বনবিবি, নাকি প্রধানমন্ত্রী, কার কাছে দুঃখ করবো?

মিথিলা মাহফুজ: আমি ‘ব্যাটাগিরি’ এখন আর নিতে পারি না। আগে যাও সয়ে নিতে পারতাম, গিলে ফেলতে পারতাম, এখন উপচে যাচ্ছে। বয়স কিনা কে জানে, এখন আর একেবারেই নিতে পারি না। যতদিন ধরে বেঁচে আছি, বাছতে বাছতে গা উজাড় হয়ে যাচ্ছে। কত ‘মহৎ’ পুরুষ যে আজ পর্যন্ত মানুষ হিসাবে আমার মতো ছোট মানুষের চোখে ছোট হলো, তাতে নিশ্চয়ই তাঁদের কিছুই যায় আসে না, কিন্তু আমার লজ্জা লাগে, ভয় হয়, এবং একা বোধ করি।

এতো কথা বলছি, কারণ অস্থির লাগছে। তো অস্থির সময়ে তো অস্থিরই লাগার কথা। কিন্তু এতোই বেশি অস্থির লাগছে যে, যা বহুদিন করি না, তাই করছি। ফেসবুকে নোট লিখছি।

India Rapeকতো ট্রমা পরতে পরতে নারী শরীরে জমে থাকে! কতো লজ্জা, আতঙ্ক, ঘৃণা, বিশ্বাসঘাতকতা, অপমান, বেরহমী সামলে শিশুকাল থেকে জীবন ব্যয় করতে হয়। এবং তারাই বেইমানি করে যাদের ছাড়া বাঁচা যায় না।

আমার এক বন্ধুর সাথে ঘটেছে – আপন বড় চাচা যে নয় বছর বয়স থেকে মেয়েটাকে রেগুলার যৌন হয়রানি করতো, সেই চাচাই মেয়েটার ১২ বছর হবার পর তার একা চলাফেরার উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। ও প্রায় দিশাহারা হয়ে গেছিল চাচার প্রথম অনাকাঙ্খিত স্পর্শে।

তার বাবা ছিলো না, চাচাই পিতৃসম ছিল। শরীর, মনের অত্যাচার অন্য ফর্মও নেয়। আমার আরেক বন্ধুর খালু ছোটবেলায় তার গায়ে হাত দিত। আবার একই সাথে মেয়েটার জন্য ভালো খেলনা, খাবার এবং বইপত্র কিনে আনতো। এমনিতে দেখলে মনে হবে মেয়েটাকে সে আসলে ভীষণ স্নেহ করে। এবং মেয়েটাকে সে একটা ভাল স্কুলে ভর্তি করাতেও সাহায্য করেছিল অনেক। আমার বন্ধুর খালা এই কারণে তার ভাগ্নিকে সহ্য করতে পারতো না। একটা ৭-৮ বছরের মেয়েকে সে তাই একা পেলেই অমানবিকভাবে পেটাতো এবং ও একটু বড় হবার পর থেকেই ওর নামে আজে-বাজে কথা বলে বেড়াতো। স্বামীকে কোনদিন সে উঁচু গলায় কিছু বলে নাই। দুই নারীর এই ট্রাজেডি খালার মৃত্যুতে শেষ হয়।

যাই হোক, এইসব গল্প লিখে শেষ করা যাবে না, লিখতে গেলে পিরামিড বানানোর মতো ব্যাপার হবে।

ঘরে বাইরে রাস্তা ঘাটে, স্কুল কলেজে, অফিসগুলায়, সবখানেই নারীকেই ক্ষমাশীল, পরিশীলিত, বুঝদার হতে হয়। জানি আমি ক্লিশেড কথা বলছি, কিন্তু এই কথা বারবার বলা দরকার।

Bihari 2ছেলেরা বেচারা পুরুষ হিসাবে বড় হয়েছে, অনেক কিছু শিখে নাই, শিখতেও শিখে নাই, তাই তাদের আদর-স্নেহ-ভালবাসায় মুড়ে তাদের অসহ্য, অসহনশীল আচরণ এবং চিন্তা-ভাবনাকে বুঝে এবং সয়ে চলতে হবে। নইলে আমরা ‘হুদাই চিল্লাই’, ‘অমানবিক’, ‘ফালতু’, কিংবা আমাদের জীবনে পুরুষ-সান্নিধ্যর অভাবে আমাদের স্বভাব নষ্ট। ঠিক কতোটুকু উদ্ধত হতে হবে, হওয়া উচিৎ, কতোটুক পর্যন্তই যাওয়া যাবে, এর বেশি না, এটা ঠিক করতে নারীদের এই সমাজের সাথে দরদাম করতে হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চাহিদা এবং পুঁজির ধরন বুঝে এর ফয়সালা হয়।

একেক নারীর একেক রকম বার্গেইনিং পাওয়ারে এক এক রকম অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়। তো এই ধরনের সমাজে আসলে নারীর গর্বিত হয়ে কী কন্ট্রিবিউট করার আছে, তা আমাকে ভাবায়।

গতকাল একটা আইন মন্ত্রীসভায় পাশ হোল। এখন থেকে ১৮র নীচে মেয়েদেরও বিয়ে দেওয়া যাবে। ১৮র নীচে ‘প্রাপ্তবয়ষ্ক’ কোন মেয়ের মা-বাবা এবং স্থানীয় প্রশাসন যদি মনে করে মেয়েটার বিয়ে দিলে তার সার্বিক উন্নতি হবে, তাহলে তাকে বিয়ে দেওয়া যাবে। কাউকে এ নিয়ে তেমন আওয়াজ করতে শুনছি না। সবাই কি ব্যাস্ত, না হতাশ, নাকি ভাবেন এই আইন খুবি সন্মানজনক হোল? আমি কোথায় আছি, কোন যুগে আছি, বুঝতে সমস্যা হচ্ছে।

কেন এতোগুলা কথা লিখলাম? আমার অস্থিরতাই বা এরকম কেন, বলছি এখন।

tortureআমি যখন ক্লাস টেন এ পড়ি তখন থেকেই আমার সদ্য ওয়াহাবী বাবা আমার জন্য পাত্র দেখা শুরু করে। আমার অজান্তে অবশ্যই। আমি বড় হয়েছি এই শুনে যে, “মেয়েদের বেশি লেখাপড়া করানোর দরকার কী? কামাই করে তো আর খাওয়াবে না”। মেয়েদের কামাই করারও অবশ্য অনুমতি ছিল না আমাদের বাড়িতে।

আমি মেধাবী ছিলাম, বলতে লজ্জা নাই, কাজেই হরেক রকমের শারীরিক-মানসিক-যৌন নির্যাতনের মধ্যে বড় হয়েও আমার স্বপ্ন ছিল, কোনমতে আমি লেখাপড়াটা শেষ করতে পারবো। তারপর বিয়ে ফিয়ে তখন সামলানো যাবে। আমার বাবার টাকা পয়সার অভাব ছিলো না, কিন্তু তাই বলে আমি মনে করি না যে, পয়সা কম থাকলে আমার জন্য ব্যাপারটা অন্য রকম হতো। আরো পেইনফুল হতো।

যাই হোক সে পাত্র দেখে চললো, এবং শেষপর্যন্ত এক ছেলেকে পছন্দ হলো আমি যখন এইচএসসি পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছি। কিন্তু একমাত্র মেয়ে আমি, আমাকে বিশাল আয়োজন করে বিয়ে দেওয়া হবে বড়লোক এক মুসল্লি ছেলের সাথে, সবাই মিলে খুশি খুশি এই সিদ্ধান্ত নিল। আমি তখনও কিছুই জানি না। পাত্র আমাকে একবার দেখতে আসলো। তখন আমি বেঁকে বসলাম। আমি মা-বাবাকে লেখাপড়া শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার অনুরোধ করা থেকে শুরু করে হবু শাশুড়ির বারবার বিরক্তিকর ফোন কেটে দেওয়ার কারণে বাবার হাতে মার খাওয়া পর্যন্ত, সবই হলো। কিন্তু ততদিনে তাঁদের মধ্যে ডিল পাকা, আমাকে লুকিয়ে বিয়ের বাজার করা শুরু হলো। এবং এমন একটা আয়োজন তারা করলো, যাতে আমি বিয়েতে রাজী হতে বাধ্য হই।

mithila-1
মিথিলা মাহফুজ

এর ডিটেইলে আমি যাবো না। আমার বন্ধুরা অনেকেই জানে, এবং তারাই আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে। আমি শেষমেশ আর উপায় না দেখে বাসা থেকে পালিয়ে চলে আসি। সেসব বন্ধুদের কথা আজ এখানে বলবো না, যদিও বলবো একদিন। তারা আমার শরীরের অংশের মতো।

আমি চলে আসার পর অনেক ড্রামা হয়েছে। আমাকে বহু বছর অনেক সাবধানে চলতে হয়েছে। আমাকে ক্ষতি করার, অপহরণের চেষ্টা হয়েছে। আমার নামে অশ্লীল গুজব ছড়িয়েছে স্বয়ং আমার বাবা। সেসব এখানে বলার কিছু নাই। এখন একজন স্বামীর সাইনবোর্ড গলায় ঝোলানোতে হ্যারাসমেন্টটা অন্তত থেমেছে। দৈনিক ভিত্তিতে টেনশন থেকে এখন আমি মুক্ত।  

আমি অন্য কোনো, বিশেষত গরীব ঘরের মেয়ে হলে ব্যাপারটা অবশ্যই অন্যরকম হতো। ঐযে বললাম না, একেকজনের একেক রকম দরদাম করার ক্ষমতা। আমি বিদেশ ঘোরা, ইংরেজি বই পড়া মেয়ে ছিলাম, আর আমার বন্ধুরা অসাধারণ মানুষ, নইলে আমি আজকে কোথায় থাকতাম, আর এই নোটই বা কে লিখতো, কে জানে!

আমার দুইদিন ধরে শুধু মনে হচ্ছে যে এই আইন যদি আমার ক্লাস টেনে থাকতো, তাহলে আমার মতো মেয়েকেও বিয়ে দিয়ে দেওয়া যেত। আমার বয়স বাড়াতে হতো না, কাউকে ঘুষ দিতে হতো না, লুকাতে হতো না, আইনত বৈধ বিয়ে হতো আমার ঐ ছেলেটার সাথে যে আমাকে দেখতে এসে বলেছিল, “মিথিলা আবার কেমন নাম রাখসে আপনার আব্বু, আপনার অন্য ভালো নাম নাই?”

কালকে আমার একটা পরীক্ষা আছে। কিন্তু কালকে সুন্দরবন বাঁচাতে মহাসমাবেশ হবে, সবাই প্রাণের টানে জড়ো হবে। আমার পরীক্ষা খুবই খারাপ হবে, কারণ ঠিক যেসময় সমাবেশ শুরু হবে, ঠিক তখনই আমার পরীক্ষাও। এখন আবার একটা নতুন ভাবনা মনে জায়গা করে নিল। যে সুন্দরবন আমরা জান দিয়ে বাঁচাবো বলে পণ করেছি, সে সুন্দরবন নারীরও হবে কি?     

শেয়ার করুন: