তপু সৌমেন: একটা বিজ্ঞাপনের জন্য ১০ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীকে বাছাই করা হলো, কিন্তু কাউকেই জানানো হয়নি ঠিক কী হবে বা কী করতে হবে তাদেরকে। যথারীতি পরিচালক একজন, একজন করে ডাকলেন। একটা বন্ধ ঘরে লাইট, ক্যামেরার সামনে তাদেরকে বলতে বলা হলো ‘মা’ শব্দটা নিয়ে।
সবাই এক এক করে মা কী তা বলার চেষ্টা করলো, অনেককেই পাওয়া গেলো যারা আজ অবধি মা’কে একবারও “মা তোমাকে ভালোবাসি” এই কথাটি বলেনি। অনেকে আবার জানালো মাকে কখনই ধন্যবাদ দেয়া হয়নি। অনেকে মার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছে তাও জানালো। অনেকেই বলতে বলতে কান্না করছিল। ১, ২ করে ৮ নম্বরে যে ছেলেটিকে ডাকা হলো, তাকে একই কাজ করতে বলা হলো। ছেলেটি পরিচালকের নির্দেশ শুনেই কান্না করতে লাগলো, তার সে কান্না কিছুতেই থামে না।
শুটিং ইউনিটের অনেকের চোখে ততোক্ষণে জল, পরিচালক নিজেও হতবাক। আস্তে আস্তে ছেলেটি নিজেকে সামলে নিয়ে বলতে লাগলো, মা শব্দটা সে বলতেই শিখেনি, কখনোই কেউ তাঁকে সে ডাক ডাকতে বলেনি। বন্ধু যে কজন আছে তাদের কাছ থেকে জেনেছে মা কে হন, জেনেছে মা কী করতে পারেন একজন সন্তানের জন্য, জেনেছে কী শক্তি মায়ের কোলে লুকিয়ে, মায়ের গায়ের গন্ধ কেমন আজ অবধি সে নিতে পারেনি, একবারও মা মুখে তুলে একটুখানিও খাওয়াতে পারেনি। সে বড় হয়েছিল এতিমখানায়, মাকে সে পায়নি কোন দিন। ক্যামেরা চলতেই থাকলো। কারণ এই যে অনুভূতি, তার চেয়ে বাস্তব অনুভূতি আর কোন অভিনেতাই দিতে পারতো না।
“মা” শব্দটিতে কেবলমাত্র একটা অক্ষর, এর সাথে একটা যতি চিহ্ন কেবল, কিন্তু কী অদ্ভুত, কী বিশাল, কী অমূল্য অর্থ বহন করে এই ছোট্ট শব্দটি। সারা পৃথিবী জুড়ে মাকে নিয়ে লেখা গল্প, কবিতা বা সাহিত্য এতো এতো হয়েছে যে তবুও মা শব্দটার সঠিক বা পরিতৃপ্ত বর্ণনা আজ অবধি কেউ করতে পারেনি। আসলে কী, সম্ভবও না।
আমরা সাধারণত মা ডাক শিখি চার মাস বয়স থেকে আর সেই মা ডাক শেষ হয় মৃত্যুবরণ করার আগ মুহূর্তে। এই একটি ডাক পুরো জীবদ্দশায় এতোবার ডাকা হয় যে আর অন্য কোনো সম্পর্কের নাম এতো বার উচ্চারিত হয় কিনা আমি জানি না।
আমার বউ একজন মা, সে যখন গর্ভবতী আমি তখন ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি যে ও আসলে কী অনুভব করছে। ওর পরিবর্তিত ব্যবহার মেনে নিতে আমার প্রথমদিকে কষ্ট হয়েছে, আমি অভ্যস্ত ছিলাম না। কিন্তু যতোই দিন যাচ্ছিল আর ওর পেটের মধ্যে একটা মানুষের অস্তিত্ব যতোই অনুভূত হতে থাকলো, সাথে সাথে আমার ভেতরেও একটা বড় পরিবর্তন আসতে শুরু করলো। আমি হাত দিয়ে ছুঁয়ে ওর নড়াচড়া টের পেতাম। ও ভেতর থেকে আমার সাথে দুষ্টুমি করা শিখে গেলো আস্তে আস্তে। আমাকে সে পাঞ্চ করতো, আমিও করতাম, যেন সে অনুভব করে বাবাকে আবার ফিরিয়ে দিতো সে পাঞ্চ। যথারীতি আমার একটা নতুন মা, আমার সবচেয়ে আদরের মেয়েটা পৃথিবীতে এলো। প্রথম আমি ওকে দেখি আমার মায়ের কোলে। এ দৃশ্য দেখে আমি চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। এ এক অপূর্ব অনুভূতি, আমার মায়ের কোলে আমার মা। জানিনা এ ভাগ্য কজনের হয়েছে!
কোন এক জায়গায় বাসে করে যাচ্ছিলাম, জানালা দিয়ে রাস্তার পাশে চোখ আটকে গেলো, এক মা কয়েক মাস বয়সি এক বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ময়লার ভেতর থেকে খাবার খুঁজে বের করছিল আর বাচ্চাকে আগে নিজে খেয়ে পরখ করে তারপর খাওয়াচ্ছিল। চোখের কোনে জল জমে গেলো বুকটা ফেটে যাচ্ছিল কিছু করতে না পারার বেদনায়। এ দৃশ্য দেখে আর দশটা মানুষের মতো আমিও কাপুরুষের মত পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম। নিয়ে গেলাম সাথে করে মা শব্দটার মমতা, ভালোবাসা আর নির্ভরতার প্রতিকি চিত্র।
আমি রোজ দেখি আমার সহকর্মী অনেক মাকে, যারা কী পরিমাণ ভেঙ্গে পড়েন যখন তার আদরের সন্তানটি অসুস্থ থাকে। তাদের কোনো কাজেই মন বসে না, কিন্তু মন না বসলে কী হবে? কর্পোরেট মা’দের যে অনুভূতি থাকতে নেই, তাদের যে শত কষ্টের মাঝেও হাসি মুখে কাজ করে যেতে হয়, পাছে কোম্পানির ক্ষতি হয়ে যায় যদি?
এক একজন মা এতো বেশি শক্তিশালী, তাদের সন্তানের জন্য ভালোবাসার শক্তি তাদের এতো বেশি যে মনে হয় পৃথিবীর সেরা সেরা লড়াকু যোদ্ধারাও তার কাছে অনায়াসে হেরে যাবে। এ শক্তি যে মায়ের ভালোবাসার শক্তি।
আমি আমার মাকে আজ অবধি কোনদিন বুকে জড়িয়ে বলতে পারিনি “মা আমি তোমাকে ভালোবাসি”, আমি জানি এ অনুভূতি অনেকের, যারা বলতে চেয়েও কী এক অদ্ভুত জড়তার কারণে বলতে পারেনি বা পারছে না। আমার মনে হয় পৃথিবীতে এমন একজন মানুষও নাই যাকে তার মা জড়িয়ে ধরার পর অজান্তেই তার চোখের কোনে এক ফোটা জল জমেনি। যখনই বড় কোনো সমস্যার সম্মুখিন হবেন, দেখবেন মাকে মনে পড়ে যাচ্ছে, খুব ইচ্ছে করবে সেই মুহূর্তেই মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে।
“মা, মাগো, ও মা” এইভাবে সুর করে, আহ্লাদ করে, আবেগে ডাকতে পারার মধ্যে কী যে শান্তি, আর কোনো ডাকে এ শান্তি আছে কিনা জানি না। যে মানুষটির মা নেই, তারও আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, মা তুমি কই? একটিবার আসো। খুব ইচ্ছে করে দৌড়ে গিয়ে তোমার কোলে ঢুকে যেতে।
মা তুমি আছো তাই মাঝে মাঝে তোমাকে মিস করার, তোমাকে অনুভব করার সুযোগ পাই না, কিন্তু তার মানে এই না যে কোন এক ক্ষণে একবারও বলতে ইচ্ছে করে না “মা আমি তোমাকে ভালোবাসি, তুমি আমার সবকিছু, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আজ অবধি আমার শত শত আবদার পূরণ করার জন্য।” আমার মা আছে, যার মা নেই তার এ অনুভূতি আমার চেয়েও প্রকট।
ভালো থাকুক সকল কন্যা, জায়া, জননী।
ঢাকা, বাংলাদেশ।