একচুলও ছাড় দেয়নি কেউ-১

শান্তা মারিয়া: কাপড় থেকে জল নিংড়ে নেওয়ার মতো সংসার আমার কাছ থেকে নিয়েছে শ্রম, মেধা, অর্থ, সময়, সৌন্দর্য সবকিছু। একচুল ছাড় দেয়নি কখনও। একবিন্দু মমতাও হয়নি কারও। উপার্জনের শেষ কড়িটা পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছে। কারা কেড়ে নিয়েছে?

না, চোর ডাকাতে নয়। কেড়ে নিয়েছে অতি আপনজন বলে যাদের পরিচিতি রয়েছে সমাজে, পরিবারে। খাটতে খাটতে মাথার ঘাম পায়ে পড়েছে, পায়ের রক্ত মাথায় উঠেছে। তবু খাটুনির বিরাম হয়নি। নিজের জন্য এক তিল সময়ও পাওয়া যায়নি। ছাড় দিয়েছি আমি। ক্রমাগত ছাড় দিয়েছি, সবার আবদার মিটিয়েছি, নিজেকে নিঃশেষ করে সবাইকে খুশি করার চেষ্টা করেছি।

কারণ ছোটবেলা থেকেই আমাকে শেখানো হয়েছে সকলের সেবার জন্যই আমার জীবন। আমাকে শুনতে হবে বাবা মায়ের কথা, শুনতে হবে বড় ভাইয়ের কথা, শুনতে হবে স্বামীর কথা। আমাকে সবার প্রতিপালন করতে হবে। আর যখন ছেলে সন্তান হলো, তখন তো আর কোনো কথাই নেই। এখন আমার জীবনের চরম ও পরম পাওয়া হলো ছেলেকে লালন-পালন করা। ছেলের জন্যই মায়ের জীবন। আমার আবার আলাদা চাওয়া-পাওয়া আছে নাকি?

Shanta 2
শান্তা মারিয়া

এতো গেল ঘরের ভিতরের গল্প। ঘরের বাইরের গল্পও কি নেই? নিশ্চয়ই আছে। মনে রাখতে হবে আমি একজন কর্মজীবী নারী। কাজ করে খাই। তা যেখানে আমি কাজ করি সেই কর্মক্ষেত্রটা কেমন? সেটাও একটা কুরুক্ষেত্র, একটা নির্দয় রণভূমি। সেখানে কি আমাকে কেউ ছাড় দিয়েছে?

প্রশ্নই ওঠে না।

ছেলের জ্বর ছিল, রাত জাগতে হয়েছে, তার পরীক্ষা ছিল, উঠতে হয়েছে ভোর সকালে,  বাবা-মা অসুস্থ, হাসপাতালে ডিউটি দিতে হয়েছে, স্বামী বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে গভীর রাতে ফিরেছে, তার দরজা খোলার জন্য বসে থাকতে হয়েছে, নিজের শরীর অসুস্থ, কোমরে ব্যথা, ইউটেরাসে ব্যথা, সেসব কি অফিসে কেউ শুনবে?

বাড়িতে বুয়া নেই, সংসারের সব কাজ নিজে হাতে করতে হয়েছে, তাই সারা শরীরে ব্যথা, সেসব কেউ শুনবে? কোনো ছাড় দিবে সেজন্য?

বরং বলতে গেলে শুনিয়ে দিবে, ‘আপনারা মহিলা মানুষ, খালি সংসারের প্যাঁচাল পাড়েন।’

পুরুষ কর্মীরা সিগারেট খেয়ে, আড্ডা দিয়ে, সতের রকম ধান্দাবাজি করে সময় নষ্ট করলেও দোষ হয় না। কিন্তু আমি যদি একদিন আগে বাড়ি চলে যাই, তখনই মন্তব্য ছুঁড়ে দেওয়া হবে, ‘মেয়েরা তো সেজেগুজে আসে যায়, কাজ পারেও না, করেও না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি থাকলে কী হবে, মেয়েরা কোনো কাজ জানে নাকি? নাকি ওদের কোনো যোগ্যতা আছে?’

আমার কোনো ভুল যদি দৈবাৎ হয়, সেটার কি কোনো মাফ হবে কখনও? না। আমাকে সতর্ক থাকতে হবে সারাক্ষণ। পান থেকে চুন খসলেই সবচেয়ে আগে চাকরিটি খোয়াতে হবে আমাকেই। আমাকে তাই পদে পদে প্রমাণ করতে হবে নিজের যোগ্যতা। অন্যদের চেয়ে বাড়তি সময় থাকতে হবে, বাড়তি শ্রম দিতে হবে, কম বেতন নিতে হবে। তবে আমি কোনোমতে অফিসের মাটি কামড়ে টিকে থাকতে পারবো।

আমার আজকের যেটুকু অবস্থান সেখানে পৌঁছাতে কী কম সংগ্রাম করতে হয়েছে, কম যুদ্ধ চালাতে হয়েছে ঘরে-বাইরে? আমাকে কি এতোটুকু ছাড় দিয়েছে কেউ? কেউ না।

শুধু কি শ্রম? আরও আছে। সদা সতর্ক থাকতে হয় পাছে চরিত্রে দাগ লাগে। তবে যতই সতর্ক থাকি না কেন, যদি কখনও আমাকে দেখা যায় ছোটবেলার কোনো বন্ধুর সঙ্গেও কফিশপে, যদি কোনো পুরুষ কলিগের দিকে তাকিয়ে একটু হাসি, যদি কোনোদিন রাতে বাড়ি পৌঁছে দেয় কেউ, যদি একটু রাতে কারও ম্যাসেজ আসে, যদি আমার ফেইসবুকের ছবিতে ‘সুন্দর’ বলে কমেন্ট করে অনাত্মীয় কোনো পুরুষ, ব্যস আর দেখতে হবে না।

এখানেও একচুল ছাড় নেই। আমি হয়ে যাবো খারাপ চরিত্রের মেয়ে। আমার চাকরি থাকবে না। কারণ এখানে রাবণ, দুর্যোধন, কীচক যতোই থাকুক না কেন,  সতী-সাবিত্রী হতে হবে আমাকে। চাকরি তো যাবে। আবার চাকরি যাবার কারণটা যখন ঘরে পৌঁছাবে, তখন ঘরটাও যাবে চাকরির সাথে সহমরণে।

এই ফুল্লরার বারোমাসী আর কতো শুনবেন?

নারীর জীবন মানেই তো এক অন্তহীন রৌদ্রযাত্রা। সেখানে কোনো ছায়াবৃক্ষ নেই।

তবে এবার ঠিক করেছি আমিও কাউকে আর এক চুল ছাড় দেব না। আমার পছন্দমত খাবার খেয়ে, ঘুরে-বেড়িয়ে, গান শুনে, বই পড়ে, খুশিমতো সময় কাটিয়ে আমি আমার মতো বাঁচবো, মানুষের মতো বাঁচবো। আমার অধিকারের জায়গায় আর কোনো ছাড় নেই। সত্যিই নেই।

 

শেয়ার করুন: