লীনা ফেরদৌস: প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় একটা প্রশ্ন এসেছে–
“Saikat is a……
1) Muslim 2) Hindu 3) Buddhist 4) Christian…”

এভাবে ছোট ছোট কোমল মতি শিশুদের ধর্মীয় বিভাজন শেখানো হচ্ছে পাঠ্য পুস্তকে। “সৈকত একজন মানুষ” এই পরিচয়টা কি তবে আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়! “সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপর নাই” এই কথাটা আজকাল বার বার কেন ভুল মনে হচ্ছে!
আমার মেয়ের নাম মেঘলীনা মাধুর্য, একদিন একটি ফাস্ট ফুডের দোকানের বাচ্চাদের খেলার জায়গাটায় মাধুর্য তার সমবয়সী কতগুলো ছোট্ট বাচ্চার সাথে খেলছিল, হটাত করে সে দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস আমাকে করলো “মা আমি হিন্দু না মুসলমান ?” শুনে আমি আঁতকে উঠলাম, কারণ তাকে আমি এখনো ধর্মীয় বিভেদ সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা দেই নি, একজন মানুষ হিসবেই আগে সে নিজেকে জানুক এটাই চেয়েছিলাম। আমি মেয়েকে বললাম যে তুমি মানুষ। ততক্ষণে তার সাথে খেলতে থাকা বাচ্চাগুলো আমার কাছে ছুটে এসেছে, সেই পাঁচ/ছয় বছরের ছোট বাচ্চাগুলির একই প্রশ্ন ” মেঘলীনা মাধুর্য কোন ধর্মের” ? ‘মেঘলীনা মাধুর্য‘ নামটা শুনে তার ধর্মীয় পরিচয়টা বের করতে চাইছিল তারা, কিন্তু পারছিল না। আমার তখন অনেকটা ভাষা হারিয়ে ফেলার মত অবস্থা, এইটুকু কোমল মনে কিভাবে সাম্প্রদায়িকতা ঢুকিয়ে দিয়েছি আমরা।
আমাদের সমাজে ধর্মীয় ভেদাভেদ একটি শিশু তার সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য থেকেই শিখে ফেলে, শৈশবেই সে বুঝে ফেলে যে আপাত দৃষ্টিতে একই রকম দেখতে মনে হলেও মানুষে মানুষে একটা ধর্মীয় ব্যবধান আছে। আমি মনে করি যত যাই হোক না কেন একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ছোট থেকেই এই ধরনের সাম্প্রদায়িক বিভেদ কোমল–মতি শিশুদের শেখানো মোটেও উচিত নয়। একটি মানব শিশু তার পরিবার আর সমাজ থেকেই সাম্প্রদায়িক বিভেদের কথা শুনতে শুনতেই নিজের অজান্তেই তার মননে গড়ে তোলে এক ধরনের সাম্প্রদায়িক বৈষম্য।
সমস্ত পৃথিবী জুড়ে একটিমাত্র মানব প্রজাতি আমরা। নিজেদের প্রয়োজনে আমরা মানুষরাই সৃষ্টি করেছি দেশ–সভ্যতা–সংস্কৃতি–কৃষ্টি–ধর্ম। এসব সৃষ্টির সাথে সাথে বিভিন্ন ভাবে নিজেদের মধ্যে বিভেদও সৃষ্টি করেছি। আমরা ভুলে গেছি যে ভাষা–ধর্ম–বর্ণের ভিন্নতা থাকলেও দুনিয়ার সব মানুষের সৃষ্টি একই সত্তা থেকেই। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হয়েও নিজেদের ভেতর যে পরিমাণ ভেদাভেদ সৃষ্টি করেছে এরকম বিভাজন মনে হয় না আর অন্য কোন প্রাণীকুলের মধ্যে আছে। পশু–পাখীও নিজেদের মধ্যে মারামারি করলেও তারা নির্দয় ভাবে একজন আরেকজনকে কখনও প্রাণে মারে না বা খুন করে না, তবে মানুষ কেন এত বিবেকহীন, এত নির্দয় ! ধর্ম, বর্ণ, জাতি, ও গোষ্ঠী–গত বিভাজন কেন এত মানুষের ভেতর !
