অশান্তির দেশে শান্তির নোবেল

শারমিন জান্নান ভুট্টো: শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয় ১৯০১ সাল থেকে। এ পর্যন্ত নোবেল শান্তি পুরষ্কারপ্রাপ্ত ১৫ জন নারীর মধ্যে অং সান সুচি একজন। সামরিক স্বৈরতন্ত্রের বিপক্ষে অহিংস ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের জন্য ১৯৯১ সালে তাকে এ পুরষ্কার দেয়া হয় আর তখন তিনি ছিলেন কারাবন্দী। রাজনৈতিক জীবদ্দশায় শান্তিতে নোবেল জয়ী সু চি ২১ বছরের মধ্যে ১৫ বছরই গৃহবন্দী ছিলেনদীর্ঘদিন ধরে গণতন্ত্রের দাবিতে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া সুচি ২০১০ সালের এই নভেম্বর মাসেই গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি পান আর যতদূর মনে পড়ে, তারিখটা ছিলো সম্ভবত ১৩ নভেম্বর।

rohingya-5আপাতদৃষ্টিতে সুচি মুক্ত হলেও তার মনটা এখনও বোধ হয় বন্দি আছে নীরবতায়। তার দেশের সেনাবাহিনী নির্মম নির্যাতন চালাচ্ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর অথচ তিনি কোনো কথাই বলছেন না। শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার পর কি সবাই তাদের মুখ সেলাই করে ফেলেন? তার মানে তো দাঁড়ালো এই যে, পুরষ্কার বগলদাবা করে, বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে কার্যত তিনি খেই হারিয়ে ফেলেছেন। আর সুচিও প্রমাণ করলেন মানবতা আর গণতন্ত্রের জন্য যতই তিনি কথা বলুন না কেনো, দিনশেষে তিনিও একজন সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ।

rohingya-1একজন নেতার কাছে তবে কি তার জনগণের থেকে ধর্মই বড়? সুচি যতো বড়ই নেতা হোন না কেনো, তিনিও আসলে একই গোয়ালের গরু। ধর্ম ও অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে তিনিও মুখে তালা দিয়েছেন। সুচির রাজনৈতিক স্বার্থ এখন সকল মানবিকতার উর্ধ্বে, ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এভাবেই হয়তো নেতারা খোলস পাল্টায় আর জনগণ তারপরও তাদের নেতার প্রতি অগাধ বিশ্বাস-আস্থা রেখেই চলে।

রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার সরকারের নৃশংসতা, হত্যা আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে অং সান সুচি যে নীরবতা পালন করছেন, তাতে করে উগ্র আর মৌলবাদী গোষ্ঠীর প্রতিই কিন্তু সমর্থনের বিষয়টি ফুটে উঠছে স্পষ্ট করে। যে অং সান সুচিকে মানবতা আর শান্তি রক্ষায় প্রতিনিয়ত সমর্থন দিয়ে এসেছিলো রোহিঙ্গা গোষ্ঠী শুধুমাত্র এই আশায় যে, বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় এলে তাদের দু:খ-দুর্দশা কিছুটা হলেও লাঘব হবে! আর রোহিঙ্গারা যদি জানতো তাদের অগ্নিকন্যাও মুখ সরিয়ে নেবে সংখ্যালঘু গোষ্ঠী থেকে, তাহলে এতোটা দিন হয়তো তারা আশায় বুক বাঁধতো না।

rohingya-3বর্তমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের এ আশা শুধুই এক মরীচিকা। রোহিঙ্গা ইস্যুতে পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত যতটা উদারতা দেখিয়েছে তারা এক অংশও যদি সুচি করে দেখাতেন, তবে মিয়ানমারের হয়তো আর কাউকেই নিজভূমি ছেড়ে পালাতে হতো না গত কয়েক বছরে।,

নাগরিক  অধিকার রক্ষা, বঞ্চিতদের অধিকার ফিরিয়ে  আনা আর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলে অং সান সুচি গত তিন দশকেরও বেশী সময় ধরে মিয়ানমারে রাজনীতি করে আসছেন। অথচ নিজের দেশে একটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠী ক্রমাগত মানবেতর জীবন-যাপন করছে আর সংখ্যাগরিষ্ঠ উগ্র বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের দ্বারা নির্যাতনের পাশাপাশি গণহত্যার শিকার হচ্ছে সেই রোহিঙ্গাদের অধিকার রক্ষায় একটি শব্দও উচ্চারণ করছেন না তিনি।

su-kii-1আসলে সুচির প্রগতিশীলতা ছিলো একধরনের মুখোশে মোড়া। সংখ্যাগরিষ্ঠদের বিপক্ষে গেলে রাজনীতির ময়দানে হোঁচট খাবেন এই ভয়ে যদি সুচি চুপ থাকেন তবে বলতেই হবে, সুচির সাথে সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদ আর মানবতাবাদীদের সঙ্গে তুলনামূলক কোন পার্থক্যই নেই।

বিশ্বব্যাপী খ্যাতি পাওয়া সুচি অনেকের জন্যই ছিলেন মানবাধিকার আইকন আর মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামী জনগণের শত আশার আলো আর আকাঙ্খার প্রতীক। তবে যে সুচিকে বিশ্ব দেখেছে সেই সুচি রাজনীতিতে প্রবেশ করার সাথে সাথে পাল্টে গেছেন একেবারে। যিনি মানবতার ঝাণ্ডা উড়িয়ে বেরিয়েছেন সর্বক্ষণ সেই সুচি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন মানবেতর জীবন-যাপন করা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ওপর থেকে।

আর্দশবাদ থেকে বিচ্যুত হয়ে কিভাবে কঠোর বাস্তবতার পথ বেছে নিয়ে ভারী পাল্লার দিকে নিজেকে সঁপে দিতে হয় তার নিকৃষ্ট উদাহরণ বোধহয় সুচিই তৈরি করলেন। বন্দি সুচি আর মুক্ত সুচির মাঝে অনেকটাই আকাশ আর পাতাল পার্থক্য। নিজ দেশের সমস্যা সমাধানে সুচি আপনি কথা না বললে আর কে বলবে, বলুন তো।

রোহিঙ্গা কোন ধর্মে বিশ্বাসী সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে বরঞ্চ তাদেরকে মানুষ হিসেবে গণ্য করা হলে হয়তো আজকের এ রক্তাক্ত আর অশান্ত মিয়ানমারকে দেখতো হতো না বিশ্ববাসীকে। দেশে দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্মের বিশ্বাস এতোই প্রবল আর প্রখর যে অন্য বিশ্বাসের মানুষদের রক্তাক্ত হতে দেখলেও কারো হৃদয় কম্পিত হয় না। আর সেখানে সাহায্যের হাত বাড়ানো অনেক দূরের চিত্র। অনেক নিষ্ঠুর এ দুনিয়া যেখানে সংখ্যালঘুরা অবহেলিত আর নির্যাতিত ক্ষণে ক্ষণে। মানুষকে যতদিন ধর্মের মানদণ্ডে বিচার করা হবে ততদিন মানবতা লংঘিত হবেই।

মিয়ানমারের বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে অশান্তির দেশে শান্তিতে নোবেল পাওয়া অনেকটা বিলাসিতা আর প্রহসনও বলতে পারেন। মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য একটু সহানুভূতি কী মানুষ পেতে পারে না- ভুপেন হাজারিকার এ গানের অর্থ বোঝার জন্য সত্যিই কী মানুষের অভাব পড়েছে এ পৃথিবীতে!!!

সুচি, আপনার এই নিষ্ঠুর নীরবতার বাঁধ কবে ভাঙবে, কবে আপনি আবার জেগে উঠবেন আর কণ্ঠ সোচ্চার করবেন মানবতার পক্ষে, কবে আসবে সেদিন, বিশ্ববাসী আপনার দিকে তাকিয়ে আছে অধীর আগ্রহে, অপলক দৃষ্টিতে। হয়তো একদিন বিশ্বব্যাপী ধর্মের নয় জয় হবে মানবতা, মনুষ্যত্ব আর অসাম্প্রদায়িকতার।

শেয়ার করুন: