শারমিন জান্নাত ভুট্টো: আমরা কি ২০১৬ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশের যুগে আছি, নাকি স্বাধীনতা পূর্ব আমলে আছি, ঠিক ঠাহর করতে পারছি না। আমার এখানে কোনো ভুল হলে প্লিজ কেউ ভুলটি ভাঙাবেন। এ সময়েও এসে কোনো শিক্ষক যদি তার ছাত্রদের সাথে আন্দোলন ও অধিকার আদায় করতে গিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বুটের লাথি আর লাঠির আঘাতে মারা যান, তবে কী আমরা ভেবে নিতে বাধ্য হবো না যে এই দেশটি হয়তো কাগজে-কলমে তার নাম পাল্টেছে, কিন্তু স্বভাবগত আর চরিত্রগত দিক দিয়ে এখনও স্বাধীনতা পূর্ব শাসক ও শাসনব্যবস্থা অনুসরণ করে যাচ্ছে!

কথাগুলো বলছি কারণ ২০১৬ সালে শিক্ষক মারা যাওয়ার ঘটনার সাথে ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহার শহীদ হওয়ার ঘটনাটির সাথে অনেকটা মিল দেখে।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় অন্যান্যদের মতো আন্দোলন গড়ে তোলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আর তাদের কর্মসূচীর ওপর ১৪৪ ধারা জারি করে বসে পাক-বাহিনী। ১৮ ফেব্রুয়ারী এই ধারা উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা তাদের মিছিল নিয়ে মেইন গেটের সামনের মহাসড়কে চলে যায়। খবর পেয়ে প্রক্টর ড. জোহা ছুটে যান মেইন গেইটে আর ছাত্রদের ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে থাকেন। এসময় পাক বাহিনীর ক্যাপ্টেন হাদী শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিলে ড. জোহা পাক বাহিনীর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘কোনো ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে আমার গায়ে যেন গুলি লাগে’। ডোন্ট ফায়ার! ডোন্ট ফায়ার! বলে চিৎকার করতে থাকেন ড.জোহা। শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে আনার আশ্বাস দেয়ার পরও পাক ক্যাপ্টেন ড. জোহাকে গুলি করেন। সেদিন এক শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে নিজের জীবনদান করেন। ৪৭ বছর পর আজ ঘটনার পুনরাবৃত্তি। শুধু পাল্টেছে স্থান, কাল আর আন্দোলনের বিষয়।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজ সরকারি করার দাবীতে গত বেশ কিছুদিন যাবত সেখানে আন্দোলন করে যাচ্ছিল ছাত্র-শিক্ষক সকলে। কর্মসূচী পালনের ৪৩তম দিনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা মিছিল বের করতে চাইলে তার ওপর আসে পুলিশী বাধা। একসময় তারা ফুলবাড়িয়া-ময়মনসিংহ সড়কে ব্যারিকেড দিতে চাইলে পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মাঝে ধাওয়া আর পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। আর তখনই পুলিশ শুরু করে তাদের ঐতিহ্যবাহী লাঠিচার্জ। বেধড়ক লাঠির আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবুল কালাম। আর সেই সাথে নিহত হন একজন পথচারী ছফর আলী।
আমরা আসলে কোন যুগে আছি যেখানে অধিকার আদায়ে কেউ সচেষ্ট হলেই তাকে হত্যা করা হয় নির্বিচারে। আর কাদের নির্দেশেই ঘটে এহেন ঘটনা? যদিও প্রত্যকটি ঘটনার পরই একে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়েই তাদের দায়িত্বভার শেষ করেন। আর আমরা অবুঝ জনগণ তা দেখেই খুশী মনে ঘুমিয়ে পড়ি। বাজারে মরিচের ঝাল কিংবা পেঁয়াজের ঝাঁঝ বাড়লে কিন্তু ঠিকই আমরা গলা উঁচু করি, কিন্তু মানুষ মরলে আমাদের সেই উঁচু গলা থেকে একটা শব্দও বের হয় না, আফসোস।
শিক্ষকরা তৈরি করেন জাতির মেরুদণ্ড। আর আমরা কিনা তাদের মেরুদণ্ডই ভেঙ্গে ফেলি বুটের আঘাতে। আমরা কেমন জাতি যারা এ ঘটনার পরও নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকি। কবে ভাঙবে আমাদের অসীম এই নীরবতা। কবে আবার আমরা একটু গর্জে উঠবো আর চিৎকার করে বলবো, বন্ধ করো এইসব অসুরের খেলা। আমাদের এই চুপ করে থাকা কিন্তু বৈধতা দেয় রাষ্ট্রের প্রতিটি অমানবিক কাণ্ডে।
আজ আপনি রাষ্ট্রের এমন কাণ্ডে চুপ থেকে বাসায় বসে টিভি দেখছেন আর আফসোসের ঢেকুর তুলছেন, কাল যখন আপনার সাথে একই ধরনের পরিস্থিতে আপনি পড়বেন তখন পেছন ফেরে কাউকে না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশী থাকবে। রাষ্ট্র নাগরিকদের এমন নির্লিপ্ততাই শুধু সাহসই পায় না বরঞ্চ ঘটায় পুনরাবৃত্তি। কোন শিক্ষক যখন অপরাধ করেন তখন আমরা গর্জে উঠি। সেই একইভাবে কোন শিক্ষক যখন বিনা অপরাধে মৃত্যুবরণ করে তখন আমরা চুপ থাকি। ধোঁয়াশা প্রতিবিম্ব আমাদের। আমাদের সমাজ আর রাষ্ট্রকে অপরাধী বানিয়ে তুলছি আমরা নিজেরাই।
শহীদ ড. শামসুজ্জোহা হানাদারদের হাতে নিহত প্রথম বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবী। আর অধ্যাপক আবুল কালাম হলেন ডিজিটাল বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত প্রথম শিক্ষক। ড. জোহা ছিলেন রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আর আবুল কালাম উদ্ভিদ বিজ্ঞানের। ড.জোহার মৃত্যুর ফলেই তৎকালীন আইয়ুব সরকার বিরোধী আন্দোলন চরম আকার ধারণ করেছিল, আর ধীরে ধীরে জন্মের দিকে ধাবিত হয়েছিলো বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি। তবে পার্থক্যের জায়গা মূলত এখানেই। ৬৯ সালে গর্জে ওঠা দেখলেও, ২০১৬ তে আমরা কাউকে ফোঁস করতেও দেখি না। যে যার আপন জায়গায় নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, অন্য কারো দিকে মুখে তুলে তাকাবার যেন সময় নেই কারো।
বলা হয়ে থাকে, মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। রাষ্ট্রের এহেন কর্মকাণ্ডে আপনি যখন মৌনতা প্রদর্শন করেন তখন প্রতিটি অমানবিক কর্মকাণ্ডে সমান অপরাধী আপনি নিজেও।