ফেরদৌস কান্তা: আমরা কী ভুলো মনের জাতি! সব ভুলে যাই! আমাদের কি মনে আছে অসংখ্য তনু,পূজা আর খাদিজার কথা! ভুলে যাবারই কথা। একটা মনে আর কতো কিছুই বা আঁটে! নিত্য নতুন ইভেন্ট প্রতিদিন, আর আমরা ভেসে যাই। সবচেয়ে ভয়াবহ হলো আমরা ভুলেই গেছি যে অভিধানে ‘প্রতিবাদ’ বলে একটা শব্দ আছে। মার খেতে খেতে সবকিছুই গা সওয়া হয়ে গেছে। কিছুই অনুভূতিতে আসে না। কী ঘরে, আর কী বাইরে! সবখানেই এক অবস্থা। এর থেকে যেন পরিত্রাণ নাই। হিসাবের বাইরে কেউ মুখ খুলেছে তো হলো আর কী। সমাজ ছাড়া হতে দেরি হয় না, মাঝে মাঝে দুনিয়া ছাড়াও হতে হয়।

খুশির খবর যে খাদিজা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলো। মেয়েটার ভাগ্য আসলেই খুব ভালো। তাই এ যাত্রা বেঁচে গেলো। কিন্তু কত যে খাদিজারা পথে-ঘাটে লাথি, গুঁতা খাচ্ছে, আর নানাভাবে মরছে, পচছে আর গলছে! কিন্তু একটা খুশির খবরের সাথে থাকে নানান রকমের দুঃসংবাদও। কীসব আইন পাশ হচ্ছে শুভংকরের ফাঁকি নিয়ে। আইন ভাল বুঝি না, কেবল এইটুকু জানি যে, যেই আইনই আসুক, সেটা মানব অধিকার রক্ষার পক্ষেই হওয়া উচিত। কিন্তু যেটা শুনছি আর বুঝতে পারছি তা হলো, যেখানে মেয়েদের বিয়ের বয়স আরও পেছানো উচিত ছিল, সেখানে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র সংযুক্ত করে বাল্যবিবাহকে বৈধ করা হচ্ছে।
এই অধিকার আসলে সরকারকে কে দিয়েছে? বাঙ্গালী বিশেষ আইন বুঝে না, আইন আছে মনে করেই বিসমিল্লাহ্ পড়বে, তারপর সবকিছুর মালিক আল্লাহতায়ালা বলে বাচ্চা-বাচ্চা মেয়েগুলির স্বপ্নসাধ ধূলিসাৎ করে বিবাহ দিয়ে দিবে। তারপর লম্বা করে শোকরানা আদায় করবে দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছে বলে।

আমরা ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছি, কিন্তু মনে ও মননে আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে পদার্পণ করেছি। এখন কি হবে? কিছু মেয়ে সরাসরি পরিবারের দ্বারা বলি হবে, কিছু হবে বখাটে দ্বারা, কিছু হবে প্রভাবশালীদের দ্বারা। তারমানে দাঁড়ালো যে, যেভাবে পারে সেভাবেই সমাজ আমাদের গলাটিপে ধরার অধিকার রাখে। তাহলে এত রঙ-ঢঙ এর আসলে দরকার কি? এইগুলি কাকে দেখিয়ে খুশি করা হয়? নারীশিশু উন্নয়নের কথা বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছেন যেসব মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়, তাঁদের বিবেক কোথায় থাকে যখন এইসব আত্মঘাতী আইন নিয়ে আলোচনা হয়! আবার তা পাশ হয়!
অনেক মহিলা সমিতি দল আছে এদেশে, যারা বেশ সোচ্চার হোন চুন থেকে পান খসলে, তাঁদেরও কিন্তু এইসব নিয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্চ্য করতে দেখি না। আমাদের মত আত্মপ্রবঞ্চক আসলেই কম আছে। তার কারণও আছে বৈকি!
যতোই ফাঁকা বুলি কপচিয়ে নারী আন্দোলন করেন তারা, ঘরে ফিরে গিয়েই হয়ে যান ট্র্যাডিশন্যাল ওয়াইফ। তখন স্বামীর সাত-খুন মাফ করে দিতে তাঁদের মতোন উদার খুব কমই দেখা যায়। আমার কাছের অনেককেই দেখেছি, স্বামীর অন্য নারী আসক্তি জানা সত্ত্বেও এ নিয়ে কোন উচ্চবাচ্চ্য করেন না।
খুব কাছের এক বান্ধবী এই সমস্যা শেয়ার করাতে জিজ্ঞ্যেস করেছিলাম, তোর ঘৃণা লাগে না ওকে? তার উত্তর ছিল, আমারও কিছু চাহিদা আছে, আমি কোথায় যাবো? এরপর এই নিয়ে আর কোন আলাপ করতে আমার রুচিতে কুলায়নি।
আর কিছু আছেন, যারা তাদের পতিদেব যতোই অন্যায়-অপরাধ করুক না কেন, কখনওই পতিদেবকে ছোট করতে রাজি নন। তাদের ভাষ্যমতে, পুরুষের এইরকম দোষ এক-আধটু থাকতেই পারে। এটা কোনো ব্যাপার না। সংসার চালাচ্ছে, বাচ্চার মা বানাচ্ছে, সমাজে ‘মিসেস’ হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, সুতরাং এইরকম ছাড় দেয়াই যায়। কীইবা আসে যায়, দুই-চার জনের সাথে বাইরে শুয়ে আসলে! তার ভাগে তো আর কমতি পড়ছে না। তাদের চোখে বরং সেইসব নারীরাই খারাপ, যারা তাদের ফুলের মতো নিষ্পাপ পতিদেবদের দিকে চোখ দেয়, সম্পর্কে জড়ায়।
তো, এই সমাজে এই আইন পাশ হওয়াটা আসলে অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমাদের মেয়ে বাচ্চাগুলি এখন থেকে ধর্ষণের শিকার হবে, তারপর বাবা-মা সালিশ করে ওই ধর্ষকের এর সাথেই বিয়ে দিয়ে দিবে। যেই ধর্ষককে দেখলে বাচ্চা মেয়েটা হয়তো সারাজীবনের জন্য মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যাবে, তাকে মেয়ের জামাই বানিয়ে পোলাও-বিরিয়ানী খাওয়াবে।
অথবা সমাজের ক্ষমতাশালী নারী লোভীরা, যাদের কচি মাংস ছাড়া মুখে রোচেনা, তারা বাচ্চা বাচ্চা মেয়েগুলি টার্গেট করবে, কিছু লোভী বাবা-মা থাকেনই , এই লোভনীয় অফার এর জন্য ( বহু শিক্ষিত ফ্যামিলিতেও দেখেছি, হুদাই আমরা শিক্ষার অভাব বলে গলা ফাটাই), ঝাঁপিয়ে পড়বেন আইনের বাস্তবায়নের জন্য। ধন্য বাংলাদেশের নারী সরকার! ধন্য আমরা!
হাল ছেড়ে দেবো তবে? উহু, তাই কি হয়! না হয় না। এই মেয়েদেরই জাগতে হবে। একজন শিক্ষক হিসাবে আমি যখন মেয়েবাচ্চাদের ভাল রেজাল্ট, উজ্জ্বল চোখের তারা, আর সাথে ঝলমলে ভবিষ্যৎ দেখি তখন কায়মনে তাদের জন্য প্রার্থনা করি, মেঘ সরে যাক আস্তে আস্তে। দিন ফিরুক। এরা মতামত দেয়ার মতো, শক্ত করে মুখের উপর না বলার মতো শক্তি অর্জন করুক। হোক সে বাবা-মা, কিংবা সমাজের যেকোনো কাউকে।
সবার আগে এদের শিখাতে হবে সম্মান বিবেকে, মননে আর কর্মপরিধিতে, সম্মান শরীরে নয়। যারা সচেতন বাবা-মা, দয়া করে যেকোনো অন্যায়ে নিজে প্রতিবাদ করুন, আর বাচ্চাকেও প্রতিবাদী হতে শেখান। কোনো ছাড় নয়। সময়ের দাবী এটা। একজন আওয়াজ তুলি, দেখুন ধীরে ধীরে বহুজন সামিল হবেন সে পথে। চুপ করে থাকবেন না কিছুতেই। পেছনে সরে কোথায় যাবেন বলেন? পিছনে যে দেয়াল ছাড়া আর কিছুই নেই। সামনে যেতে হবে, তাও পথ করে নিয়ে।