মানব সভ্যতা দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে, সভ্যতার সাথে সাথে যন্ত্র নির্ভর হয়ে পড়ছে আমাদের দৈনন্দিন জীবন। আমরাও দিন দিন হারিয়ে ফেলছি নিজেদের বিবেক, বুদ্ধি, বিচার, বিবেচনা, মূল্যবোধ, নৈতিকতা আর মনুষ্যত্ব। যান্ত্রিকতার চার দেয়ালে আটকে আছে আমাদের ভোঁতা অনুভূতি, আমাদের বোধশক্তি।
“মানবিকতা” এখন একটি আভিধানিক শব্দ ছাড়া আর কিছু না, আমরা এখন শুধু নৈতিকতা, মনুষ্যত্ব আর বিবেক বর্জিত রক্ত মাংসের ‘যন্ত্র মানব‘। আমরা এতটাই স্বার্থপর আর আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছি যে নিজেদের স্বার্থের জন্য এই বিভাজনকে আমরা যথাযথ ব্যাবহার করছি ।
সব ধর্মেরই মূলমন্ত্র কিন্তু এক, সব ধর্মের উৎপত্তির প্রধান কারণ সৃষ্টির সেবা করা অর্থাৎ মানুষের সেবা করা। যে কোন ভাল কাজ যেমন সততা, উদারতা, সহমর্মিতা, সহানুভূতি, উপকারিতা, ন্যায়পরায়ণতা ইত্যাদি সৎ গুণাবলী সব ধর্মেরই মূলকথা। অন্যদিকে মন্দ কাজ যেমন অন্যায়, অনাচার, ব্যভিচার, কঠোরতা, সংকীর্ণতা, অনৈতিক বা অপরাধ কর্ম সব ধর্মেই নিষিদ্ধ।
এত বিভেদ, হানাহানি, খুনাখুনি, মারামারি, জুলুম,অত্যাচার, বিশৃঙ্খলার মধ্যে আজ আমরা দিশেহারা এবং হতাশাগ্রস্ত। আজকাল আমরা এতটাই স্বার্থপর আর আত্মকেন্দ্রিক যে শুধু নিজেদের প্রয়োজনেই প্রতিবাদ করি, মানবিকতার জন্য নয়। আজ আর আমরা অন্যের সুখে হাসি না, কারো কষ্ট দেখে কাঁদি না, রাস্তায় রক্তাক্ত মানুষ পড়ে থাকতে দেখলেও পাশ কাটিয়ে চলে আসি। আমাদের কাছে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোষ্ঠী, অঞ্চল, দেশ , স্বর্গ–নরক এত বেশী বড় ব্যাপার যে মানবতা আজ বড়ই বিপন্ন । আমরা একদল আরেক দলের উপর আক্রমণ করি, নির্মমভাবে হত্যা করি, একদল ভাঙ্গি অন্য দলের উপাসনালয়, সুযোগ পেলেই সামান্য কারণে দাঙ্গা বাধাই, অত্যাচার করি আর সুযোগের সন্ধানে থাকি কিভাবে অন্য ধর্মকে নিশ্চিহ্ন করে নিজের ধর্মের ধ্বজা সবার উপরে প্রতিস্থাপন করতে পারি।
কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি সব ধর্মেই নিষেধ আর এই বাড়াবাড়ি মানুষকে ধ্বংস আর মৃত্যু ছাড়া কিছুই এনে দেয় না। ধ্বংসের জন্য বা অশান্তির জন্য নিশ্চয় ধর্ম পালন করা হয় না বরঞ্চ সুশৃঙ্খল আর নৈতিকতার ভেতর দিয়ে জীবন পরিচালনা করার জন্যই ধর্ম, শান্তির জন্যই ধর্ম।
ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধ্বে যেয়ে বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষার নামই মনুষ্যত্ব। এত ধর্ম নিয়ে পার্থক্য, গোঁড়ামি আর মাতামাতি করলে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ কখনই দূর হবে না। যেহেতু প্রত্যেক ধর্মের মূল মন্ত্র মানুষের কল্যাণে কাজ করা আর মানুষকে ভালবাসা, তাই আমাদেরও উচিত সঠিক ধর্ম চর্চার মাধ্যমে জনকল্যাণকর কাজে নিজেকে নিয়োজিত করা।
আমরা বলি মুসলমান মারিস না, হিন্দু মারিস না, বৌদ্ধ মারিস না, খ্রিষ্টান মারিস না…
সাঁওতাল মারিস না, রোহিঙ্গা মারিস না, বাঙ্গালী মারিস না…
ধর্ম, বর্ণ, জাতি, ও গোষ্ঠী–গত বিভাজন ভুলে যেয়ে কেন আমরা সমস্বরে বলি না “ওরে মানুষ দোহাই তোরা আর মানুষ মারিস না…”