মোজাফফর হোসেন: আমার মা চার ছেলে আর আট কন্যা সন্তানের জননী। নয়জন সন্তান তিনি পেটে ধরেছিলেন। আর মাতৃহারা তিন কন্যা তিনি পেয়েছেন বাবার আগের পক্ষের স্ত্রী থেকে। মা যখন বাবার সংসারে আসেন তখন তাঁর বয়স ১৩ বছর, বাবার বড় মেয়ের ১০ বছর।
কিশোরীকালেই ‘মা’ হয়ে গেলেন প্রায় কাছাকাছি বয়সী তিন মেয়ের। নিজের সন্তান জন্ম পেটে ধরার আগে তিনি শাশুড়িও হয়ে গেলেন। (মা তাদের এতোটাই আপন করে নিলেন যে আমরা কখনোই ভাইবোন হিসেবে আলাদা হতে পারিনি।) এরপর মা নিজে পরপর চার মেয়ে সন্তানের মা হলেন। আগের তিন মেয়ের পরে আবার মেয়ে সন্তানের জননী হওয়াতে আমার নানী ও বাবা মোটেও খুশি হননি। আমার পূর্ব-মায়েদের মেয়ে সন্তান জন্ম দেওয়ার সামাজিক ‘পাপ’ মায়ের সঙ্গে যুক্ত হলো। মেয়ে সন্তান হয়েছে শুনে বাবা মাসের পর মাস মা এবং নতুন শিশুকে নানাবাড়ি দেখতে যাননি। আমার দাদি গালি আর অভিশাপ দিয়েছেন। মা অসীম ধৈর্য নিয়ে ফিরে এসেছেন সংসারে।
সেই মায়ের সন্তান আমি।
আমার মা মুখ ভার করে সন্ধ্যার পর কলপাড়ে বসে থাকতেন। আমরা সবাই রাতের খাওয়া সেরে উপরতলায় উঠে যেতাম। মা থালাবাসন ধুয়ে-মেজে, উঠোনের কোণে চুলাটা গোবর ভিজিয়ে লেপে, বাবার ফজরের ওজুর পানি রোয়াকে রেখে, বাড়ির কুকুরটার সঙ্গে কলেরপাড়ে বসে থাকতেন আরো কিছুটা সময়। নিজের ছায়ার সঙ্গে বসে তাঁর বাবার গল্প করতেন। আমার প্রয়াত নানা দেশভাগের পর ভারতে বিশাল বাড়ি-জমিজমা ছেড়ে খালি হাতে বাংলাদেশে চলে আসেন। ওপারে সঞ্চয়ের সঙ্গে সঙ্গে রেখে আসেন এক মেয়েকেও। আমার নানা-নানী দুজনেই ভুলতে পারেননি ওপারে রেখে আসা তাঁদের বাবা-মায়ের ভিটেমাটির কথা, মেয়ের কথা। মা তাঁর বাবা-মায়ের সেই পুরানো কষ্ট মেখে টিউবওয়েলের পাশে বসে থাকতেন।

সেই মায়ের সন্তান আমি।
আমার মা সম্পূর্ণ বিশ্বাসী এবং নামাজি ছিলেন। বাড়িভর্তি লোকজনকে রান্না করে খাওয়াতে খাওয়াতে প্রায়ই দুপুরের পর বিকেলও গড়িয়ে যেত। মা হাতের কাজ রেখে, অতিথি বসিয়ে রেখে নামাজে যেতেন না। বাবা নামাজ আদায়ের কথা বললে, বলতেন, নামাজ পড়ে নিয়েছি অন্তর দিয়ে। মা চরিত্রহীন মানুষদের একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। চরিত্রহীনতার কারণে পাড়ার অনেক ঘরের সঙ্গে আমাদের ঠিকমতো মেলামেশা ছিল না। আমাদের বাড়ি আসা তাদের অলিখিত বারণ ছিল। কিন্তু দেখেছি গুচ্ছগ্রামের মাঝবয়সী এক নারী (যাকে গ্রামে সকলে বেশ্যা বলতো) প্রায়ই আমাদের বাড়ি এসে মায়ের কাছ থেকে চাল-ডাল নিয়ে যেত তার অভুক্ত শিশুদের জন্য।
সেই মায়ের সন্তান আমি।
গাঁয়ে একঘর হিন্দু ছিল, (তথাকথিত) নিচু জাতের। টিকে থাকা মুশকিল হচ্ছিলো। রাতের অন্ধকারে দেখেছি, মা তাদের বাড়িতে চালডাল পাঠাতেন। একবার বাড়ির পাশে শান-বাঁধানো পুকুরপাড়ে পাকুরগাছের নিচে বসে থাকতে দেখা গেলো এক পাগল-গোছের বৃদ্ধকে। মা ওঁকে আমাদের বৈঠকখানায় বসিয়ে ভাত খাওয়ালেন। সন্ধ্যায় গ্রামে রটে গেল, ভারত থেকে স্পাই এসেছে। ভারত তখন আমাদের কাছে হিন্দুরাষ্ট্র। সবাই সিদ্ধান্ত নিলো ওর পোশাক খুলে দেখবে, কোনো গোপন নথি আছে কিনা। মায়ের কড়া আদেশ, সকাল পর্যন্ত ওর গায়ে কেউ হাত দেবে না। সকালে পুলিশ ডেকে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। ভোরে উঠে দেখা গেল, বৈঠকখানা ফাঁকা পড়ে। মায়ের চোখে-মুখে প্রশান্তি দেখে বুঝতে বাকি রইল না কিছুই।
একবার আমাদের নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত মৌলানা জুম্মার খুতবায় বললেন, মুসলমান দেশে হিঁদুদের লেখা পড়ানো হয় স্কুলে! এর প্রতিবাদ হওয়া উচিত। এর পরদিন মা আমাকে শহরে এক হিন্দুধর্মাবলম্বী শিক্ষকের বাড়ি প্রাইভেট পড়তে পাঠালেন। সন্তানতুল্য সেই শিক্ষককে বাড়িতে দাওয়াত করে খাওয়াতে খাওয়াতে বললেন, ছেলে তোমাকে দিয়ে দিলাম। ও তোমার ছোট-ভাইয়ের মতো। ওকে শিক্ষা দিয়ে মানুষ করে তোলো। সেই শিক্ষক আজ আমার বড়ভাই, আমার সবচেয়ে কাছের মানুষের একজন।
এই আমার মা।
গাঁয়ে দুজন অসফল ব্যবসায়ী ছিল, মওলা আর সামাদ। মা সঞ্চিত টাকা এদুজনকে ভাগ করে দিলেন কারবার করতে। বাবাকে গোপন রেখে। যথারীতি ওদের ব্যবসা ফ্লপ। মওলা ছিল মিষ্টি ব্যবসায়ী। মার টাকা ফেরত দিতে পারছে না যেনে ওর দোকান থেকে বিনামূল্যে মিষ্টি এনে খাওয়া শুরু করলাম, যখন-তখন। পরে শুনেছি সেই মিষ্টির দাম মা হিসাব করে শোধ করে দিয়েছেন। বাড়িতে প্রায়ই এটাসেটা চুরি হতো। মা জানতো কোন বাড়ির চোর চুরি করেছে। কখনো বাড়িতে এ নিয়ে হৈচৈ করতেন না। একবার কয়েক বস্তা ধানচুরি হয়ে গেলে মা ওদের বাড়ি গিয়ে কেবল বলেছিলেন, ‘বস্তাগুলান দিস। ভাগিদাররা ধান দিয়ে যাবে, রাখার মতো কিছু নেই।’
আমার জন্মের আগে বাড়ির কাজের মেয়েটির একশিশু হয়। গায়ে পাঁচড়া ঘা নিয়ে। জন্মের সাতদিনে মারা গেল শিশুটির মা। কেউ আর ঐ বাচ্চার দায়িত্ব নিতে চায় না। তখন আমার বড়বোন মায়ের কোলে। মা ওই শিশুটিকে বুকে তুলে নিলেন। ঘা-পাঁচড়া ধুয়ে-মুছে চিকিৎসা করালেন। কিন্তু মাসখানেক পর চলে গেল শিশুটি। মা যখন ওর গল্প করতো, তখন চোখে জল ছলছল করতো।
এই আমার মা।
বোনদের শিক্ষার ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন আমার স্কুলমাস্টার বাবা। প্রাইমারি-পাশ মা জোর করে নিজে টাকা সঞ্চয় করে খাতা-কলম-টিউশন ফিস জোগাড় করে মেয়েদের মাধ্যমিক পাশ করিয়েছেন। ছেলে-মেয়েতে, নারী-পুরুষে কোনো বিভেদ মা কোনোদিনই মানেননি।
এই আমার মা।
আমার বুদ্ধি যখন পাকতে শুরু করল, তখনই আমার মাথায় চারপাশ থেকে পুশ করা শুরু হল, পাকিস্তান থাকলেই বাংলাদেশের ভালো হত। মুক্তিযুদ্ধ করাটা আসলে দেশদ্রোহী, ইসলামবিদ্বেসী মানুষদের কাজ। মাকে সে কথা বললে, বললেন আমাকে—‘আমি মাত্র ১২ সন্তানের মা। আর এই দেশটা কোটি কোটি সন্তানের মা। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল এই মহান মাকে রক্ষা করতে। মুক্তিযোদ্ধারা শুধু নিজের মা নয়, এই কোটি কোটি সন্তানের মাকে বাঁচাতে যুদ্ধ করেছে। আর পাকিস্তান যুদ্ধ করেছে দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখতে। জুলুম-শোষণ চালু রাখতে। কোন যুদ্ধটা ন্যায়ের তবে?’ এরপর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আর কোনো মিথ্যা আমার ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি।
এই আমার মা।
বাবা সাংসারিক মানুষ ছিলেন না। মাকেই অত বড় পরিবারের সবকিছু সামলাতে হতো। যতো ঝুট-ঝামেলা, সবই। এরই মধ্যে নিজের সঞ্চয় থেকে গোপনে এক চাচার সহযোগিতায় আমাদের জন্য মেহেরপুর জেলা শহরে জমি কিনলেন। বাবার পেছনে লেগে থেকে দোতলা বাড়িও উঠালেন। কত বড় যে কাজ করেছিলেন আজ সেটা বুঝি। নিজের আসন্ন মৃত্যু সম্পর্কে জেনে বাড়ি-ঘর, জমিজমা সব ভাগ বাটোয়ারা করে দিলেন যেন তার মৃত্যুর পর ভাইদের মধ্যে এ নিয়ে ঝামেলা না হয়, বোনরা না ঠকে, বিশেষ করে আগের পক্ষের মেয়েরা।
মৃত্যুর তিনদিন আগের রাতে মা আমাকে ডেকে তার গোপন ড্রয়ারের চাবি দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার সময় হয়েছে। ড্রয়ারে কিছু টাকা আছে। তোর আর খালিদের (আমার ছোটভাই) হাতখরচের জন্য। আমার মৃত্যুর পর তোদের ছোটখাটো চাহিদা পূরণ করতে কারো কাছে চাইতে হবে না। বাবা যেন ঐ টাকার কথা না জানতে পারে, তাহলে খরচ করে ফেলবে অন্য কাজে।’ মা মারা গেলে ড্রয়ার খুলে লাখ-খানেক টাকা পেয়েছিলাম ক্যাশ, আর ব্যাংকে ছিল লাখ দুয়েক। আমাদের ছোট দুইভায়ের অর্থনৈতিক কোনো সমস্যা হয়নি এই কারণে।

[এক্ষেত্রে বাবাও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছেন। আজ বাবাও নেই। তাঁর প্রতি অসীম শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।]
খুব সাধারণ আমার মা–বেটে, অতিসাধারণ দেখতে। গাঁয়ের শত শত মায়ের মাঝে আলাদা করা যাবে না তাঁকে। সেই কারণে পথেঘাটে যে কোনো মায়ের দিকে তাকালে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। এই অতি সাধারণ মায়ের জানাজায় মানুষ ভেঙে পড়েছিল সেদিন। যেন এলাকার বিশিষ্ট কোনো ব্যক্তির জানাজা হচ্ছে। বেশিরভাগ মানুষ ছিল খেটেখাওয়া, দিনমজুর। তাদের বৌ-মায়েরা এখনো আমি গাঁয়ে গেলে মায়ের কথা বলতে ছুটে আসে। কেউ কেউ অসহায়ের মতো কাঁদে। গাঁয়ের দোতলা শ্যাওলা পড়ে, কোথাও কোথাও দেয়াল খসে পড়া বাড়িটার চারপাশে ঘুরে ঘুরে ফিরে আসি। এইখানে কোনো এককালে একটা আটচালা টিনের ঘর ছিল। মা নিজে সঞ্চয় করে বাবার পেছনে লেগে থেকে এই বাড়িটা গড়েন। কত পরিশ্রম-সাধনা, কত অশ্রু-ত্যাগ তাঁর লুকিয়ে আছে এই খসে পড়া চুনসুড়কির গাঁথুনির ভেতর।
এই আমার মা।
আজ আর মা নেই সশরীরে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, মায়ের সেই আত্মত্যাগ, সহিষ্ণুতা, মানবিকতা, দেশাত্মবোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা একটা শক্তি হিসেবে কোথাও না কোথাও রয়ে গেছে। আমি সেই শক্তির যতটা সম্ভব কাছে যেতে চাই। দেহের ভেতরে-বাইরে মাখতে চাই। এ জীবনে আমার দ্বিতীয় কোনো সাধনা নেই। লেখালেখি সেই ‘শক্তি’-সাধনার একটা অবলম্বন হিসেবে আমার কাছে এসেছে।