কী করে ভুলে থাকি ওই মরার দেশটাকে!

ফারজানা আকসা জহুরা: সেদিন এক ভাইয়ের ফেসবুক স্ট্যাটাস পড়েছিলাম।  ভাইটি তার প্রিয় বন্ধুর বিয়েতে যাবেন বলে বিদেশ হতে বাংলাদেশ গিয়েছিলেন, কিন্তু হরতাল আর জ্বালাও-পোড়াও এর কারণে তিনি আর বন্ধুর বিয়েতে উপস্থিত হতে পারলেন না! বন্ধুকে তিনি মিথ্যা বললেন যে, তিনি বাংলাদেশে যেতে পারেননি।

farzana-akhsha
ফারজানা আকসা জহুরা

লেখাটি পড়ে বেশ কিছু কথা মনে পড়ে গেলো….

সম্ভবত: ওটা ছিলো ২০১৩ সালের নভেম্বর। ঐ মাসটা আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের একটি মাস। দেশে তখন হরতাল আর জ্বালাও-পোড়াও চলছিল। আমি তখন আমার মৃত্যু পথযাত্রী মায়ের জন্য প্রতিদিন ভোরে রান্না করে মিরপুর হতে শাহবাগ যেতাম। প্রেগনেন্সি অবস্থায় ঘন্টার পর ঘন্টা বাসের জন্য অপেক্ষা…কিছু পথ বাসে… কিছু পথ রিক্সায়… আর বাকি পথটা হাঁটতে কেমন লাগতো? তার উপর হাতে থাকতো আম্মুর খাবার ও সারাদিনের খাবার পানি।

মাথায় তখন একটাই চিন্তা কাজ করতো, “বাচ্চা গেলে বাচ্চা পাবো… মা গেলে আর মা পাবো না”। তাছাড়া আরো অনেক দুশ্চিন্তাও ছিলো! তখন আমার অনার্স পড়ুয়া বোনটি সংসারের জন্য চাকরি শুরু করেছে।  সেই হরতাল আর জ্বালাও-পোড়াও এর মধ্য দিয়েই সে প্রতিদিন ভোরে হাসপাতাল থেকে অফিসের উদ্দেশ্য বের হতো, ফিরতো রাত ৮/৯টার মধ্যে।

৮টায় ডাক্তার আসতো রুগী দেখতে….. আমি না থাকলে কিছুই জানা যাবে না যে ডাক্তার কী বুঝলেন!

বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলির যে কী অবস্থা, তা যারা যায়, তারাই জানেনl তাও কপাল ভালো, ঘুষ দিয়ে আম্মুকে ভর্তি করাতে পেরেছিলাম। বেসরকারিতে চিকিৎসা করানোর ক্ষমতা আমাদের মতোন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির  নাই। যাই হোক, ঐ জ্বালাও-পোড়াও এর মধ্যেই আমরা দুই বোন জানটা হাতে নিয়ে প্রতিদিন … দুই দিক দিয়ে বের হতাম!  অবশেষে ডাক্তার আর রোগ ধরতে পারলেন না।  যেদিন মা’টা মারা যায়, সেটা ছিল ডিসেম্বরের ২ তারিখ।  

দীর্ঘ এক মাস আমার বড় বোন শত চেষ্টা করেও, হরতাল আর জ্বালাও-পোড়াও এর কারণে ঢাকায় আসতে পারেনি। তাই আম্মুর মৃত্যুর খবর শুনে আর থাকতে পারলো না,  কিন্তু ভাগ্যের কী পরিহাস ওইদিন রাজাকার নিজামীর ফাঁসির রায় হলো! দেশে তখন এমন এক হিংস্র রুপ দেখা দিলো যে, আমার বড় বোন আর দুলাভাইকে এক প্রকার কাফনের কাপড় মাথায় নিয়ে ঘর থেকে বের হতে হলো। পাবনা পর্যন্ত আসার পর তারা আর আসতে পারলো না, কারণ ট্রেনের পাটি অন্যদল উপড়ে ফেলেছে …. অন্য কোনো গাড়িও পেল না তারা, এতো রাস্তা তো দুইটা বাচ্চা নিয়ে হাঁটাও যায় না! আমার বড় বোন তার মায়ের মরা লাশটাও দেখতে পারলো না। দুলাভাই চিৎকার দিয়ে হাউমাউ করে কেন্দে কেন্দে বললেন , “আমি আমার খালাকে কবরও দিতে পারলাম না, আশা…. এমনই একটা মরার দেশে বাস করি আমরা।”

ফেসবুকের ঐ ভাইটি শুধু তার প্রিয় বন্ধুর বিয়েতে যেতে পারেনি, হয়তো পরে তার সাথে দেখা হবে তখন ভাইটির আর সেই কষ্টটা থাকবে না। কিন্তু আমাদের মতোন যারা, তাদের কষ্ট কোনোদিনও ভোলার না।

রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করেন , আর কষ্ট পায় আমরা … সাধারণ জনগণ l তারা আমাদের উন্নয়নের পাঠ পড়ান … স্বপ্ন দেখান , আর শাসনের সাথে সাথে শোষণও করেন l আমরা শুধুই কাঁদি…. আর ভাবি, সবই কপালের দোষ, আর এটাই বাংলাদেশের মতন দেশগুলির নিয়ম।

Hartal-Agunহরতাল জ্বালাও-পোড়াও করে রাজনীতিবিদের তো কোনো ক্ষতি হয় না, যা হওয়ার আমাদেরই হয়। আবার উন্নয়নের নামে রাষ্ট্রীয় সফর… সংবর্ধনা, ইত্যাদিতে আমাদের কী লাভ হয় জানি না, কিন্তু যা যাওয়ার তা চিরকালের জন্য চলে যায় আমাদের জীবন থেকে। আমাদের জীবন যে খুবই সস্তা! আমজনতা আসলেই আম, তাদের চুষে ফেলে দেয়া যায়।

এতোকিছুর পরও আমরা দেশকে খুব ভালোবাসি, কিন্তু ঐ দেশটা শুধুই ক্ষমতাবান আর ধনীদের জন্য। বিদেশে সুইপার হয়েও মানুষ যে মানুষের মর্যাদা পেয়ে বেঁচে থাকতে পারে, বাংলাদেশে কোনো সৎ অফিসারও তা পারেন না।

আমার মেজো বোন মাঝে মধ্যে বলে, “আশা, খুব ভালো আছিসরে, প্রতিদিন খুন-হত্যা-ধর্ষণ আর যানজটে অতিষ্ঠ এই জীবন, তার উপর অন্যান্য সমস্যা তো আছেই। বেঁচে থাকাই যে এখানে বড় দায় রে, খুব ভালো আছিস তুই। আসতে হবে না তোকে এই মরার দেশে”।

আমি ভাবি, সত্যই তো আমি তো অনেক ভালো আছি। এখানে চিকিৎসার নিরাপত্তা আছে, খাদ্যের মান সর্বোচ্চ, রাস্তায় চলাফেরায় নিয়ম আছে, কিন্তু কোনো নিষেধ নেই, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড জনজীবনকে বাধাগ্রস্ত করে না। এইতো সেদিন প্যারিস বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন হলো, কই তাতে তো জনজীবন থেমে পড়েনি। বিশ্বের সব বড় বড় রাষ্ট্র প্রধানদের নিয়ে আসা হলো প্যারিসের বাইরে ছোটো একটি শহর বুঁজেতে ( Bourget)।

কেন? যাতে জনগণের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড থেমে না পড়ে। এই রকম কত শত নাগরিক সুবিধা ভোগ করি আমরা! তবুও কি ভালো আছি আমি? মনটা পড়ে থাকে ঐ মরার দেশে।
ওই মরার দেশে যে আমার ভাইবোন থাকে, ওই মরার দেশে যে আমার প্রাণের বন্ধুরা থাকে, ওই মরার দেশে যে আমার বাবা-মা ঘুমিয়ে আছে, তাহলে কেমনে ভুলে থাকি ওই দেশটাকে? ওই দেশটাই যে আমার মা।

শেয়ার করুন: