আয়েশা শিউলী: মন ভালো না। ভারাক্রান্ত হয়ে লিখছি, নিতান্তই ব্যাক্তিগত দায়বদ্ধতা থেকে লিখছি………
সময়টা এমন, যখন আমরা একটি কমলা পৃথিবীর খোঁজে মগ্ন! যখন আমরা আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ পালন করছি, আজকে সারা বিশ্ব এই চোখ ধাঁধানো ‘কমলা’ রঙটিকে বেছে নিয়েছে, কারণ যে বার্তা আমরা ছড়িয়ে দিচ্ছি, দিতে চাচ্ছি তা যাতে জোড়ালো হয়, সরব হয়, স্বচ্ছ হয় এবং সহজেই প্রতীয়মান হয়।
‘কমলা’ হচ্ছে একটি আশা, একটি স্বপ্ন- স্বপ্ন নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি ন্যায়বিচারের, কমলা এখানে একটি শান্তিপূর্ণ, স্থায়িত্বশীল উন্নত সমাজ ও দেশের প্রতীক। আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ! প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, নারীর প্রতি যে কোন মূল্যে সকল প্রকার সহিংসতা বন্ধ করতে, যৌন নিপীড়ন উত্ত্যক্তকরণ প্রতিরোধ করে একটি অসাম্প্রদায়িক মানবিক নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে আমরা উদ্বুদ্ধ! আমরা কাজ করছি সকল বৈষম্য দূর করতে, সিডও সনদ হতে সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে পূর্ণ অনুমোদন আনতে ব্যস্ত আমরা!
নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষের এই সময়টা বেশ ভালো লাগে। ২৫শে নভেম্বর হতে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সময়টা মনে হয় একটা উৎসবের মতো, যখন আমরা বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেই নারীর প্রতি সকল প্রকার সহিংসতা প্রতিরোধের, শপথ নেই যার যার জায়গা থেকে যতোটুকু সম্ভব নারী নির্যাতন নিপীড়নকে রুখে দেয়ার। পক্ষের শেষটা হয় বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে মানবতার ডাক দিয়ে!
স্বপ্ন দেখছি একটি ‘কমলা পৃথিবী’র, যেই পৃথিবী কমলা রঙের মতোই শক্তিশালী হবে, সোচ্চার হবে সকল প্রকার সহিংসতার বিরুদ্ধে, যেখানে কোনো সহিংসতা থাকবে না। নারীরা ন্যায্য অধিকার পাবে, তাদের গৃহশ্রম স্বীকৃত হবে, অর্থনীতিতে তাদের অবদান স্বীকৃতি পাবে।
স্বপ্ন দেখছি এমন সময়ের, যখন সারাদিন ঘরে কাজ করার পরেও সেই নারী সম্পর্কে তার স্বামী বলবে না, “আমার বউ কোনো কাজ করে না, সে ঘরে থাকে”!! আমরা ভাবছি, আমাদের কন্যা শিশুরা স্কুলে যাবে, তাদের জীবনের লক্ষ্য থাকবে, সেই লক্ষ্য পূরণে তারা দৃঢ়চিত্তে এগিয়ে যাবে।
ঠিক সেই রকম একটা সময়ে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৬’র যে খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে, বিয়ের বয়স ১৮ বছর ঠিক রেখে তাতে বিশেষ ক্ষেত্রে বিয়ের প্রসঙ্গটি ১৯ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে এবং বিশেষ ক্ষেত্রে ১৮ এর নিচে কত বছর বয়সে বিয়ে হতে পারে, তা সুনির্দ্দিষ্ট করে বলা হয়নি। আসলে এই বিশেষ ধারা আমাদেরকে কোন বিশেষ দিকে নিয়ে যাবে তা আর ভাবতে পারছি না। প্রকৃতপক্ষে ভাবতে চাচ্ছি না।

এখন তো কোনো বিশেষ ধারা ছাড়াই বাল্যবিয়ে রোধ করা কঠিন হচ্ছে, আর বিশেষ ধারা জারি হলে সেটার অপব্যবহার ঠেকানো দুরূহ হয়ে পড়বে। জানি না কেন আমরা দূর-দৃষ্টিসম্পন্ন হচ্ছি না, আমরা আজকে যে নারী ক্ষমতায়নের কথা বলছি, কন্যাশিশুর শিক্ষার কথা বলছি, তার সাথে সাংঘর্ষিক হবে এই আইন, এই ধারা যদি চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়েও বলবৎ থাকে তবে সত্যিই তা ভয়াবহ রূপ নেবে, তখন পুলিশ প্রশাসন নিয়ে বাড়িতে গিয়ে বাল্যবিয়ে রোধ আর সহজ হবে না। বিষয়টি পুর্নবিবেচনা করে প্রত্যাহারের জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি!
একজন উন্নয়ন কর্মী হিসেবে আমার যে পর্যবেক্ষণ, কাজ করতে গিয়ে যে শিক্ষা হয়েছে তাতে দেখেছি নারী নির্যাতন বা সহিংসতা, নারীদের পিছিয়ে পড়া, মাতৃমৃত্যু, শিশু মৃত্যুর হার বৃদ্ধি, সব কিছুর পেছনে রয়েছে এই বাল্যবিয়ের কালো হাত। একজন শিশু বা কিশোরীর স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়ার জন্য বাল্যবিয়ের মতো একটি ভয়ংকর সিদ্ধান্তই যথেষ্ট।
কাজের অভিজ্ঞতা থেকে যেটা দেখেছি, বাল্য বিয়েটাকে যদি প্রতিরোধ করা যায় তাহলে নারী ও কন্যা শিশুর জীবনের বিভিন্ন সমস্যা অনেকাংশেই কমবে। সমূলে উৎপাটিত হবে না, কিন্তু সুনির্দ্দিষ্টভাবে কমবে অনেকখানি।
যেই পিতৃতান্ত্রিকতায় ঠাসা একটি সমাজে আমরা বাস করছি, সেখানে একটি কন্যশিশুর বিয়ে যেন ঠিক পুতুলের বিয়ের মতো, তাকে এ ঘর থেকে সে ঘরে নেয়া, তার কোলে আরো একটা, দুটো, তিনটা পুতুল তুলে দেয়া, তাকে যখন খুশি, যেভাবে খুশি সেইভাবে চালানো, তার পড়াশোনা বন্ধ করা থেকে শুরু করে যা যা তার সাথে ঘটানো হয় সবই অন্যের চিন্তা-ভাবনার, সিদ্ধান্তের প্রতিফলন! সেই কন্যাশিশু কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারে না নিজের ভালো মন্দের!
যেই সময়ে কন্যা শিশুর খেলাধূলা করার বয়স, দীঘিতে মনের সুখে সাঁতার কাটার বয়স, পুতুল খেলার বয়স সেই বয়সে বিয়ে দিলে জীবনের নিষ্ঠুর খেলার চাপে পিষ্ট হয় সেই কন্যাশিশু!
সাধারণ একজন উন্নয়নকর্মী আমি, যার সুযোগ হয়েছে জীবনকে কিছুটা কাছ থেকে দেখার, সুযোগ হয়েছে ছোট্ট ছোট্ট নিষ্পাপ কন্যা শিশুর সাথে গল্প করার, তাদের স্বপ্নকে নিজের চোখ দিয়ে দেখার, অনুভব করার, সেই আমি আজকে সত্যিই খুবই হতাশাগ্রস্ত।
জানি অনেক কথা আছে, আমাদের সমাজে নিরাপত্তাহীনতা আছে, বাল্য প্রেম আছে, আমাদের বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে নিয়ে চিন্তিত তাই দ্রুত বিয়ে দিয়ে মুক্ত হতে চায়, কিন্তু এই বিয়েতে যে প্রকৃত অর্থে সত্যিকার অর্থে মুক্তি হয় না, এটা তাদেরকে কে বোঝাবে?
আমি বিশ্বাস করি, আমি জানি আমরাই পারি বোঝাতে, তাদের সচেতন করতে, সেই বোঝানোর কাজেই যখন আমরা ব্যস্ত, কাজীদের/ ইউনিয়ন পরিষদের ভুয়া সার্টিফিকেট দেয়ার বিরুদ্ধে যখন আমরা কাজ করছি, আমরা বাল্যবিয়ে মুক্ত গ্রাম করছি, কত পরিকল্পনা আমাদের! তখন এরকম সিদ্ধান্ত সত্যিই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত! দয়া করে আমাদের কন্যাশিশুদের পায়ে বেড়ী দিবেন না, তাদের জীবন চলার পথকে মসৃন করুন, তাদেরকে উড়তে দিন, কৈশোর উপভোগ করতে দিন, স্বাধীনভাবে বাঁচতে দিন, নিজেকে সমৃদ্ধ করতে দিন। আমি প্রতিজ্ঞা করে বলছি, সত্যিই আমি জানি, এমন একদিন আসবে যখন আমরা ওদের হাত ধরে আরও সমৃদ্ধ হবো!
একদিন আমরা সত্যিই ‘কমলা’ প্রতীকের মতই রঙ্গিন একটা দেশ গড়তে পারবো। আর সেই কমলা দেশের কমলা আভায় বিশ্বকে রাঙাবো।
লেখক: উন্নয়ন কর্মী