অনেক কিছু মনে পড়ে গেলো এই ভিডিও দেখে

ফারজানা শারমীন সুরভি: ভিডিওটির শিরোনাম, “ডার্ক স্কিন রুইনড মাই লাইফ”! ভিডিওতে একজন মেয়ে বলছেন, কিভাবে তার কালো রঙের জন্য তিনি “ব্রাউন কমিউনিটি” তে প্রতিনিয়ত হেনস্থা হন। অনেক কিছু মনে পড়ে গেলো এই ভিডিও দেখে! 

surovi
ফারজানা শারমীন সুরভি

বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের বেশিরভাগ মানুষজনই সাঙ্ঘাতিক রেসিস্ট। হ্যাঁ! আমি কালো। অ-নে-ক কালো। শ্যামলা বলেও আমাকে চালানো যায় না। আমার স্কিনও খারাপ। মুখ ভরা ব্রণ! আমি ফর্সা হওয়ার কোনো চেষ্টাও জীবনে করি নাই। এবং এটা নিয়ে আমার কোনো ইনফেরিয়র কমপ্লেক্স নাই। আমার ধারণা, আমি সুন্দরী। এবং এটা নিয়েও আমার কোনো সুপিরিয়র কমপ্লেক্স নাই। মানুষ নিজে যা কিছু অর্জন করে, সেটাই তার গুণ। ঈশ্বর প্রদত্ত শারীরিক সৌন্দর্যকে আমি আমার অর্জন মনে করি না।

আমি কালো। এবং আমার বোনরা সবাই ফর্সা এবং সুন্দরী। এই জন্য আমাদের সমাজ আমাকে ছোটোবেলা থেকেই ক্রমাগত বুলিং করে আসছে। এটা আমি সমাজের রেসিজম এবং মুর্খতা মনে করি। যেই মানুষ এই মানসিকতা পোষণ করে যে, “কালো মানে অসুন্দর/ মোটা মানে অসুন্দর/ খাটো মানে অসুন্দর”; তাকে আমার আবর্জনা মনে হয়! এইসব আবর্জনাদের আমি অতীতেও লাত্থি মেরে সামনে এগিয়ে গিয়েছি, এখনো যাই।

আমাদের দেশে খাটো ছেলেদেরকেও অনেক রকম বুলিং করা হয়। এই অমানবিকতা দেখলে আমার করুণা হয়, অমানুষগুলোর জন্য। হলি ক্রস স্কুলে আমার এক বান্ধবী ছিল। সে সুন্দরী। সে আমাকে একবার বলেছিল, “কালো বাচ্চা আমি ঘৃণা করি। কালো বাচ্চাদের এত আগলি লাগে!” এই কথাটা যখন সে বলে, তখন সম্ভবত সে কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে! কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে! মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমার এই বান্ধবী নিজেও কালো ছিল। খাটো ছিল। তার হীনম্মন্যতা কোন লেভেলে থাকলে, সে নিজে কালো হয়েও কালো বাচ্চা ঘৃণা করতো! আমার এই বান্ধবী আশা করি, এখন কিছুটা বদলেছে।

কিন্তু “অমুককে ছেলে ছেলে লাগে/ তমুককে শাড়ি পরলে বুয়ার মতো লাগে/ তুই কালো! তোকে একটা কথা বলি! মাইন্ড করিস না আবার! ‘নিগ্রো’দের না আমার খাচ্চর খাচ্চর লাগে!”- এইসব তার নিত্যদিনের বুলি ছিল। আমি প্রার্থনা করি, আমার এই কালো বান্ধবীর সন্তান ফরসা হউক! না হয়, সে হয়তো নিজের সন্তানকেই ঘৃণা করবে।

ছেলেদের কাছ থেকে পাওয়া আমার বহুল প্রচলিত কমপ্লিমেন্ট হলো, “আপনি কালো হলেও সুন্দর!” এই ধরনের কমপ্লিমেন্ট শুনলেও মজা লাগে! হায়রে রেসিস্ট! আমার আত্মীয়-স্বজনরা মাশাল্লাহ ছোট বেলা থেকেই আমাকে ক্রমাগত মনে করিয়ে দিতে চায়, “তুই কালো! তুই অসুন্দর! তোর বোনরা সুন্দরী!”

advertisementআমার এক আত্মীয় আছেন। তিনি নিজেও কালো। এই মহিলার যন্ত্রণায় আমি ছোটবেলা থেকে অস্থির! বাসায় আসলেই “তুই এত কালো ক্যান? তোকে তো তোর বাপ-মা পার করতে পারবে না!”, গান গাওয়া শুরু করেন। আর কোনো কোনোদিন খুশি খুশি গলায় বলেন,”সুরভি, তুই মনে হয় একটু ফর্সা হইসিস!”

