্ধের সংগী হতে গিয়ে মৌমিতাকেও নিজের বহু শখ- আহ্লাদ বিসর্জন দিতে হয়েছে।একটা ভালো টিউশানির খবর পেলে পরাগকে তা জুটিয়ে দিয়েছে , নিজের পছন্দের জিনিস না কিনে পয়সা জমিয়ে পরাগের হাতে তুলে দিয়েছে,কোনোদিন পরাগকে ছেড়ে ভালো কিছু খায়নি। ঝুমুরের বিয়ের সময় গোপনে নিজের গলার সোনার চেইনটা দিয়ে দিয়েছিল। নিজের মূল্যবান জীবনের প্রায় পুরোটা দিয়েই সে নিবেদিত ছিল পরাগের প্রতি।
মৌমিতার বাবা- মা দুজনেই সাদাসিধে মানুষ, কোনো কিছুতেই বাধা দেননি মেয়েকে। মা শুধু বলতেন, “নিজের সবটা বিলিয়ে দিচ্ছিস, ব্যাটা ছেলেরা এসব মনে রাখে নারে মা।কাউকে ভালোবাসতে গিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলিস না। নিজেকে আগে ভালোবাসতে শেখ, নাহলে দেখবি যার জন্য এতো ত্যাগ স্বীকার করছিস এই মানুষটাই একদিন এর মূল্য দেবেনা”.. অনেক চড়াই উৎড়াই পার করে পরাগের একটা ভালো চাকরি হয়। বড় বাড়িতে ওঠে। দুই পরিবারের পূর্ণ সম্মতিতেই বিয়ে হয়েছিল পরাগ- মৌমিতার।বিয়েতে কোনো আড়ম্বর চায়নি কনে স্বয়ং।
এমনকি বিয়ের দিন দেনমোহরের টাকা নির্ধারণ নিয়ে কথার এক পর্যায়ে মৌমিতার বড় মামা যখন বললেন, “ভদ্রলোকের বিয়েতে পাঁচ লাখ টাকার নীচে কাবিন হয়না,” সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিয়ের কনে মাথা তুলে কাজী সাহেবকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যে দেনমোহর নিয়ে কোনো ঝামেলার প্রয়োজন নেই, প্রথা রক্ষার্থে যা নাহলে নয় ততোটুকুই যেন ধরা হয়। কনে নিজে দেনমোহর কমাতে চাইছে- এমন দৃশ্যে কাজী সাহেবও হতবাক!
বিয়ের পর যথারীতি মনেপ্রাণে সংসারে নিজেকে উজাড় করে দেয় মৌমিতা। পাশাপাশি একটা স্কুলে শিক্ষকতা করে।স্কুল থেকে ফিরে বাজার,রান্নাবান্না, শাশুড়ির দেখভাল, ননদের দাম্পত্যকলহ মেটানো,বাড়ির জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠের দায়িত্ব এসে পড়ে মৌমিতার ওপর। পরাগ মেতে থাকে নিজের ক্যারিয়ার মজবুত করতে। মৌমিতার দিকে তাকাবার সময় তার খুব কমই হয়।
শাশুড়ি মৌমিতার প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও পরাগের সাথে এতোদিনের বন্ধুত্বে কোথাও যেন ধুলো জমতে শুরু করে।
প্রথম খটকা লাগে যেদিন বেতনের টাকা থেকে মৌমিতার বাবা-মাকে নিয়মিত একটা খরচ দিতে আপত্তির সুর তোলে পরাগ।শুধু তাই না, ছোটখাটো বিষয়ে মেজাজ হারানো, গালিগালাজ করাটা রোজকার অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়। প্রতি পদে বুঝিয়ে দেয় যে মৌমিতার জন্মই হয়েছে পরাগ আর তার পরিবারের সেবায় নিজেকে সঁপে দেবার জন্য।পরাগের চাকরিতে উন্নতি হতে শুরু করে ধীরেধীরে। সেই সাথে বাড়তে থাকে দম্ভ, উদাসীনতা আর স্বামিত্ব ফলানোর মাত্রাও। এতোগুলো বছর ধরে দেখে আসা পরাগকে মৌমিতা চিনে উঠতে পারেনা, কিছুতেই মেলাতে পারেনা হিসেব। এ নিয়ে বহুবার ঠাণ্ডা মাথায় আলোচনা করতে গিয়ে কোনো লাভ হয়নি বরং আরো অপমানিত হতে হয়েছে।
এর মাঝেই পৃথিবীতে আসে তাদের দুই সন্তান দীপ্ত আর হৃদিতা। সংসারে মৌমিতার ব্যস্ততা আর দায়িত্ব বেড়েই চলে। নিষ্ঠার সাথে সব কর্তব্য পালন করে চলে সে। ক্রমেই পরাগের কাছে সে কেবলই দায়িত্ব পালন করার যন্ত্রে পরিণত হতে থাকে। প্রথম দিকে মৌমিতা ভাবতো, অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হলে হয়তো
সব ঠিক হয়ে যাবে। যত দিন যায় বুঝতে পারে, তার কাছ থেকে না চাইতেই সব পেতে পেতে পরাগ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে এবং এজন্য তার ভেতরে কৃতজ্ঞতার লেশমাত্র নেই। মানুষ হিসেবে মৌমিতার প্রতি তার কোনো শ্রদ্ধাবোধও নেই।
আত্মীয়স্বজন, দোকানদার, রিকশাওয়ালা এমনকি বাচ্চাদের সামনে পর্যন্ত সবসময় হেয় করে কথা বলাটা দুর্বিষহ লাগতো মৌমিতার।কারণেঅকারণে বয়স নিয়ে খোটা দিতে শুরু করে,চেহারা নিয়ে কটাক্ষ করে। কথায় কথায় বলে,”আয়নায় চেহারা দেখিস?তোর মতো অচল জিনিস নিয়ে তো ঘর করা যায়না”..
এমন অন্যায় ব্যবহার আর নিতে পারেনা,
খুব সাবধানে নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে মৌমিতা। তাও পরাগের রোষানল থেকে রেহাই মেলেনা –
“এই জন্যে তো সমবয়সী বিয়ে করতে নেই, বয়সে কচি মেয়ে বিয়ে করলে অনেক ভক্তি -সমীহ করে চলতো”..শাশুড়ি একদিন ছেলেকে বলেন, “তোর জন্য কষ্ট করেই তো মেয়েটার এই হাল! ” জবাবে ছেলে তাচ্ছিল্য ভরে বলে,” কবে কী উপকার করে মাথা কিনে নিয়েছে একেবারে”..
বড় বাড়ি – গাড়ির মালিক হলেও পরাগের এই হীন মানসিকতা মেনে নিতে পারছিলোনা কিছুতেই। বাড়িতে ফেইসবুক আর ফোন নিয়েই মধ্যরাত অবধি ব্যস্ত থাকতো পরাগ।
যেদিন সুমনার সাথে পরাগের সম্পর্ক আর বিয়ের সিদ্ধান্তের কথা জানতে পেরেছিলো, সেইরাতে ছাদে গিয়ে অঝোরে কেঁদেছিল মৌমিতা।সুমনা পরাগের সহকর্মী। প্রচলিত অর্থে সুদর্শনা এবং অবশ্যই সমবয়সী নয়। দীপ্তর বয়স তখন আট বছর, হৃদিতার মাত্র ছয়।
পরাগের সাথে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল অনেক আগেই।তাই নতুন করে হারাবার কিছু ছিলোনা।তবুও মৌমিতা কেঁদেছিল নিজের বোকামির কথা ভেবে, মায়ের কথাগুলো মনে করে – “ভালোবাসতে গিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলিস না মাগো”.. সত্যিই নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলো সে। তিন দিনের মধ্যে বাড়ি ছাড়ে মৌমিতা।পরাগের কাছ থেকে দেনমোহরের টাকা সে নেয়নি।নেয়নি বাচ্চাদের ভরণপোষণের খরচ। বাবা- মা আর শাশুড়ি সেই দুর্দিনে সাহস জুগিয়েছে তাকে। প্রচণ্ড আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মৌমিতা ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো,ভালো চাকরি পেয়ে,বাবা-মাকে নিয়ে পাশাপাশি ফ্ল্যাটে বাড়ি নিয়ে সামনে এগিয়ে চলা শুরু। এখন তো নিজের ফার্ম নিয়ে ব্যস্ততার অন্ত নেই। দীপ্ত আর হৃদিতা মায়ের লক্ষ্মী বাচ্চা। তিনজনে মিলে খুব ভালো আছে তারা।
পেশায় আর্কিটেক্ট আবীর মৌমিতার ভালো বন্ধু। এখনো বিয়ে করেননি।মৌমিতা আর আবীর দুজনেই এই চমৎকার বন্ধুত্বকে অটুট রাখতে চায়। তাই বিয়ের কথা কিছু ভাবেনি।
ইদানীং দীপ্ত আর হৃদিতার জন্য পরাগের পিতৃহৃদয় উথলে উঠছে প্রায়শই। বাচ্চাদের ছুতোয় ফোন করে আবীরকে নিয়ে অশ্লীল গালিগালাজ করাই আসল উদ্দেশ্য।অথচ নিজে দিব্যি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সংসার করছে! মৌমিতার কেবল করুণা ছাড়া কিছুই করার নেই তার জন্য।
দীপ্ত আর হৃদিতাকে নিয়ে সমুদ্রস্নানে মেতে উঠেছে মৌমিতা। বিশাল, সবুজাভ সমুদ্রের ধবধবে সাদা ঢেউয়ের ফেনায় জীবনের দুঃখকষ্ট গুলো ভেসে যেতে থাকে। নিজেকে সত্যিই আজ ভীষণ ভালোবাসে মৌমিতা।