লীনা ফেরদৌস: ফুলবাড়িয়া ডিগ্রী কলেজের জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলনরত একজন শিক্ষক হত্যার ঘটনায় গোটা জাতি আজ নির্বাক, এতটাই নির্বাক যে এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে কোন বড় রকমের প্রতিবাদ আমার চোখে পড়ে নাই। অবশ্য এই মৃত্যুর জন্য দায়ী ওই কলেজের শিক্ষক নিজেই, ছাত্রদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কেনই বা তিনি রাজপথে নামবেন, আন্দোলন করবেন।
যুগের সাথে সাথে তাকেও বদলানো উচিত ছিল, তার বোঝা উচিত ছিল যে এই যুগে শিক্ষকদের ছাত্রছাত্রী বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য আন্দোলন করা উচিত নয়, বেশীরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই দলীয় রাজনীতির হীন স্বার্থ চরিতার্থে জিম্মি। এই যুগ পরিমল নামের শিক্ষকদের যুগ, এই যুগ কোচিং বাণিজ্যের যুগ, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নিজেদের আখের গোছানোর যুগ- এই যুগে এরকম শিক্ষক কিন্তু বড্ড বেশী বেমানান ।
উচ্চ শিক্ষাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিত সরকারের একটি সিদ্ধান্ত ছিল যে যেসব উপজেলায় সরকারী স্কুল ও কলেজ নেই সেখানে একটি করে বেসরকারি স্কুল ও কলেজ জাতীয়করণ করা হবে, যা শিক্ষার মানোন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং এই কাজটি নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
এই জাতীয়করণের নীতিমালাতেই স্পষ্ট বলা হয়েছে -যে উপজেলায় সরকারী কলেজ নাই সেই উপজেলা সদরের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা সংবলিত কলেজকে জাতীয়করণে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। এর প্রধান এবং প্রথম শর্ত ছিল সবচেয়ে ভাল ফলাফল, এছাড়াও কলেজের বয়স, আয়তন, সম্পত্তি, শিক্ষক সংখ্যা, ছাত্রছাত্রী সংখ্যা, নারী শিক্ষার্থীর অনুপাত, উপকৃত জনগোষ্ঠী, কলেজটি থেকে অন্য সরকারী কলেজের দূরত্ব ইত্যাদি দিকে লক্ষ্য রেখেই জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
বেশকিছু পত্র-পত্রিকায় আমরা দেখেছি যে প্রথমদিকে নীতিমালা মেনে বেশ কিছু স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ করা হলেও পরবর্তীতে অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। অসংখ্য নামসর্বস্ব ও অযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে জাতীয়করণ করা হয়েছে নীতিমালা না মেনেই। শিক্ষক ও তাদের যোগ্যতা, শিক্ষার পরিবেশ, শিক্ষার্থীর সংখ্যা ও ফলাফলকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রভাবশালী অসাধু সিন্ডিকেট ও কর্মকর্তাদের অবৈধ লেনদেনের জোরে ঐতিহ্যবাহী নামী কলেজকে বাদ দিয়ে অযোগ্য, মানহীন, বিতর্কিত কলেজকে জাতীয়করণ করা হয়েছে।
ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলা সদরে প্রধান সড়কের পাশে অবস্থিত ফুলবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজ ১৯৭২ সনে প্রতিষ্ঠিত । এলাকার স্থানীয়দের বক্তব্য অনুযায়ী এ কলেজটি এলাকার প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ হিসাবে উচ্চ শিক্ষা বিস্তারে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রায় পাঁচ হাজার ছাত্র ছাত্রীর শিক্ষাদানের জন্য কলেজে সাতটি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু রয়েছে। এই কলেজটি জাতীয়করণের লক্ষে ২০১৫ সনে কলেজটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিদর্শন করা হয় অথচ জাতীয়করণের প্রকাশিত তালিকায় ফুলবাড়িয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের জায়গায় নন এমপিও ভুক্ত উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের ৩০০ শিক্ষার্থীর বেগম ফজিলাতুননেসা মুজিব মহিলা কলেজকে জাতীয়করণ করা হয়। তাই অনিয়মের অভিযোগ এনে আন্দোলনে নেমেছে ঐ কলেজের শিক্ষক-কর্মচারী, শিক্ষার্থীরা এবং এলাকাবাসী। এই কলেজটি জাতীয়করণের দাবিতে প্রায় ৪৩ দিন ধরে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করে আসছিল ফুলবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। প্রতিদিনই কলেজে এ দাবিতে মিছিল-সমাবেশ হচ্ছে। চলছে অবরোধ কর্মসূচি।
আন্দোলনকারীরা কিছুদিন আগে ঢাকা প্রেস ক্লাবের সামনেও মানব বন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছেও স্মারকলিপি দিয়েছেন তারা। কিন্তু দাবি আদায় না হওয়ায় এবং সরকারের পক্ষ থেকে কোনও প্রতিশ্রুতি না পাওয়ায় আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। রবিবার দুপুরের দিকে আন্দোলনরত ঐ কলেজের শিক্ষক-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া ও বেধড়ক লাঠিচার্জের এক পর্যায়ে উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আবুল কালাম আজাদ নিহত হয়েছেন, এই ঘটনা নিঃসন্দেহে একটি মর্মান্তিক ও বর্বরোচিত ঘটনা।

একটি জাতির, সভ্যতার প্রধান মাপকাঠি শিক্ষা, একটি দেশ ও জাতীর মান বহুলাংশে নির্ভর করে শিক্ষার মানের উপর। শিক্ষকের যোগ্যতা ও গুণাবলীর উপর শিক্ষার মান সম্পূর্ণই নির্ভরশীল। পৃথিবীতে এমন কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাবে না যে শিক্ষকদের অবদান অস্বীকার করে। কিন্তু জাতিগত আর নীতিগত ভাবে আমরা আজ কোন তলানিতে এসে পৌঁছে গেছি যে শিক্ষকের ওপর হামলা, শিক্ষককে লাঞ্ছিত করা, শিক্ষককে হত্যা এ সব ঘটনা এখন অনেকটা স্বাভাবিক আমাদের কাছে, এবং আমরা সবাই নির্বিকার।
আমার প্রশ্ন সমগ্র জাতির কাছে “একজন শিক্ষক হত্যার দায় কিভাবে এড়ানো সম্ভব তাও সেই শিক্ষক যদি তার ছাত্রদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে রাজপথে নেমে থাকে ?” এই দেশে এখন নীতিবান শিক্ষকের বড়ই অভাব, আমাদের আজকের শিক্ষকেরা ছাত্রদের ন্যায়সঙ্গত কোন দাবীর নিয়ে আন্দোলন তো করেনই না বরং রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লড়াইতে ছাত্রদের ব্যাবহার করেন। বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলে রাজনীতির দাবা খেলা এবং শিক্ষকেরা নিজেদের জ্ঞান বুদ্ধির বদলে রাজনীতিবিদের আঙ্গুল দ্বারা পরিচালিত হন। এরকম একটা সময়ে ফুলবাড়িয়া ডিগ্রী কলেজের শিক্ষক আবুল কালাম আজাদের মত শিক্ষকদের বড্ড প্রয়োজন ছিল আমাদের। কিন্তু আমরা সবাই এতটাই নির্লিপ্ত যে ন্যায়সঙ্গত অধিকার লড়াই এবং একজন শিক্ষকের অত্যন্ত অবমাননাকর মৃত্যুও আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। আজ জাতির গায়ে যে কালিমা লেগেছে তা কি আদৌ মোছা সম্ভব !
আমরা ক্ষমা প্রার্থী জনাব আবুল কালাম আজাদ স্যার, আপনি ভুল যুগে জন্মেছিলেন, ভুল পেশায় নিজেকে নিঃশেষ করেছেন, ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের যুগ এটা নয়, আপনার বোঝা উচিত ছিল যে আপনি যে অধিকার আদায়ে ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তার পরিণাম মৃত্যু, তাইত আপনাকে অকালেই চলে যেতে হলো।
এই জাতির শিক্ষার কোন প্রয়োজন নাই, আপনাদের মত কোন শিক্ষকের হাতে গড়া কোন ছাত্রের লাঠিপেটা ও লাথি খেয়ে আপনাকে চলে যেতে হয়েছে এই পৃথিবী ছেড়ে। আপনি মনে রাখবেন আপনার মত শিক্ষকদের এমন করুণ মৃত্যুতে জাতির কিছু এসে যায় না, তাদের হৃদয় ক্লাসিকাল গানের মূর্ছনায় আর আনন্দে উদ্বেলিত।