ধর্মীয় পরিচয় বৃত্তের বাইরে আসুন, প্রতিবাদ করুন

রাহিমা আক্তার: নাসিরনগরের হামলার কোনো বিচার এখনও হয়নি, উল্টা সারাদেশে একের পর এক জেলায় প্রতিমা ভাংচুর, প্রতিমা চুরি, আগ্রাসীভাবেই চলছে। আইন যেখানে নীরব, সেখানে এছাড়া আর কী আশা করা যায়।

যেখানে একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রীর মুখ থেকেই কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য শোনা যায়, তার অনুসারীরা অন্যদের প্রতিবাদ করতে বাধা দেয়, তখন সেই দেশে আর যাই থাক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নেই, নেই অন্য কোন ধর্মের মানুষের নিরাপত্তাএখানে দিনের মতোই পরিস্কার যে দেশে অন্য সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন আর নিপীড়ন কোন পর্যায়ে আছে।   

attack-6একটা ছবিতেই যাদের ধর্মানুভূতি ভেঙ্গে পড়ে, তাদের আসলে কোন ধর্মই নেই। এতোটাই ঠুনকো কেন আপনার ধর্ম বিশ্বাস, যে কাবার ওপর শিবের বসা ছবি দেখলেই সেই কাবা ভেঙ্গে পড়ার ভয়ে আপনি অস্থির হয়ে উঠেন?

একইভাবে সন্ধ্যা আরতির সময় আ্জানের ধ্বনি শুনলেই যদি আপনার ভেতরের দেবতা অসন্তুষ্ট হয়ে উঠে, মনে হয় যে আরতি ভেস্তে গেল, তাহলে ওরকম ধর্মচর্চার আপনাদের দরকার নেই। যে ধর্ম আপনার ভেতরে কোন সুচিন্তা, মানবিকতার ছায়াও ফেলতে পারেনি, তেমন ধর্মানুভূতি আপনার থাকা না থাকার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই

কারণ কোনো ধর্মই আসলে কাউকে অমানবিক হতে বলেনি, আর খুন, হত্যা, রাহাজানির কোন আশ্রয় নেই কোন ধর্মাদর্শেইসবার ওপরেই মানব ধর্ম। আমরা সবাই যেহেতু জন্মসূত্রে মুসলমান বা হিন্দু, তাই নিজেই কতদিন ভেবেছি, আচ্ছা আমি যদি খ্রিস্টানের ঘরে জন্মাতাম, তাহলে তো আমিও খ্রিস্টান হতাম আর তাহলে কি ঐ চার্চ আমার কাছে হত সবচেয়ে পবিত্র, কিংবা হিন্দুর ঘরে জন্মালে হতাম হিন্দু আর মন্দির হয়ে যেত আমার সবকিছুর ঊর্ধ্বে? জন্মই যদি আমার ধর্ম নির্ধারন করে দেয় তাহলে আমি কে অন্য ধর্মকে আঘাত করার?  

পারিবারিকভাবেই ধর্মটা মানুষ পেয়ে যায়, তাই পরিবারেরও অনেক দায়িত্ব থাকেসে দায়িত্ব হলো সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই শিক্ষা দেয়া যে, কেবল নিজ ধর্ম নয়, সকল ধর্মকেই সম্মান করতে হবে, ধর্ম-জাত-বংশ-কুল ভেদাভেদ ভুলে মানুষকে শ্রদ্ধা করতে। পরিবার যখন শেখাতে পারে না, তখন আপনি পরিবারের গোড়ামি ধরেই উগ্র হয়ে যান। তাই একইভাবে কেউ ইসলামকে অবমাননা করেন আর কেউ বা করেন হিন্দু, বা খ্রিস্টান  ধর্মকে, কেবল রাষ্ট্রভেদে আলাদা আলাদা স্বরূপ

attack-4দেশে আসলে পরিবার যেমন পারছে না এই ধর্মীয় পরমত সহিষ্ণুতা দিতে, তেমনি পারছে না শিক্ষাঙ্গনপারলে প্রতিদিনের এই চিত্র দেখতে হতো না। আর সবচেয়ে বড় কথা, রাষ্ট্র যদি বারবার তার নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আমাদের আর থাকে কী?

একবার তাকান কাছের রাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের দিকে। ছোট্ট একটা দেশ, অথচ সেখানে রয়েছে অদ্ভুত রকমের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। রাষ্ট্র আর জনগণ সিঙ্গাপুরে রীতিমতো এ ব্যাপারটা উদযাপন করে যে, তাদের দেশে বর্ণ-গোত্র-ধর্ম সবকিছু ছাপিয়ে সর্বোচ্চ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রয়েছে। ২০০২ সালে দেশটিতে  “Declaration of Religious Harmony” ঘোষণা করেছেএছাড়া দেশটিতে আছে “Inter Riligious Organisation (IRO)” IRO এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিভিন্ন কম্যুনিটি আর ধর্মের মধ্যে পারস্পারিক শ্রদ্ধা, সহযোগিতা আর সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং ভিন্ন ধর্মাবলম্বি নেতাদের মাঝে সহযোগিতা-বন্ধুত্বের মাধ্যমে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা। এ সংগঠনটি দশটি ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে আর সেই ১৯৪৯ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে আর যার ফলশ্রুতিতে ২০১৪ সালে করা “”Global Religious Diversity” জরিপে ২৩২টি দেশের মধ্যে সিঙ্গাপুর প্রথম অবস্থানে ছিল।

আমরা আসলে কোনো দেশ থেকে কোনো শিক্ষাই নিতে পারিনা। তা না হলে একের পর এক ঘটনা দেশের ভেতর অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতো না। প্রকৃতপক্ষে, রাষ্ট্র যদি নিরাপত্তার ভার না নেয় তাহলে সামগ্রিক সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়।                  

এতো গেল সিঙ্গাপুরের কথা, এবার আসি ইউরোপের জার্মানিতে। ধর্মীয় বাক-স্বাধীনতায় জার্মানি অন্য অনেক অনেক দেশের চাইতে এগিয়ে। জার্মানির কার্টুনিস্ট ‘মারিও লার্স’ যিশুখ্রিস্টকে নিয়ে এক ব্যাঙ্গাত্বক কার্টুন এঁকেছিল যা প্রদর্শিত হয়েছিল ২০১২ সালে আর কার্টুনটা খোদ যিশুর জন্ম নিয়ে ব্যঙ্গ করেই তৈরি হয়েছিল।

কার্টুনটির মুল বক্তব্য ছিল, যিশুখ্রিস্টকে কোন অদৃশ্য গড বলছেন, “হেই আমি তোমার মাকে ‘…’ করেছি”। যিশুখ্রিস্টের জন্ম আর মা মেরির কুমারিত্বের প্রেক্ষাপটকে ব্যঙ্গ করেই এই কার্টুনকার্টুনটি বোঝাচ্ছে যে অদৃশ্য গডের সাথে তার মায়ের শারিরিক সম্পর্কের ফলেই তার জন্ম, ‘কুমারি’ মেরির সন্তান সে নয়

rahima
রাহিমা আক্তার

চার্চগুলো একটু সরব হয়ে উঠেছিল সেই কার্টুন নিয়ে। কিন্তু কোথাও ভাংচুর তো দূরে থাক, একটা অশ্রাব্য কথাও শোনা যায়নি, কারণ একটি কার্টুন তাদের ধর্মকে নিচে নামিয়ে সম্ভ্রম লুটতে পারেনি, তাদের কাছে তাদের ধর্ম অতটা ঠুনকো নয় যতটা আপনাদেরএখানে মানুষের ভেতর মনুষ্যত্ববোধ আছে যা আপনাদের নেই। কেউ যদি কোনভাবে অন্য ধর্মকে নিয়ে কোন অসম্মানজনক কিছু করে তবে তার প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে, কিন্তু একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে শত মানুষের ওপর আঘাত হেনে ঘরবাড়ি লুটপাট হবে? একইভাবে কেউ দুর্গার মুর্তির মাথায় মসজিদের ছবি টাঙ্গিয়ে রাখলে সাথে সাথে শখানেক মসজিদ ভাঙ্গার পক্ষেও নই আমি।

এ দেশে যেমনি আমার ধর্ম চর্চার অধিকার আছে তেমনি আছে প্রতিটা মানুষের। আর সেটা সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘুতে আটকে থেকে নয়, কারণ দেশটাতে প্রতিটা মানুষেরই রয়েছে সমান অধিকার তা সে যে ধর্মেরই হোক না কেন মুখোশধারি ধর্মানুভুতির জন্য নয় আসুন আমরা একসাথে যার যার জায়গা থেকে এই উগ্র ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই, প্রতিবাদ করি। রাষ্ট্র যদি দায় না নেয়, মন্ত্রীদের মুখ থেকে যদি কুরুচিপূর্ণ কথা শোনা যায়, তাহলে প্রতিবার আমাদেরই করতে হবে। নিজেদের দেশের স্বার্থেই সেই দায় এড়াতে পারি না, নাকি পারি?

এই ভিনদেশে থেকেও আমি নিজেকে নিরাপদ মনে করতে পারি, এই পরদেশকেও আপন লাগে আজকাল, এখানে আমার নিজের নিরাপত্তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। অথচ আমার নিজের বন্ধুরা নিজের দেশে রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারছে না, নিজ দেশেই তারা সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ!

ভাবতেই ভেতরে অস্থির লাগে, বড্ড বেশী অপরাধী মনে হয় নিজেকে। অনেক বেশি গ্লানি কাজ করে ভেতরেকবে আসবে সুদিন, যেদিন দেখবো মানুষ কেবল তার ধর্মীয় পরিচয়কেই বড় করে দেখবে না, ঐ পরিচয় বৃত্তের বাইরে এসে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সবাই পথ চলবে! কোন সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু পরিচয় নয়, ধর্মের নামে আমাদের দেশে হরিলুট-খুন হবে না, উদ্বাস্তু হবে না কেউ, বরং উৎসবে-পালা পার্বনে সব ধর্মের সব মানুষ মিলেমিশে উদযাপন করবে, ধর্ম হবে যার যার আর রাষ্ট্র হবে সবারসোনালী দিন আসতেই হবে যেদিন পারিবারিকভাবে প্রাপ্ত ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে এসে সবাই এক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়বে যেখানে ধর্মই প্রধান পরিচয় হবে না, “বাঙালী” হবে আমাদের প্রধান পরিচয়

আসুন, প্রতিবাদে প্রতিরোধে সোচ্চার হই উগ্র ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে, নইলে উগ্র ধর্মান্ধরাই জয়ী হবে আর ব্যর্থ জাতি হিসেবে আমাদের মনুষ্যত্ব ধুলায় লুটাবেআমরা নিশ্চয়ই এ দেশকে আরেকটি আফগানিস্তান হতে হতে দিতে পারি না                 

ভুর্জবুর্গ, জার্মানি থেকে

শেয়ার করুন: