ভাগাভাগি থেকে ভায়োলেন্স!

তাবাস্‌সুম নীহাল: একটা পরিস্থিতি বলি। একটা বাসায় মিষ্টি কিনে নিয়ে গেলে বাসার মা বা মেয়েই সেটা গোছায় সবসময়, কাগজের বক্স থেকে ঢেলে প্লাস্টিকের বক্সে রাখে, ফ্রিজে তুলে। একদিন বাসার ছেলেটা অফিস থেকে ফেরার পথে মিষ্টি কিনে নিয়ে আসলো। সেসময় মেয়ের হাত বন্ধ, বা সে ব্যস্ত, তাই সে সেদিন মিষ্টিটা গোছায় নাই। আর যে কোনো কারণেই হোক, মা-ও গোছাতে পারেনি। রাতে খেতে বসার জন্য সবাই টেবিলে গিয়ে দেখে- ছেলেটা মিষ্টি গোছাচ্ছে। নিজেই প্লাস্টিকের বক্স বের করে নিয়ে এসেছে।

ও করছে দেখে মেয়েটা আর হাত দিলো না, প্লেট নিয়ে খেতে বসে গেলো। মা তাকালো মেয়ের দিকে, কিছু বলতে চাইলো। মেয়ে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে খাওয়াতে মনোযোগ দিলো। কারণ মেয়ে জানে, মা আসলে কী বলার চেষ্টা করছিলো।

“ছেলেটা মিষ্টি গোছাচ্ছে, আর তুমি খেতে বসে যাচ্ছো? তুমি মিষ্টিটা গুছায়ে রেখে তারপর খেতে বসো।” অনেকে হয়তো নিজের সাথে এমন পরিস্থিতির মিল পাবেন, আবার অনেকে পাবেন না। আমার প্রশ্ন হচ্ছে- কী হবে, যদি বাসার ছেলে একদিন এই কাজটা করে? সমস্যা কোথায়? মেয়েটাকে যদি সবদিনই পারতে হয়, ছেলেটাকে কি অন্তত একটা দিন পারতে হয় না? কাজের মধ্যে এই যে ভাগ, এগুলো কে শেখায়? কেন শেখায়?

neehal
তাবাস্সুম নীহাল

এই কাজ মেয়ে করলে মানায়, ছেলে করলে মানায় বা। ঐ কাজটা ছেলে করলে মানায়, মেয়ে করলে মানায় না। এই থিওরি কোথায় লেখা থাকে?

আজকে International Day for the Elimination of Violence against Women. যে ঘটনাটা উদাহরণস্বরূপ বললাম, আমি বলছি না বা বলতে চাইছিও না যে, একেই বলে Violence. কিন্তু আমি বিশ্বাস করি- এইরকম তুচ্ছ ও নগণ্য ঘটনা থেকেই Violence এর শুরু।

একদম ছোট্টবেলা থেকে এগুলো শুরু হয়। মেয়ে বাচ্চাকে খেলার জন্য কিনে দেওয়া হয় পুতুল, হাঁড়িপাতিল। আর ছেলেবাচ্চাকে গাড়ি, পিস্তল, বন্দুক, রোবট। কেন দুইরকম? মেয়ে শুধু পুতুল দিয়েই খেলবে, হাঁড়িপাতিল দিয়ে রান্নাবাটি খেলবে, কিন্তু গাড়ি বা বন্দুক দিয়ে তার খেলা সাজে না। ঠিক একইরকমভাবে ছেলে যদি পুতুল বা হাঁড়িপাতিল দিয়ে খেলে, তাহলে তা বেমানান। আস্তে আস্তে বড় হতে হতে ওরা দুইজনই দেখে এবং ওদের মাথায় এভাবেই বসে যায়- ছেলে শক্তিশালী চরিত্র, আর মেয়ে দুর্বল।

আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে- যে মেয়ে আরেকটা ছেলেকে জন্ম দেওয়ার মতো শক্তি ধারণ করে, সে কি আসলেই দুর্বল? বাসায় মেহমান আসলে নাস্তাপানি তৈরি করে মেয়েটা নিয়ে যায় সামনে, আর ছেলেটা শুধু দেখা করতে যায়! চুলায় একটা রান্না চাপানো, মা কোথাও গেলে মেয়েটাকেই বলে যায়- দেখে নামিও, ছেলেটাকে কখনো বলে না!

কোনো বন্ধুর বাসায় যেতে ছেলেটা শুধু বলে চলে গেলেই হয়, কিন্তু মেয়ের বেলায় আগে বাবা-মাকে জানাতে হবে, কারণ বলতে হবে, অনুমতি নিতে হবে, অনুমতি পেলে কেবলমাত্র তখনই যেতে পারবে! এমনকি রঙের বেলাতেও আমরা ভাগাভাগি করে ফেলি- মেয়ের পোশাক-আশাক, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হবে গোলাপি গোলাপি, আর ছেলের গুলো হবে নীল নীল। ছেলেকে গোলাপি রঙের কিছু দিলে তার মনে হয়- এতে তার সম্মানহানি হবে, বন্ধুরা খ্যাপাবে, মজা নিবে!

বিয়ের সময় ছেলের বেলায় বলা হয়- ছেলে বিয়ে করছে। আর মেয়েকে বাবা-মা বিয়ে দিচ্ছে! ছেলে ক্যারিয়ার সচেতন হলে খুব বাহবা পায়। কিন্তু একই কারণে মেয়ের জন্য বরাদ্দ তিরস্কার! কমবেশি সব মেয়েই এই শুনে শুনে বড় হয়- ছেলেরা হচ্ছে কচুপাতা। কচুপাতার গায়ে যেমন জল লাগে না, তেমনি ছেলেদের গায়েও কোনো দাগ লাগে না। দাগ লাগে শুধু মেয়েদের গায়ে, তা সে স্বেচ্ছায় বা জোরপূর্বক, যেভাবেই হোক না কেন!

ব্যাপারগুলো হয়তো অনেক সূক্ষ্ম, অনেক। কিন্তু দিনশেষে এগুলোই অনেক বেশি পার্থক্য করে দেয়, যেটা আমরা হিসাব করে দেখি না। দেখি না বলেই আলাদা একটা দিন পালন করা লাগে- International Day for the Elimination of Violence against Women.

ছেলে আর মেয়ের বুঝতে শেখার বয়স থেকেই এই যে ভাগাভাগি শুরু হয়, পরবর্তীতে এগুলোই অন্যান্য বৈষম্য এবং সামাজিক অবক্ষয়কে উৎসাহিত করে বলে আমার মনে হয়। যেমন- রাস্তায় কোনো মেয়েকে টিজ করা। যে ছেলে নিজের বাসায় এই ভেদাভেদগুলো দেখে বড় হয়েছে, সে জানে- মেয়ে মানেই দুর্বল, কিছু বলবে না, মাথা নিচু করে চলে যাবে, কোনো আওয়াজ করবে না, আমি ওর উপর প্রভাব খাটাবো, আমার কথাই ফাইনাল, আমি যা করবো, তাই ঠিক। সেজন্যই সে ঘরে বাইরে, রাস্তাঘাটে, সবখানে নিজের superiority দেখায়, দেখাতে চায়!

কী ক্ষতি, যদি সেই বাচ্চাবয়স থেকে এই ভাগাভাগিগুলো না শেখানো হয়? প্রকৃতিগত যে পার্থক্য, সেটা স্রষ্টার বিধান। সেখানে কারোই কিছু করার বা বলার নাই। কিন্তু দুইজনই তো মানুষ, পরিপূর্ণ মানুষ। তাহলে দুইজনের জন্যই একই নিয়ম থাকলে অসুবিধা কোথায়? ছোট্টবেলায় সেই যে শেখা- “ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল; গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল”- এইক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এইসব বাছবিচার থেকেই বাড়তে বাড়তে ফুলেফেঁপে একদিন বিরাট, বিশাল অসমতা তৈরি হয়। যখন থেকে একজনকে আরেকজনের চেয়ে উচ্চতর করে আর দেখানো হবে না; প্রতি পদে পদে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দিয়ে দুইজনের মধ্যে আর তারতম্য করা হবে না; পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র থেকে আর শেখানো হবে না যে, মেয়ের জন্য যা যা বিধিনিষেধ, ছেলের বেলায় সেইসব প্রযোজ্য না; হয়তো তখন থেকে নভেম্বর মাসের ২৫ তারিখ আর International Day for the Elimination of Violence against Women পালন করা লাগবে না।

শেয়ার করুন: