ভিকারুন কলি: জাতিসংঘের কনভেনশন অন দ্যা রাইট অফ দ্যা চাইল্ড এ্যাক্ট (Convention on the right of the Child act) অনুযায়ী পৃথিবীর সব বাচ্চারাই আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত শিশু। আমার কন্যার বয়স ষোল। সে হিসেবে আমি বলতে পারি রোদেলা আমার কিশোরী শিশু কন্যা। পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশের শিশু কন্যা সে। তার আনন্দিত কৈশোরকাল আমাকে মুগ্ধ করে। স্কুলে যাবার সময় চোরা মেকাপ দেয়। ঠোটে হালকা লিপষ্টিক মাখে, আইলাইনার দেয়, মাস্কারা দেয় চোখের পাতায়।
সবকিছুই করে লুকিয়ে, কারণ তার মায়ের কাছ থেকে তার মেকাপ করার অনুমতি নাই। স্কুল থেকে এসে ডালের সাথে শুকনা মরিচ ভাজা আর লেবু দিয়ে কচলে মুখে তুলে ভাত খাইয়ে দেয়ার বায়না করে। মুখে লোকমা তুলে দিলে গপ করে গিলে ফেলে, চোখ থাকে মোবাইলে। রাতে ভূতের ছবি দেখে মাঝরাতে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বিছানার এক কোনায় জড়োসরো হয়ে ঝুলে থাকে।
সারাদিন বন্ধুদের সাথে ফোনে গল্প, হাসাহাসি। সুযোগ পেলেই বাবার কাছে বাইরের খাবারের দোকানে খেতে যাওয়ার বায়না তো আছেই। সবকিছুতেই প্রশ্রয়,মার কাছ থেকে-বাবার কাছ থেকে, শিক্ষকের কাছ থেকে।
আমার সারা বাড়ি আনন্দে নেচে উঠে ওর হাসির দমকে। বন্ধুদের সাথে ওর কথার ফুলঝুরি আমি কানপেতে শুনি আর মুগ্ধ হই। আমি দু-চোখ ভরে দেখি তার আনন্দময় জীবন। একজন কিশোরীর জীবন তো এমনই হওয়ার কথা। শুধু আমার কন্যা নয়-সারা বিশ্বে সব কন্যাদের জীবন তো এরকমই হওয়ার কথা। মা-বাবার ভালবাসা, বন্ধু, স্কুল, আশেপাশের সবকিছুই কেমন প্রশ্রয় নেয়া দৃষ্টিতেই ওদের আল্হাদিপনা দেখেবে। সমস্ত পৃথিবীর ভালোবাসা, মমতা, নিয়েই এ সমাজে বড় হবে ওরা। কন্যা শিশুটির খিলখিল হাসিতে ঝলমল করে উঠবে সোনালী রোদ, গাছের সবুজ পাতায় ঝিরি ঝিরি কাঁপন লাগবে, বিলের পানিতে ঢেউয়েরা থমকে যাবে।
কিশোরী মিষ্টি মুখে লুকোচুরি করবে দুষ্ট হাসি। বিশেষ করে মেয়েদের কিশোরী বয়সটাই তো স্বপ্ন দেখার, স্বপ্ন লালন করার সময়। এ সময় স্বপ্ন, আহ্লাদ, ন্যাকামো, হৈ-চৈ ভরা জীবনই তো হবে একজন কিশোরীর। জীবনের সব জটিলতা, ভয়াবহতা, নোংরামি থেকে আমরাই তো আগলে রাখবো আমাদের শিশুদের।
বাংলাদেশের কিশোরীদের জীবন আর উন্নত বিশ্বের কিশোরীদের জীবন এক নয় হয়তো। বিশেষ করে গ্রামের কিশোরীদের জীবনে আষ্টে-পৃষ্টে লেগে আছে ক্ষুধা, দারিদ্র্য,অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা। কিন্তু তাই বলে তাদের তো আর পৃথিবীর অন্য শিশুদের থেকে আলাদাভাবে বিবেচনা করবো না। অন্তত রাষ্ট্রীয়ভাবে চেষ্টা করবো একজন শিশু হিসেবে তার অধিকার রক্ষা করতে।
একজন শিশুর সাথে যৌন সম্পর্ক স্হাপন উন্নত দেশগুলোতে অপরাধ। সেখানে আমাদের রাষ্ট্র কিভাবে বৈধতা দিচ্ছে আঠারো বছরের নীচে বিয়ের? আমরা কি তবে সেই আগের যুগে ফিরে যাচ্ছি? নাকি দরিদ্র বলে, সমাজে অবহেলিত বলে আমাদের দেশের কিশোরী কন্যা শিশুদের সাথে যা ইচ্ছা তাই হবে? শিশুর সাথে যৌন সঙ্গম তো ধর্ষণই বলা যায়। যেখানে রাষ্ট্রই মানবিকতার বিরুদ্ধে কথা বলে, সাধারণ মানুষের আর অপরাধ কোথায়।
চোখ বুঁজে কল্পনা করতে চেষ্টা করলাম আমার কন্যা শিশুর মুখটি কোন বয়ষ্ক (adult) পুরুষ মানুষের বিছানায়। কোনো এক পুরুষ বিয়ের কাবিনের বিনিময়ে আমার শিশু কন্যার শরীর খুবলে খাচ্ছে –আমি এতোটুকু আর কল্পনাও করতে পারলাম না। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল, আমার সমস্ত শরীর ভয়ে কুঁকড়ে উঠলো, গলায় বমির মতো কিছু আটকে গেল, আমি চিৎকার করে উঠলাম প্রচণ্ড ঘৃণায়,এবং যন্ত্রণায়। একজন কিশোরী শিশুর মা হিসেবে এ ছবি কল্পনা করা আমার জন্য অসম্ভব। তখন অন্য মায়ের শিশু কন্যাকে ধর্ষণ করার আইনী বৈধতা আমাকে পীড়া দেবে এটাই স্বাভাবিক।
রাষ্ট্র যখন ধর্ষণের সার্টিফিকেট দেয়, তখন আমরা কন্যার মায়েরা শুধু সেই শিশু কন্যার আর্তচিৎকার শুনতে পাই। অসহায় চোখে প্রতিবাদ করার ভাষাও হারিয়ে ফেলি।