আমার পাঁচ এবং দুই বছরের ফুটফুটে ভাগ্নিদের দেখে তাঁর প্রতিক্রিয়াও অদ্ভুত! আমার বড় ভাগ্নিকে তিনি বললেন, “কী ব্যাপার! তুমি এতো কালো ক্যানো? তোমার ছোট বোন কী সুন্দর আর ফর্সা”! আমার পাঁচ বছরের ভাগ্নি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ!

আমার আরেক জন আত্মীয় আছেন। উচ্চ শিক্ষিতা এবং চাকরিজীবী। প্রচলিত অর্থে সুন্দরী নন মোটেও। কিন্তু উনার উচ্চশিক্ষা উনার মানসিকতাকে বদলাতে পারেনি একটুও। আমার ফর্সা এবং সুন্দরী ছোট বোনকে আমার সামনেই উনি বলেন, “সিলভি! তোর গায়ের রঙ একটু ময়লা হয়ে গিয়েছে মনে হয়। খবরদার! গায়ের রঙটাই জীবনে সবকিছু! গায়ের রঙ যেন কালো না হয়!” কিংবা “কালোদেরকে এই রং এ মানায় না!”/ “সুরভির বিয়ে হবে কি করে/ ও তো কালো”! তাদের এই হাস্যকর মানসিকতার পরিবর্তন হউক। তারা সুস্থ হউক- এই প্রার্থনা করি।

আমি মানসিকভাবে অসম্ভব শক্তিশালী একজন মানুষ। আমি লিবারেল-প্রগ্রেসিভ এবং মানুষ হিসেবে ভালো। এগুলোকেই আমি আমার এচিভমেন্ট মনে করি। আমি ছোটোবেলা থেকে পাড়ার বখা ছেলেদের মুখে শুনেছি, “এই কালী/ এই কালী/ বাজারে তো ফেয়ার এন্ড লাভলী পাওয়া যায়, মাখতে পারো না/ এই কালীর এত্তো ভাব কিসের রে! আমাদের পাত্তা দেয় না / কাকও একটা পাখি, এইটাও একটা মেয়ে মানুষ” ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি স্কুলে গেলে আমার বয়সী অসুস্থ বান্ধবীদের মুখে শুনেছি, “তুই এত কালো” এই টাইপের কথা!

আমার এক প্রতিবেশী বাসায় এসে বলে গিয়েছিলেন, আমি নাকি কাকের মতো দেখতে! আমার এক পুরুষ আত্মীয় (ফুটনোট: তিনি সরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন। এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছেন।) সময় পেলেই আম্মাকে আমার ছোট বোনের কথা বলতেন, “সিলভি যে কেন কষ্ট করে কুয়েটে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেলো! ও ঢাকাতে পড়লেই পারতো। এইটা কি সুরভির মতো কালো ছেমড়ি, যে বিয়ে দিতে ঝামেলা হবে!” অথচ আমার এই ভাইয়ের নিজের গায়ের রঙ আফ্রিকান আমেরিকানদের মতোই কালো। কি ভীষণ সেলফ লোদিং!

এক ব্যাঙ্কে এইচ আর এ কাজ করতাম! ব্যাঙ্কে ক্যাশ সেকশনে মেয়ে নেয়া হচ্ছিলো। আমাদের এইচ আর ম্যানেজার আমাকে বললেন,”ফারজানা! সিভিগুলো থেকে ফরসা, কম বয়স্ক এবং সুন্দরী মেয়ে খুঁজে বের করো!” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহপাঠী ছেলেরা আমার নাম দিয়েছিল “কন্ডোলিতসা রাইস”। কেননা আমি আফ্রিকান আমেরিকানদের মতো কালো এবং আমি মোটামুটি নিঁখুত আমেরিকান একসেন্টে ইংলিশে প্রেজেন্টেশন দিতে পারতাম! এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে বাংলাদেশে কালো রঙের জন্য আমাকে বুলিং করা হয়নি। স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, আত্মীয়-স্বজনের বাসায়। এমনকি টিউশনি করাতে গিয়েছি। ছাত্রীর নানী বলে বসলো,”এহ! এই মেয়ে এতো কালো কেন! কাঁচা হলুদ মাখবা, বুঝছো”!

কী করে বুঝাই বুড়ি তোকে, আমি তো ফর্সা হতে চাইনি কখনো! পারলারে যাই আই ব্রো প্লাক করাতে। সেবাপ্রদানকারী মেয়েটি বলবে, “আপু, আপনি এই ফেসিয়াল করান। ফর্সা হবেন।” “ও! উনি আপনার বোন! কী ফরসা! আহারে! আপনি একাই কি আপনার বোনদের মধ্যে কালো! আহারে!” কী করে বুঝাই মস্তিষ্কহীনের দল, আমি ফর্সা হতে চাইনি কখনো!

আমার প্রেমিকটি এই সমাজের ডেফিনিশন অনুযায়ী ভীষণ বোকা নিশ্চয়ই! বাংলাদেশের এতো এতো ফর্সা মেয়ে রেখে এবং নিজে ফর্সা হয়েও সে কিনা আমার প্রেমেই পড়েছিলো! এবং আমাদের রিলেশনকে এতো লম্বা সময় টেনে নেওয়ার ক্রেডিট পুরোটাই তার।

আরেকটা হাস্যকর ব্যাপার হলো। বাংলাদেশে আপনি মোটা হলে আপনাকে সবাই বলবে, “এমা! কী মোটা! বিয়ে-শাদী হয় নাই। এখনই এতো মোটা”! আর স্কিনি হলে বলবে, “এহ! মেয়েমানুষ এতো শুকনা হইলে কেমনে হবে! কোনো ছেলেই তো এট্রাকটেড হবে না”। আমার এক সুন্দরী বান্ধবী আমাকে বডি শেমিং করতেন প্রায়ই। তিনি জিরো সাইজ এবং আমি ভুড়িওয়ালি বলে। এদের জন্য আমার করুণা হয়।

শারীরিক সৌন্দর্যের বাইরেও যে একটা বিশাল দুনিয়া আছে, এটা এই বোকাগুলো কখনো আবিষ্কার করতে পারেনি। বাংলাদেশে থাকার অনেক সুবিধা আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু আমেরিকায় থাকতে আমার যেসব কারণে ভালো লাগে, তার অন্যতম কারণ হচ্ছে মানুষজন এখানে এতোটা রুডলি কাউকে বডি শেমিং করে না। এখানে কেউ আমি কালো, নাকি শুকনা, নাকি মোটা, নাকি খাটো- এইসব ব্যাপার নিয়ে অহেতুক মন্তব্য করতে আসে না। সে আমার ফ্রেন্ড হলেও না!

এখানে মিথ্যা করে হলেও সবাই সবাইকে বলে, “ওহ! ইউ আর সো প্রিটি/ আই লাভ ইউর আউটফিট/ ইটস সো কিউট”। এখানে সেদিন এক বাংলাদেশী মেয়ের সাথে দেখা। প্রতিবার দেখা হলেই উনি বলেন, “ইস! এতো কালো হয়ে গেছো!” কেমনে বুঝাই, আমি কালো হচ্ছি-না ফর্সা হচ্ছি, আই ডোন্ট গিভ আ শিট! ভারতীয় বান্ধবীদের দেখি। রেসিজমে পিছিয়ে নেই তারাও।

আমরা অনেক ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যকে অনুকরণ করি। আশা করি, এই ভদ্রতা শেখার ক্ষেত্রে একদিন বাংলাদেশীরা আমেরিকানদের অনুকরণ করতে পারবে। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এবং আমেরিকার মানুষকে বাংলাদেশীরা সেক্সিস্ট-রেসিস্ট বললে আমার হাসি পায়। আমেরিকাতে রেসিজম আছে। কিন্তু বাংলাদেশীরা তো নিজেরাই একেকজন ক্ষুদে ডোনাল্ড ট্রাম্প! রেসিজম এবং সেক্সিজমে আমরা কম যাই কিসে!

সবার কথা বলছি না! ভালো মানুষ সব দেশেই আছে। আশা করি, এই ভালো এবং ভদ্র মানুষরাই একদিন বাংলাদেশে মেজরিটি হবেন। আর বাংলাদেশের সব কালো মেয়েকে একটা কথাই বলতে চাই, “উহু! ফরসা হওয়ার চেষ্টা করো না ভুলেও। এই রেসিস্ট সমাজের মুখে লাত্থি মেরে এগিয়ে যাও।” বাংলাদেশের মোটা বলে কটুক্তির স্বীকার হওয়া মেয়েদের বলছি, “যদি তোমার ওজন তোমার অসুস্থতার কারণ না হয়, ওজন কমানোর অসুস্থ চেষ্টা করো না ভুলেও। শরীরের সব কার্ভকে সমতল করে সাইজ জিরো হওয়ার চেয়েও তুমি সুস্থ-সবল ভাবে কাজ করতে পারবে নাকি, এটা জরুরী”।

আর উচ্চতার জন্য প্রতিনিয়ত যেসব মেয়েরা কটুক্তির স্বীকার হয়, তাদেরকেও বলছি, “তুমি কি হাইট ধুয়ে পানি খাবে?!উচ্চতা দিয়ে সৌন্দর্য মাপা যায়? মাথা উঁচু করে সামনে এগিয়ে যাও। ডোন্ট গিভ আ শিট!”

শেয়ার করুন: