চেনা অপরিচিতা: সুখের চাকরি বেশিদিন সইলো না। দু বছরের কিছু বেশি করে ইস্তফা দিলাম। নতুন জায়গায় ট্রান্সফার ধাতে সয়নি। চাকুরীহীন জীবনে দেখলাম বহু প্রভাবশালী আত্মীয় স্বজন যাদের উদাহরণ টেনে বাবা-মা’র নাক উঁচু হয়ে যেত, তারা চাকরির ব্যাপারে সহযোগিতা করতে পারুক বা না পারুক, অনবরত আমি কবে জয়েন করছি সেটাই জানতে চায়। এটা কি ধরনের প্রশ্ন আমি বুঝি না। আমাকে চাকরির ইন্টারভিউতে ডাকতে হবে, তারপর সিলেকশন হবে, তারপর জয়েনের প্রশ্ন। এরকম অবস্থায় এই প্রশ্নের কী জবাব দেবো, সত্যি বুঝতাম না। শেষের দিকে ভীষণ বিরক্ত লাগতো। তখন বলতাম, আগে তো আমাকে ডাকতে হবে, তারপর না কোথাও ঢুকব।
আমার বেকার জীবনে গান ছিল ভরসা। অর্থনৈতিক ভরসার কথা বলছি না। মানসিক শান্তির জায়গা ছিল আমার গান। কারণ, বাসায় তখন নানা রকম সাধু আর হুজুরদের তদবির, ঘটকদের আনাগোনা বেড়ে গিয়েছিল। কোন সাধু বলেছে বলে আমার প্রকাশ্য দিবালোকে তালগাছ ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। আমার মা তাই চাইতো। এসবে বিশ্বাস অনেক আগেই চলে গিয়েছিল। তবু করতাম, আমার মা স্বস্তি পাবে বলে।
সিঁদুরের ওপর দাঁড়িয়ে প্রতি সোমবার গোসল, ফুল নিয়ে হুজুরের সামনে মোমবাতি জ্বেলে বসা, কোন কাগজের উপর কোন মন্ত্র লিখে তাতে পাড়া দেওয়া ইত্যাদি আমার মা আমাকে করতে বাধ্য করতো আমার বিয়ে হয় না বলে।
একদিন গোসল করে গায়ে লোশন দেবো, দেখি তেল চুয়ে পড়ছে। গন্ধ নিয়ে দেখি সর্ষের তেল। পড়া তেল মাখতে চাইবো না দেখে হয়তো লোশনে মিশিয়ে দিয়েছিল। আমার মাকে যখন জিজ্ঞাস করলাম, অস্বীকার করলো। আমি কেন যেন ভাবতেই পারতাম না আমার মা আমাকে মিথ্যা বলতে পারে। কিন্তু আম্মা বলতো।
অনেকে নিশ্চয়ই আমাকে মনে মনে গালি দিচ্ছেন। নিজের মা সম্পর্কে এভাবে বলছি! কিন্তু এটা যেদিন কোনো সন্তান আবিষ্কার করে তার সবচে’ নির্ভরতার মানুষটি তার মা সম্পর্কে, তার চেয়ে দুঃখজনক, পায়ের নিচে মাটি সরে যাবার মতো অনুভুতি আর কিছুতে হয় না। আমরা সবাই মানুষ, মা ও মানুষ, তিনি মিথ্যা বলতেই পারেন। কিন্তু কেন যেন এটা মানতে বড্ড অসুবিধে হয়।
ঘটকের অফিসে যেতে হতো। সেখানে পাত্ররা আমাকে দেখতো। একবার বুয়েটের এক কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আমাকে দেখতে এলো ঘটকের অফিসে। উনি ভুরু না নাচিয়ে কথা বলতে পারেন না। আমি জড়োসরো হয়ে বসে আছি। আমার বাবা-মা আমাদের রেখে পাশের রুমে চলে গেলেন। নানান কথা হেসে হেসে বলে একসময় দেয়ালের একদিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ওটা দেখেছেন?” আমি সেদিকে চেয়ে দেখলাম কলমে দাগ কাটা ঘর। উচ্চতা পরিমাপের। একটু পর এই কথা সেই কথা বলে বলে, “আপনার হাইট কত?” আমি বললাম। শুনে বলে, “আপনাকে দেখে মনে হয় না এতো। আপনি কি ওখানে (দেয়ালের যেখানে দাগ কাটা সেদিকে দেখিয়ে) দাঁড়াবেন? আমিও দাঁড়াবো”।
আমি কেঁপে উঠলাম। কিছুটা অপমানে, কিছুটা সঙ্কোচে। বললাম, “দাঁড়াতে হবে?”
তিনি হেসে বললেন, “জ্বী”।
আমি দাঁড়ালাম। এবং অবাক হয়ে দেখলাম পাত্র সাহেব একবার আমার পায়ের দিকে একবার মাথার দিকে ভাল করে দেখে নিলেন। পায়ের দিকে চেয়ে নিশ্চিত হলেন আমি হিল পরেছি কিনা, আর মাথার দিকে আমার উচ্চতা যা বলেছি তা ঠিক কিনা পরখ করে নিলেন। তারপর সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “ঠিক আছে, এখন বসুন,” তারপর উঠতে উদ্যত হয়ে বললেন,” আমি দাঁড়াবো?” আমি আঁতকে উঠে বললাম, “না, না, আপনাকে দাঁড়াতে হবে না”।
আরেকবার এক সবুজাভ চোখের ছেলে দেখতে এলো। আমি তাকে দেখে আতঙ্কে শিউরে উঠে আমার মায়ের দিকে করুণ চোখে চেয়ে অনুরোধ করলাম, যাতে আমাকে একা রেখে না যায়। আমার অনুরোধ আমার মা ফেলে দিতে পারেননি।
ঘটকের অফিসে গেলে আপনাতেই অপমানে লজ্জায় মুখ গোমরা হয়ে যেত। এটা আমার মা-বাবা পছন্দ করতেন না। মুখ হাসি-হাসি রাখতে বলতেন। মাকে বড় ভয় পেতাম। কোন কিছু মায়ের মনমতো না হলে মানসিক চাপ আমার অবধারিত।
সবাই হয়তো ভাবছে বাবাকে নিয়ে বিশেষ কিছু বলছি না কেন? বাবা…আমার বাবাকে একটি বিশেষ ডাকে আমি, ডাকতাম বা এখনো যখন মাঝে-সাঝে কথা হয়, ডাকি। সেই ডাকটা আমি আজ অবধি কাউকে ডাকতে শুনিনি। এমনকি আমার ভাইও এই ডাকটির সাথে কিছুটা ভিন্নতা রেখেই ডাকে। আমার বাবাকে তুই বলতাম। যা পরবর্তীতে আর বদলাতে পারিনি।
বোঝাই যাচ্ছে, শিশুকালে আমি কতোটা বাপ-ন্যাওটা ছিলাম। সেই মানুষটি ক্লাস নাইনে এসে আমার জন্যে একেবারেই বদলে গেল। আদুরে বাবা থেকে কড়া গার্জিয়ান। পরিবারে যার কাছে আশ্রয়-প্রশ্রয় পেতাম, সে যখন আমূল বদলে গেল, তখন আমি মায়ের দিকে ঝুঁকে গেলাম। আমার মা একই থাকলেন। কড়া। ভাইয়া তখন পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে। আমি একটা মুরগির একটা বাচ্চার মতো মায়ের পিছে ঘুরি। আমার বাবা আমার তেমন কোন খোঁজ জানেন না। উনি বাসায় বসে অবজারভার পড়েন। রাত করে ইংলিশ ট্রান্সলেশন করান টেস্ট পেপার থেকে। পেপার থেকে ফরেন নিউজ রিডিং পড়তে পড়তে নানা ওয়ার্ড শিখি আর বকা খাই। আমার মেধা নিয়ে খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করার কোন কারণ নেই। কিন্তু বড় ভয় পেতাম অপমানসূচক কথাগুলোকে।
আমি আমার ছোটবেলার বাবাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। রোজ অভিমান জমতো। কিন্তু কারো ভ্রূক্ষেপ ছিল না। বাবা-মা সন্তানকে বকবেন, শাসন করবেন, কিন্তু হঠাৎ করে আর যাই হোক বদলে যাবেন না। আপনার সন্তানটিও ঐদিন থেকেই বদলে যাবে।
যাই হোক, ফিরে আসি যখন আমার বিয়ের তোরজোড় চলছিল সেই আলোচনায়। আমি মোটামুটি ধার্মিক ছিলাম। নিয়ম করে পাঁচ বেলা নামাজ পড়া হতো। একদিন আমার মা আমাকে একটা তাবিজ দেন। আমি বিনা আপত্তিতে সেই তাবিজ পড়ি। একদিন এক বন্ধু আমাকে বলে, “তুই নামাজ পড়িস, কার তাবিজ তোকে এনে দিসে, জিজ্ঞাসা কর”।
আমি সন্দেহ করেছিলাম, তাই সাহস করে জিজ্ঞাসা করলাম, কারণ ধর্মের কিছু বিধিনিষেধ আমি মেনে চলতাম। জিজ্ঞাসা করতেই আমার মায়ের মুখে আঁধার ভর করলো। পাল্টা প্রশ্ন করলো, “কেন?”
আম্মা তখন আমাদের পাশের বাড়ির এক হিন্দু মহিলার কথায় এক সাধুর কাছে যেত। আমি প্রশ্ন করলাম, “এই তাবিজটা কি সেই হিন্দু সাধু দিসে?” আম্মা মুখ কালো করে বললো, “হ্যাঁ”।
আমি তখন তাকে বললাম, “আম্মা আমি নামাজ পড়ি, এখন এটা তো শিরকের সামিল। আমি নামাজ পড়ে তো একজন হিন্দু সাধুর তাবিজ পড়তে পারি না। এখানে কী আছে কে জানে, শ্মশানের হাড় নাকি কেমনে জানবো?”
আমার মা বললেন, “এখানে শিকড়-বাকড় আছে” ইত্যাদি।
কিন্তু আমি আম্মাকে বললাম, “আম্মা, এটা পরে নামাজ হবে না। তোমার সব কথা শুনছি, এটা শুনতে পারবো না, সরি!” এই বলে আমি তাবিজটা খুলে ফেললাম।
আমার মা মুখ আঁধার করে রইলেন। পরদিন সকালে জানলাম, তিনি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।
(চলবে…)