প্রতিবাদে, প্রতিরোধেই নারীর মুক্তি

ফারহানা হাফিজ: ২৫ নভেম্বর থেকে শুরু হলো আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিবাদ পক্ষ। ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে এই পক্ষকাল। বিশ্বব্যাপী এই পক্ষ 16 days Activism নামেও পরিচিত।
আজকে এই প্রতিবাদ পক্ষের প্রেক্ষাপট নিয়ে বলতে চাইনা। বরং বলতে চাই প্রতিবাদটি শুধুমাত্র পক্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। নারীর সমঅধিকার প্রশ্নে, নারীর সমমর্যাদার লড়াইয়ে, নারীর প্রতি সকল বৈষম্য ও নির্যাতন বন্ধে প্রতিবাদ হতে হবে নিরন্তর, যতক্ষণ না কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জিত হয়।

farhana-hafiz
ফারহানা হাফিজ

যখন বলি নারী নির্যাতনের বিরূদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, চোখের সামনে সারা বিশ্বের নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া, চলমান বা যা ঘটতে পারে এমন হাজারো নির্যাতনের  চিত্র ভেসে আসে। যেই নির্যাতন যেমন আমার মায়ের উপর, সেই নির্যাতন আমার নিজের উপর, সেই নির্যাতন প্রায় ১১ বছর বয়সী আমার কন্যার উপর।
এবং এই নির্যাতনের বেশীর ভাগ খুব কাছের মানুষের মাধ্যমে। এবং কারণ সেই একই, নারী ও মেয়ে শিশুকে যেভাবেই হোক দমিয়ে রাখা, তার সম্মান ও মর্যাদার ক্ষেত্রটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, যেন সে আত্মবিশ্বাসের সাথে সামনে চলার পথটি তৈরি করতে না পারে। এবং একজন নারীকে এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয় খুব অল্প বয়স থেকেই।

সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের যমজ কন্যার একজনকে ভয়াবহ একটি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। যেহেতু কী হয়েছে, কে করেছে তা বলার থেকে, প্রতিবাদটি কেন জরুরি বলাটা মুখ্য, তাই ঘটনাটি বিস্তারিত না বলে সংক্ষেপে বর্ণনা করবো।

আমাদের কন্যারা যে স্কুলে পড়ে, সেখানে তাদেরই এক বন্ধু আমার এক কন্যাকে আরেক বন্ধুর সাথে জড়িয়ে খুবই বাজে একটি রিউমার প্রচার করেছে। এর কারণ হিসেবে ছেলেটি জানিয়েছে, বহু বছর আগে আমার কন্যা ও তার মধ্যে কোনো একটি বিষয়ে বাকবিতণ্ডা হয়েছিল এবং সাম্প্রতিক সময়ে ক্লাশে তার কোনো একটি আচরণে আমার মেয়ে প্রতিবাদ করায় সে প্রতিশোধ নেবার মানসিকতা থেকে এটি করেছে।  
আমরা আমাদের মেয়েদেরকে শৈশব থেকে শিখিয়েছি যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। আমাদের মেয়েটি যখন স্কুলে রিউমার সম্পর্কে জানতে পারে, সাথে সাথেই সেকশন ইনচার্জকে কমপ্লেইন করে। প্রথমে ছেলেটি অস্বীকার করলেও, পরে স্বীকার করে ক্ষমা চায়।

এখানে দুটি বিষয় বোঝা জরুরি, আমাদের সমাজের নারীর প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি তা একটি ১০-১১ বছরের ছেলে শিশুকেও শেখায়; ১) যেকোনো অবস্থায়, যেকোনো বয়সে, যেকোনো সম্পর্কের নারী ও মেয়েশিশুকে দমানোর চূড়ান্ত অস্ত্র তার চরিত্রের দিকে আঙুল তোলা, ২) আমি পুরুষ, আমি ছেলে, আমার রাগ প্রকাশের ভাষা, প্রতিশোধ।

কেন এই ঘটনাটি বলছি? কারণ আমার বাচ্চা মেয়েটির সাথে যা হয়েছে, তা অন্যায়। আমার মেয়েটি যে ট্রমার মধ্য দিয়ে সময় পার করেছে, তার কারণ সে তার কাছের বন্ধুর কাছে থেকে এই আঘাতটি পেয়েছে, যেখানে তার বন্ধুর প্রতি আস্থা, বিশ্বাসটি সে আর রাখতে পারছে না। সেদিন আমাদের মেয়েটি যদি সাহস করে স্কুলে প্রতিবাদটি না করতো, তাহলে আরো কঠিন, ভয়াবহ সব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন তাকে হতে হতো স্কুলে।  

stop-violenceবিষয়টি কি এখানেই শেষ করে দেব? এই পরিস্থিতিতে প্রতিবাদটি কি শুধু আমার মেয়ের দিক থেকেই? অভিভাবক হিসেবে কি আমরা কিছু করবো না? কিছু কি করার আছে? অবশ্যই অনেক কিছু করার আছে। এবং আমাদের মেয়েদের প্রতি যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোন আপোস বা ছাড় নেই। আমরা ছেলেটির বাবা-মাকে একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছি যে, যা হয়েছে এটাকে কোনো শিশুসুলভ আচরণ বলা যায় না, কারণ পুরো বিষয়টি খুব পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে এবং এই ধরনের মানসিকতা বা আচরণ যখন এই বয়সী ছেলের মাঝে চলে এসেছে, তখন ছেলের অভিভাবক হিসেবে তাদের ছেলের জন্য এখন থেকেই কাউন্সেলিং ব্যবস্থা করা দরকার। স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছেও বার্তাটি নিয়ে গেছি যেন স্কুল এই ধরনের ঘটনায় ছেলে ও তার অভিভাবকদের সাথে কাজ করে।

এই যে প্রতিবাদ করা, তার উদ্দেশ্য আমরা আমাদের চারপাশে এমন মানবিক পুরুষ দেখতে চাই, যারা নারীর সমমর্যাদার প্রতি সমানুভূতিশীল। আমরা এমন অভিভাবক দেখতে চাই, যারা তাদের ছেলে সন্তানদের নারীর প্রতি সমমর্যাদার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে দায়িত্বশীল, আমরা এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেখতে চাই, যেখানে ছেলে মেয়ের মধ্যে বিভেদের দেয়ালের পরিবর্তে সমতাকে অগ্রাধিকার দেয়।

পথটি অনেক দীর্ঘ, তাই প্রতিবাদটি নিরন্তর করতে হবে। কারণ ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র নারীর সমঅধিকারের, সমমর্যাদার বিষয়ে কানে অধিকাংশ সময় একটি তালা ঝুলিয়ে রাখে। তাই ফিসফিস করে, চুপে চুপে বললে চলবে না। এই তালাকে টলাতে হলে প্রতিবাদটি জোরালো তো বটেই, প্রকাশ্যভাবেই করতে হবে।
একটি প্রতিবাদ নয়, চাই অগনিত প্রতিবাদ। একটি প্রতিবাদ পক্ষে নয়, প্রতিদিনের প্রতিবাদের পথেই মিলবে সমতা, মর্যাদা ও মুক্তি।

শেয়ার করুন: