বারবার ফিরে আসে বেদনার হানিমুন

জেসমিন চৌধুরী: আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করেন, আপনার নতুন নাটকের নাম ‘মায়াজ হানিমুনস’ কেন? একটা মানুষের কয়টা হানিমুন হতে পারে? নাকি আপনার নায়িকা মায়াও আপনার মত একাধিকবার বিয়ে করেছে, তাই তার একাধিক হানিমুন হয়েছে?

যাদের জীবন শুরু থেকে একই সুরে বয়ে যায়, তাদের হয়তো হানিমুন একবারই হয়, কিন্তু মায়াদের জীবনে হানিমুন আসে ঘুরে-ফিরে বারবার, যার একটাও সুখের হয় না। একটা এবিউসিভ সম্পর্কে কয়েকটা ধাপ ঘুরে ফিরে আসে- নির্যাতন, হানিমুন বা আহ্লাদ, কিছুদিন শান্তি, আবার অশান্তি, আবার নির্যাতন। এধরনের সম্পর্কে সত্যিকারের হানিমুন হয়না একটাও।

jesmin-3
জেসমিন চৌধুরী

গতকাল আরেকজন মায়ার সাথে দেখা। বছরের প্রথম তুষারপাত, সেই সাথে বৃষ্টি আর বাতাসের সাথে যুদ্ধ করে হাজির হলাম কন্টাক্ট সেন্টারে। রিসেপশনে নিজের নাম পরিচয় লিখতে লিখতেই এসে ঢুকলো মিষ্টি চেহারার কম বয়েসি মেয়েটা। কোথায় যেন দেখেছি তাকে? কাছে এসে বলল, ‘আপা আমাকে চিনতে পারেননি? আপনি আমার কোর্ট কেইসে ইন্টারপ্রিটিং করেছিলেন।’

তার ওড়নার আড়ালে মুখ ঢাকার চেষ্টা করছে পাঁচ/ছয় বছরের একটা ছেলে, চোখে মুখে ভীত সন্ত্রস্ত দৃষ্টি। মেয়েটার সাথে শেষ দেখা হবার পর প্রায় তিন বছর কেটে গেছে, বাচ্চাটা অনেক বড় হয়ে গেছে।

‘ও কি আমাকে ভয় পাচ্ছে? বাচ্চারা এমনিতে আমাকে পছন্দ করে।’

‘আপনাকে না আপা, ওর বাবার সাথে দেখা করতে এলে ও এরকম করে।’

এদেশে আলাদা হয়ে যাওয়া মাবাবার বাচ্চাদের সাথে দেখা করার বিষয়টা বেশ জটিল হয়ে উঠতে পারে। পারস্পরিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে আলাদা হলে তারা নিজেদের মধ্যে সবকিছু সুন্দর ভাবে ব্যবস্থা করে নেন, কিন্তু পারিবারিক দাঙ্গা হাংগামা বা কোর্ট কেইস করে আলাদা হলে কিছুই আর সহজ থাকে না।

কাফকাস নামে একটা সরকারী এডভাইজারি সংগঠন জড়িত হয়ে পড়ে তখন। তারা মধ্যস্থতার মাধ্যমে মাবাবার সাথে বাচ্চাদের দেখাসাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেয়। একটা নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে একজন কাফকাস অফিসারের তত্ত্ববধানে নিয়মিত সাক্ষাত ঘটে। যে বাবা মাকে পিটিয়ে লাশ বানিয়ে দেয়, সেই বাবারও অধিকার থাকে বাচ্চাদের সাথে দেখা করার, তাদের সাথে সম্পর্কে গড়ে তুলবার, তবে তার সাথে বাচ্চাকে একা ছাড়া হয়না কখনোই।

যা’ই হোক, এই বাচ্চাটির বাবা একটা খেলনা দিয়ে সাজানো কামরায় তার সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছেন, কিন্তু বাচ্চাকে কিছুতেই সেখানে নেয়া যাচ্ছেনা। মায়ের কোমার জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে সে। কাফকাস অফিসার তখন মা’কে বলল, আমার অধিকার নেই তোমাকে জোর করার, কিন্তু তুমি যদি তোমার ছেলের সাথে আসো, তাহলে হয়তো সে বাবার কাছে যাবে।’

কথাটা শুনেই মেয়েটার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী করবো আপা? ঐ লোকটাকে দেখলেই আমার খুব ভয় করে।’

আমি বললাম, আপনার অধিকার আছে না বলে দেয়ার। সেক্ষেত্রে আপনার ছেলের সাথে তার বাবার দেখা হবে না, সে তার বাবাকে না চিনেই বড় হবে। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে বলছি একজন খারাপ বাবার সাথেও নিয়ন্ত্রিত যোগাযোগ থাকা একটা শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন। আপনি নিরাপদ আছেন, আপনার ছেলেও নিরাপদ আছে। আমরা সবাই আপনার সাথে আছি। এই কষ্টটুকু যদি করেন, ছেলের ভবিষ্যতের জন্য ভালো হবে।’

‘আপনি আমার কাছে বসবেন কিন্তু আপা।’

আমরা সবাই গিয়ে কামরায় ঢুকলাম। বাবা লোকটা দেখতে নিতান্তই ছেলেমানুষ। বয়স বড়জোর সাতাশ/আটাশ হবে। হাঁটুর কাছে ফ্যাশন করে ছেঁড়া জিন্স, পেশিবহুল বাহুতে ড্রাগন উল্কি, গলায় মোটা সোনার চেইন, কব্জিতে অজস্র পাথর-সাঁটা ভারি দামি ঘড়িটা যেন খুলে পড়তে চাইছে। মুখে একটা অহংকার আর তৃপ্তি মিশ্রিত হাসি।

ঘরে ঢুকেই ছেলেটা মার বুকে মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দে হেঁচকি তুলে কাঁদতে শুরু করলো। সে কিছুতেই বাবার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাবে না, কথা বলাতো দুরের কথা।

মা দেয়ালের দিকে মুখ করে বসে আছে। কাফকাস অফিসার মাকে অনুরোধ করলো ফ্লোরে নেমে খেলনা দিয়ে খেলতে যাতে পরিবেশটা একটু স্বাভাবিক হয়। মেয়েটা তার অনুরোধ রাখল, কিন্তু তার খেলনা ধরা হাত দু’টো দেখলাম বাঁশপাতার মত থরথর করে কাঁপছে। আমি এরকম পরিস্থিতিতে খুব কম মেয়েকে এতোটা সহযোগিতা করতে দেখেছি। কম বয়েসি মেয়েটার জন্য কষ্টে, আদরে আমার বুকটা টনটন করে উঠল। আমার মেয়ে ইলার চেয়ে মেয়েটা বেশি হলে দুই/তিন বছরের বড় হবে।

এইভাবে কাটল দেড়টি সুদীর্ঘ ঘন্টা, নব্বুইটি ধীর-চলা মিনিট। কান্না, চিৎকার, হেঁচকি, কাফকাস অফিসারের মৃদু তিরস্কার, খেলনা আর চকোলেটের প্রলোভন, একটু বিরতি, আবার কান্না, আবার হেঁচকি।

এরই ফাঁকে বাবা তার ব্যাগ থেকে বিশাল একটা স্পাইডার ম্যান রিমোট কন্ট্রোল কার বের করে সেটা চালাতে শুরু করলেন। ছেলে আড় চোখে একবার তাকিয়ে আবার মা’র বুকে মুখ লুকালো। বাবা কাফকাস অফিসারের সাথে গল্পে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, এই গাড়িটার দাম আশি পাউন্ড। তার নিজের জন্য আরো বড় একটা কিনেছেন, সেটার দাম আরো বেশি।

উত্তেজিতভাবে রিমোট কন্ট্রোলের হ্যান্ডেল ঘুরাতে থাকা পঁচিশ বছরের এই ছেলেটির চোখ মুখের খুশির ঝিলিক আমাকে বিভ্রান্ত করে দেয়। কেন এই বিজয়ীর হাসি? ছেলেকে দেখতে পারার আনন্দ, নাকি এই কচি মেয়েটাকে আরো একবার কাবু করতে পারার সুখ?

সাক্ষাতের কষ্টকর লম্বা সময়টা শেষ পর্যন্ত পার হলো, আমরা বেরিয়ে এলাম। কাফকাস অফিসার মাকে আবারও ধন্যবাদ দিল তার সহযোগিতার জন্য, ‘I know how difficult this must be for you, but I really appreciate your courage and cooperation.’

আমি বুঝিয়ে বললাম, ‘আপনার সাহসের প্রশংসা করছে।’ সাথে সাথে বুকফাটা কান্নায় ভেংগে পড়ল মেয়েটি, আমি আমার কাজের ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ ভুলে গিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম।

একটু সামলে নিয়ে সে বললো,

‘কীসের সাহস আপা? আমার কলিজাটা সারাক্ষণ কাঁপছিল। আমার এই বাচ্চাটা পেটে থাকতে সে আমার পেটে লাথি মেরেছে, জোর করে ওষুধ খাইয়েছে বাচ্চা নষ্ট করার জন্য। আরো অনেক ধরণের নির্যাতন করেছে। আমি কিছু প্রমাণ করতে পারিনি তাই সে বাচ্চাকে দেখার অধিকার পেয়ে গেছে। আপনারা সবাই বলেন এটা আমার বাচ্চার জন্যও ভাল, আমি আপনাদের কথা শুনি, কিন্তু আমি কিছু ভুলতে পারি না আপা। আপনি ওদেরকে বলেন আরো কোন ব্যবস্থা করতে। আমি আর ঐ লোকের সাথে এক ঘরে বসতে চাই না।’

আরো একজন মায়া, আরো একটা গল্প, আরো অজস্র মধুচন্দ্রিমা। মেয়েটার জন্য একবুক কষ্ট আর কান্না নিয়ে ঘরে ফিরলাম। মনে মনে ভাবলাম, তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারি না আমি, কিন্তু তোমাদের গল্পগুলো বলে যাবো। যারা নিজেদের সেলফি-কুলফির জগতে বাস করেন, তাদেরকে জানিয়ে যাব মায়াদের কষ্টের মধুচন্দ্রিমাসমূহের কথা।

শেয়ার করুন: