নারীর সৌন্দর্য চর্চা: একটি অশ্লীল প্রথা

তন্ময় কুমার হীরা: ধর্মের মতোই বাঙালির আর একটি অতি স্পর্শকাতর অনুভূতির নাম লিঙ্গানুভূতি। বাঙালি, সম্ভবত, পৃথিবীর সবচেয়ে রেসিস্ট জাতি। লিঙ্গভিত্তিক রেসিজমে বাঙালি সেরাদের সেরা। বাঙালি নারী কেবলই হতে চায় নারী, বাঙালি পুরুষ কেবলই হতে চায় পুরুষ, কিন্তু কখনোই মানুষ নয়। পুরুষ কিংবা নারী থেকে মানুষ হওয়ার জন্য জ্ঞানের যে সাধনা দরকার তা করে না বাঙালি। বাঙালি তাই আজও পৌঁছাতে পারেনি মনুষ্যত্বলোকে।

13140605_10207873053677096_23723652_nজ্ঞানের বিকাশ না ঘটলেও লিঙ্গানুভূতি বিকশিত হয়েছে বাঙলায় খুব। বাঙালির আবহমানকাল ধরে চলা অশ্লীল লিঙ্গানুভূতিতে আঘাত হানতে ফেসবুকে লিপস্টিক পরা এই ছবিটি। ছবিটি বাঙালি নারী ও পুরুষের স্ব স্ব লিঙ্গানুভূতিতে আঘাত হানতে যথেষ্ট হয়েছে বলেই মনে হয়েছে।

বাঙলায় নারী বলতে বোঝায় পুরুষের এক প্রকার খাদ্য, যে খাদ্যকে আকর্ষণীয় ও লোভনীয় করার জন্য ওই বস্তুটিকে সুন্দর করে সাজানো হয়। আলতা, স্নো, পাউডার, লিপস্টি্ক চুড়ি, শাঁখা, সিঁদুর- এসব নানা উপকরণে সাজিয়ে খাদক পুরুষের চোখে নারীকে আকর্ষণীয় রূপে উপস্থানের চেষ্টা করা হয়। বাঙলায় নারী ও পুরুষের সম্পর্ক খাদ্য ও খাদকের।

পুরুষ যেহেতু খাদ্য নয় তাই পুরুষকে সাজতে হয় না। কিন্তু আমার মতে, নারী ও পুরুষের সম্পর্ক খাদ্য খাদকের নয়, হতে পারেনা। নারী যদি পুরুষের খাদ্য হয়, তবে পুরুষ হবে নারীর খাদ্য। কেননা যৌন মিলনে নারী ও পুরুষ উভয়ের ভুমিকা সমান, অন্তত বিজ্ঞান সে কথাই বলে।

বাঙলায় আসলে যৌন মিলন হয় না, ধর্ষণ হয়। বুড়ো পুরুষগুলো একটা কচি সুন্দর আকর্ষণীয়, লোভনীয় মেয়ে বিয়ে করে। নারীটি থাকে শরীর ও মননে অপরিপক্ব। ওই অপরিপক্ব নারী দেহ আর পক্ক পুরুষ দেহের মধ্যে আদতে মিলন হয় না; পক্ক দ্বারা ধর্ষিত হয় অপক্ক। মনে পরছে হুমায়ূন আজাদের কথা। তিনি বলেছেন, ‘বংশ পরম্পরায় বাঙালির জন্ম হয়েছে পুরুষের ক্ষণিক উত্তেজনায়, অক্রিয় নারীদেহ ক্ষণিক পীড়নের ফলে’। অর্থাৎ বাঙলায় প্রেম ও কাম হয় না, ধর্ষণ হয়। আর বাঙালির জন্ম হয় ধর্ষণের ফলেই। নারীকে ধর্ষণের উপযোগী করতে, তাকে সাজানো হয় সুন্দর করে। পুরুষকে সাজানো হয় না, কেননা নারী পুরুষকে ধর্ষণ করেনা।

manলিপস্টিক পরা ছবিটি দেওয়ার পর কতিপয় নারী ও নর আমায় হিজড়া বলে গালি দিয়েছে। বাঙালির মনোজগতটি যে কি পরিমাণ নোংরা আর অশ্লীল তা ভয়াবহভাবে প্রমানিত হয় যখন দেখা যায় হিজড়াকেও তারা গালি হিসেবে ব্যবহার করে, ধর্ষক কিংবা ইভ টিজারকে সে গালি হিসেবে ব্যবহার করে না। বাঙালির চোখে ধর্ষক খারাপ নয়, ইভ টিজার খারাপ নয়, নারী নির্যাতক খারাপ নয়; হিজড়া খারাপ। আহারে বাঙালি! বাঙালি জানে না নারী নির্যাতক পুরুষ হওয়ার চেয়ে হিজড়া হওয়া অনেক ভালো। বাঙালি জৈবিকতা ও পুরুষত্বকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়। তাই হতে চায় পুরুষ, মানুষ নয়। মনুষ্যত্ব ও মানবিকতার চর্চা বাঙালির দরকার হয় না।

বাঙালি নারী কেবলি হতে চায় নারী। তাই সে সাঁজতে চায় সুন্দর করে। মনুষ্যত্বের বাসনা সাধারণত বাঙালি নারীর জাগেনা। নারী তার ঠোঁটকে সুন্দর করে রাঙায়, কেননা পুরুষ ওটা খাবে, কিন্তু নারী পুরুষের ঠোঁটকে খাবেনা, কেননা নারীর চোখে পুরুষ খাদ্য নয়, খাদক।

পুরুষের ঠোঁট রাঙানোকে বরং সে নিন্দার চোখেই দেখে। নারী নিজেও নিজেকে স্রেফ যৌনবস্তু এবং পুরুষের খাদ্যব্যতীত আর কিছুই ভাবতে পারে না আজও। আমি ঠোঁটে লিপস্টিক পরেছিলাম, কেননা নারী পুরুষের খাদ্যবস্তু এটা আমি মানতে পারি না, নারী যদি পুরুষের খাদ্যবস্তু হয়, পুরুষ তবে নারীর খাদ্যবস্তু। লিপস্টিকে ঠোঁট রাঙিয়ে নিজেকে নারীর খাদ্য হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছি। বলতে চেয়েছি নারী পুরুষের খাদ্য হলে, পুরুষ নারীর খাদ্য। নারী আর পুরুষ সমান। আর ভাঙতে চেয়েছি অশ্লীল পুরুষতান্ত্রিক প্রথা। আঘাত করতে চেয়েছি নোংরা পুরুষ অনুভূতি, আর নোংরা নারী অনুভূতিতে। চেয়েছি নারীমুক্তি।

শেয়ার করুন: