বিয়ের বয়স, পরিবারিক ঐতিহ্য এবং পুরুষতান্ত্রিকতা

মেহেরুন নেছা রুমা: আমার মগজে অনেকগুলো কথা গিজগিজ করছে। কোনটা প্রকাশের আর কোনটা অপ্রকাশের, সেটিই এখন আমার বড় চিন্তার বিষয়।  ব্যাপারটা এমন যে ইচ্ছে করলেও আমি আমার মনের অব্যক্ত কথাগুলো পুরোপুরি কোথাও ব্যক্ত করতে পারি না।  আমার সেই স্বাধীনতার কোথাও একটা অদৃশ্য শেকল বাঁধাই থাকে। লেখাটি যারা পরবেন তারা হয়তো এর মধ্যে অন্য গন্ধ খুঁজবেন, বলাবলি করবেন আমি যেহেতু এসব লিখছি তো আমার কোথাও কোন প্রবলেম রয়েছে। হয়তো আমার বিয়ে নিয়ে আমি সুখি নই কিংবা আমার পরিবারের উপর আমি বিরক্ত। আসলে এসব কিছুই নয়। আমি আমার ভাবনাগুলোকে ব্যক্ত করবো শুধু।

meherun-nesa-ruma
মেহেরুন নেছা রুমা

পুরুষতান্ত্রিকতা আমাদের সমাজের কোথায় নেই?

বলতে চাচ্ছিলাম মেয়েদের বিয়ের বয়স নিয়ে। প্রসঙ্গটা নিয়ে এর আগেও আমি লিখেছি। বড় বড় ব্যক্তিত্বদের বক্তব্য নিয়েছি, জাতীয় পত্রিকায় আমার নাম সহ লেখাটি বড় করে আসছে। সবই ভাল। কিন্তু এই আমি, যে বাল্য বিয়ে নিয়ে এতো যে লিখছি, এতো সভা সেমিনার মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করছি, আমিও কি এর বাইরে থাকতে পেরেছি? যখনই বিষয়টি নিয়ে কোন কাজ করেছি বা  না করেছি আমার ভেতরে কী সর্বক্ষণ ঘুণপোকার মত একটি পোকা ম ম আওয়াজ করে না যে আমিও বাল্যবিয়ের শিকার? আমারও কত কত সমস্যার পাহাড় ডিঙিয়ে উত্তরণ করতে হয়েছে এক একটি সময়কে?

সরকার মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স আঠারো রেখেছে। তবে একটা ‘তবে’ ঝুলিয়ে রেখে। এই তবেই তো আমাদের যতো সর্বনাশ করে ছাড়বে। এমনিতেই আমরা যৌন নির্যাতনের সকল সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছি, ঘরে ঘরে নারীর উপর, কন্যা শিশুর উপর অমানুষিক নির্যাতন উত্তরোত্তর বেড়েই চলছে, তার উপর যদি বিশেষ অবস্থায় মেয়েদের বিয়ে আঠারোর আগেই দেয়ার বিধান করে তো এসব জোর জুলুমের মাত্রা যে আরো বহুগুণে বেড়ে যাবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

এতোদিন তবু শহর থেকে গ্রাম প্রত্যেকেরই একটা সাধারণ ধারণা ছিল যে মেয়েদের আঠারোর আগে বিয়ে দেয়া আইনত অপরাধ। তাই কিছুটা হলেও এর প্রতিরোধ করা গেছে। তবু কোন কোন পরিবারের লোকেরা ছেলে মেয়ের বয়স বাড়িয়ে নানা উপায়ে তাদের ছেলে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন। আবার এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে বিয়ে দিচ্ছেন। এগুলোর সব খবর আমাদের কাছে আসে না। অসংখ্য কিশোরী মেয়েরা অকালে মা হয়ে শারীরিক মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ জীবন হারাচ্ছে। অনেক কিশোরী মা হয়ে স্বামী পরিত্যক্তা, কেউ বা বিধবা হয়ে বাপের সংসারেই মানবেতর জীবন যাপন করছে।

early-marriage-2ওই বিশেষ আইনে আদালতের কাছে কজন যাবে অনুমতি আনতে? অনেক অভিভাবকই তো তাদের মেয়ের বিভিন্ন সমস্যা দেখিয়ে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবেন। সরকার সেই সুযোগ করে দিয়েছেন। আবার সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে কিশোর বয়সের প্রেম , বিয়ের আগেই মা হওয়া ইত্যাদি বৈধতা দেয়ার একটা সুযোগ হিসেবে ওই বিশেষ আইনটি রেখেছেন। তাহলে কী বলব সরকার কিশোর বয়সের প্রেম বিয়ে ধর্ষণ এ সবকিছুর বৈধতা দিচ্ছে?

আমি যখনই কোন সভা সেমিনারে যাই বাল্য বিয়ে নিয়ে কথা হলে আমার ভেতরের আমি’টা তোলপাড় করে। কোন এক নিভৃত যাতনায়। আমি খুব অসুখি আছি তা বলব না। তবে আমিও যে চরমভাবে পুরুষতান্ত্রিকতার শিকার এটা অস্বীকার করি কিভাবে?

আমার পিতামহ ছিলেন বৃটিশ আমলের একজন গ্রাজুয়েট। শুধু তাই নয়। তিনি ছিলেন আমাদের উপজেলার সর্বপ্রথম গ্রাজুয়েট ।  ওই সময়ে তাকে দেখতে নাকি দূর দূরান্ত থেকে লোকজন আসত। আমি সেই পিতামহের নাতনী এটি অবশ্যই আমার জন্য গৌরবের। কিন্তু প্রদীপের নীচে অন্ধকার থাকে। আমার পিতামহ তার পাঁচ কন্যাকে তিন থেকে এগার বছর বয়সের মধ্যে বিয়ে দিয়েছিলেন। এমনকি একজনকেও সেভাবে লেখাপড়া করাননি। নিজে অত বড় বিদ্বান হয়েও তিনি ছিলেন চরম পুরুষতান্ত্রিকতার ধারক ও বাহক। আমার ফুপুদের শিশুবিবাহ দিলেও ফুপাদের বয়স কিন্তু কম ছিল না।

Rape victএতো গেল আমার ফুপুদের কথা। যাদের অনেকেই এখন জীবনের সন্ধ্যাকালে এসে স্মৃতিচারণ করেন। তাদের বিয়ের কথা খুব একটা তারা বলতে পারেন না। এতোটাই ছোট ছিলেন যে সেই সময়ের কোন ঘটনা তাদের মনে নেই। তবে যখন থেকে বুঝতে শিখেছেন. তখন থেকে তাদের জীবন যে খুব সুখের ছিল না এটি তারা বুঝতে পারতেন।

আমার পিতামহ তার কন্যা সন্তানদের লেখাপড়া না শেখালেও তিনটি পুত্রকে ( আমার বাবা, দুই চাচা) ঠিকই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছিলেন। কেননা পুত্র হলো বংশের বাতি। পিতামহ সেই বাতি জ্বালিয়ে রেখেছিলেন।

আমার পিতামহ যে কাজটি করেছিলেন বৃটিশ আমলে, উনবিংশ শতাব্দীতে এসে আমার পিতা সেই কাজটি থেকে কতটা সরে আসতে পেরেছিলেন? তিনিও আমাদের দুই বোনকে শিশুকাল থেকেই বিয়ে দেয়ার জন্য চিন্তা করতে থাকলেন। অনেক সংগ্রাম করে আমার বড় বোন এসএসসি পরীক্ষাটা দিতে পেরেছিল। আর আমাকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরপরই বিয়ে দিয়ে দিলেন। এখনকার সময়ে হলেও আমার বিয়েতে আমার বাবা আমার মায়ের অনুমতি নেননি। আমার তো নয়ই। এমনকি যার সাথে আমার বিয়ে হবে তাকে দেখতে পর্যন্ত দেননি।

যে সময়ে  একটা ছেলে বা একটা মেয়ের জীবনে কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয় সে কোন বিষয়ে পড়বে কি পড়বে ,সেই সময়ে আমাকে বিয়ে দিয়ে আমার সামনের সমস্ত জীবনটাই এক পলকে স্থবির করে দিলেন। বিয়ের কোনো সুখময় স্মৃতি আমারও নেই। আমার মাথায় একটাই চিন্তা ছিল, আমি কি পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে পারবো? সবার কাছে আকুতি করেছিলাম, আমাকে যেন পড়তে দেয়া হয়। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাই।

কিন্তু আমার পিতার রায়ের উপর কারো কোন কথা বলার বিধান ছিল না।

সেই আমি ওই সময়ে একটা ছোট পরিবার থেকে একটা বড় পরিবারে এসে পড়ি। সবকিছু সামলে কিভাবে যে আমার লেখাপড়া চালিয়ে যাই সে শুধু আমিই জানি। অনেক সংগ্রাম করে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করি। লেখালেখি করি, পত্রিকায় কাজ করি। কিন্তু যুদ্ধটা যে আমার প্রতি মুহূর্তে চলে, সেটা শুধু আমিই উপলব্ধি করি। এখনও আমি সেই যুদ্ধ ময়দানে। আমার মনে অবিরাম লড়াই চলে। টিকে থাকার লড়াই। অস্তিত্বের লড়াই।

তাই আমাকে দিয়ে বলতে পারি, আঠারোর আগে কোনক্রমেই একটি মেয়ের বিয়ে নয়। মেয়েদের বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে অবশ্যই তার মতামত জানতে হবে। সবার আগে মেয়েটিকে আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। তবেই বিয়ে। এমন এক সময়ে বিয়ে দেয়া উচিৎ নয় , যে সময়ে বিয়ে হলে তার পুরো জীবনের চাকা স্থবির হয়ে যায়। অসময়ে মা হতে গিয়ে কত মেয়েই তার লেখাপড়া, চাকরী এমনকি স্বাস্থ্য হারিয়েছে। কখনও কখনও জীবনও হারায়।এ হারানোর তালিকা আর বাড়াতে চাই না। কোন বিশেষ অবস্থাতেই নয়। বিয়ে হতে হবে আঠারোর পর।  

শেয়ার করুন: