জয় নারীর ক্ষমতায়ন, জয় বাল্যবিবাহ আইন!

বিথী হক: রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তীতে প্রথম গৌরীদানের বিষয়ে ধারণা পেয়েছিলাম। পরে বইপত্র- ইন্টারনেট ঘেঁটে একটু-আধটু পড়াশোনা করে আরো কিছু জেনেছি।  আট বছর বয়সে আমি উরু দেখা যায় এমন খাটো প্যান্ট পরে ছেলে সেজে অভিনয় করেছিলাম, সেই আট বছর বয়সে নাকি মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হয় এবং এটাকে অলংকৃত করতে হিন্দুধর্মে বলা হয় ‘গৌরীদান’। চিন্তা করে খারাপ লাগছিল।

তক্ষুণি মানুর দিকে চোখ পড়লো, মেয়েটা আজকাল খুব ফোলা-ফোলা চেহারায় ক্লাসে আসে। বাচ্চাটা নাকি সারারাত কাঁদে!

তখন ছয় বছর আগে আমার যে বয়স ছিল, মানুরও নিশ্চয়ই সে বয়স ছিল! অথচ আমি হাফ প্যান্ট পরে ছেলে সেজে মঞ্চে দাঁড়িয়ে যখন পাকা পাকা কথা বলছিলাম, তখন মানু হেঁসেল ঠেলছিল। তারপর কয়েক বছরের মধ্যেই মানু বাচ্চা নিয়ে লটপট করতে করতে খাঁটি কলম্বো নারকেল তেল মাথায় দিয়ে ডানপাশে সিঁথি কেটে চুল না বেঁধে আধমাথা এলোমেলো চুল নিয়ে ক্লাসে আসতে লাগলো। চোখ লাল হয়ে ফুলে থাকতো, গালে রুক্ষ একটা ভাব, গলায় হাঁসফাঁস নিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একদিন স্কুলে আসা বন্ধ করে দিল।

স্কুলে পড়ার সময় আনু নামে আরেক বন্ধু ছিল আমার। ক্লাস ফাইভে ওঠার সময় তার বিয়ে হয়ে গেল। আমি যখন কলেজে উঠলাম তখন আনু ওর পাঁচ বছরের বাচ্চার পাশে দাঁড়িয়ে লজ্জায় লাল হয়ে কথা বলতে পারলো না।  আমাকে বললো, ‘পড়াশোনা তোমাদের জিনিস, আমাদের জন্য ঘর, সংসার আর বাচ্চা ছাড়া আর কিছু নেই’। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম।

bithy-8
বিথী হক

গতবছর আরেক বন্ধুকে দেখলাম পাঁচ বছর আর তিন বছরের দু’টো বাচ্চা নিয়ে বেচারা শাশুড়ি গোছের কথা বলছে।

মজার ব্যাপার হলো, এদের যখন বিয়ে হলো তার আগের দিনও এসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে ‘কুড়িতে বুড়ি নয়, বিশের আগে বিয়ে নয়’ বলে গলা ফাটাতাম। উপবৃত্তির টাকা নিতে যাওয়ার সময় তিনটি শর্ত গলা খুলে বলতে পারতো সবাই। তখনও ১৮ এর নিচে মেয়েদের বিয়ে না করার আইন ছিল। তারপরেও কোনরকম গণ্ডগোল ছাড়াই ধুমধাম করে এলাকার চেয়ারম্যান-মেম্বারদের রসুনের ছিলকা রঙের পাঞ্জাবির উপস্থিতিতেই বিয়ে হয়ে গেল। বাবা-মা, পাড়া-প্রতিবেশীরা গৌরীদানের সওয়াব হাসিল করলেন।

এই যখন হলো ১৮ এর নিচে বিয়ে না দেওয়া আইনের প্রয়োগ। তাহলে এখন কি আর ঘটা করে বলতে হবে ‘সর্বোত্তম স্বার্থ’ ট্যাগ লাইন দিয়ে মেয়েদের বিয়ের বয়সকে ১৮ এর নিচে নামিয়ে আনার বৈধকরণ ঘটলো কীনা! মাথায় মগজহীন আম-জনতা ছাড়া এমন সরল-সমীকরণ বুঝতে দু’বারও ভাবতে হয় না।

আমরা যখন চেঁচামেঁচি করছি, ইভটিজিং এর শিকার হলেই বিয়ে করতে হবে না। সেটা আসলেই কোন সমাধান নয়। বোঝাচ্ছি, স্বাবলম্বী না হয়ে বিয়ে নয়, নিজের পরিচয় তৈরি না করার আগে বিয়ে নয়, বিয়ের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত না হলে বিয়ে নয়; তখন এই ধরনের আইন একটি উন্নয়নশীল দেশকে নারীর ক্ষমতায়নের পথে কতটা গতিশীল করবে, সেটা কি আইন প্রনয়নকারীদের একবারও মাথায় আসেনি?

তাঁরা বলছেন, ‘প্রেগন্যান্ট হলে বা সামাজিক সমস্যার শিকার হলে তাৎক্ষণিকভাবে পরিবারের সম্মান রক্ষার জন্যই এই আইন দরকার!’

তা বেশ ভাল, তার মানে মেয়েকে কোনভাবে প্রেগন্যান্ট দেখাতে পারলেই বাবা-মা আইনকে বুকে জড়িয়ে ধরে ‘বাল্য বিবাহ আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সমাজের বোঝাকে(!) মাথা থেকে নামিয়ে ফেলবেন। সম্মানিত বিজ্ঞ আইনবিদদের তখন মেয়ে আদৌ প্রেগন্যান্ট হয়েছে কিনা সেটা প্রমাণ করবার কোন তরিকা বাকি থাকবে তা সবাই বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই।

stop-rape-3সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, অনেক মেয়ের পিরিয়ড ১০ বছর বয়সেও হয়। ভুল করে সে যদি একবার কনসিভ করেই ফেলে, তার মানেই কি সে বিয়ের উপযুক্ত? সেই বয়সে তার বাচ্চা কি জিনিস তা বুঝবার মতো যথেষ্ট জ্ঞান-বুদ্ধি তৈরি হয়? বা পেটে বাচ্চা আসলেই তার নিষ্পত্তি বিয়ের মাধ্যমে ঘটাতে হবে? একবার একটা ভুল হয়ে গেলে সেটা শোধরানোর কোন পথই খোলা রাখা যাবে না?

এবার আসি এই একটু  ‘সর্বোত্তম স্বার্থ’ জনসংখ্যা-বিজ্ঞানের উপর কী কী প্রভাব ফেলতে পারে। গত ১০ বছরে প্রায় পাঁচ কোটির মত জনসংখ্যা বেড়েছে। বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক সংস্থাগুলো থেকে লিফলেট, কর্মশালা ও ভিন্নধারার প্রচারণার মাধ্যমে অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়াকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, একটি বা দু’টি সন্তানের বেশি সন্তান গ্রহণ না করার বিষয়ে প্রচারণা চালানো হয়েছে। এতোকিছুর পরেও দেশের যৌনতাবিহীন বিনোদন-বিমুখ বিশাল রোমান্টিক জনগোষ্ঠী একটি, দু’টি, তিনটি, চারটি করে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে অস্তিত্ব পাকা-পোক্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

কেউ কি ভাবতে পারছেন, এতো কম আয়তনের দেশে আগামী ২০ বছর পরে কতগুলো মানুষের বসত-ভিটার প্রয়োজন হবে, কর্মসংস্থানের প্রয়োজন হবে, শিক্ষা-চিকিৎসার প্রয়োজন হবে? যাদের এসব বিষয় নিয়ে ভাববার কথা, তারাই যখন ফরয কাজ দ্রুত পালনের বিষয়ে তৎপর, তখন বাল্যবিবাহ আইনের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে বড় বড় বুলি আওড়ে আমি-আপনি কিইবা করতে পারি! আমাদের বলা-না বলায় কিছু এসে যায় না।

শুধু একটি কথাই বলি, আপনাদের এই ‘সর্বোত্তম স্বার্থ’ বিশ্লেষণী আইন যখন ছিল না, তখনো এ দেশে বাল্য বিবাহ যেকোনো বিষয়ের চেয়ে অনেক বেশি হারে বিদ্যমান ছিল। এখন যখন এইসব শর্ত-টর্ত দিয়ে আরো কম বয়সে বিয়ের ব্যবস্থা করছেন, এখনো স্কুল পাশ করেই মেয়ে বিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি কিছুমাত্র টলবে না। বৃহত্তর স্বার্থ বলে একটা কথা আছে জনাব। এসব স্বার্থ চিন্তা বাদ দিয়ে দেশের স্বার্থে, বৃহত্তর স্বার্থ নিয়ে ভাবলে আজকে এই আইন নিয়ে আলাদা করে কারো কিছু বলবার থাকতো না। নারীর ক্ষমতায়ন নিয়েও প্রতিদিন এতো এতো কিছু বলতে হতো না।

জয় নারীর ক্ষমতায়ন, জয় বাল্যবিবাহ আইন!

শেয়ার করুন: